চলতি মৌসুমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড়, প্লাবন ও ভূমিকম্প অকস্মাৎ শত শত মানুষের মৃত্যু ডেকে এনেছে। এরূপ দুর্যোগ মানব জীবনে বয়ে আনে সীমাহীন দুর্ভোগ, বহু মানুষ হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে। তাতে আমরা অন্তত একটি সান্ত্বনা পাই, এটি ভেবে যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা অসহায়। তবে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মেনে নেয়া যায় না। মানব গোষ্ঠীর একাংশ যখন আরেক অংশের বিরুদ্ধে মারণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে সেটিকেও যুদ্ধের পরিণতি বলে চালিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু যখন একটি গোষ্ঠী খাদ্য সরবরাহ বন্ধ রেখে আরেক জনগোষ্ঠীকে দুর্ভিক্ষের কবলে ফেলে, তখন তাকে আর সভ্যতা বলা যায় না। ফিলিস্তিনের গাজায় খাদ্য সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে ইসরাইল যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চলেছে এবং তাতে শিশু, বৃদ্ধসহ অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন মৃত্যুবরণ করছে তা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে। টেলিভিশন ও সামাজিক গণমাধ্যমের সুবাদে গাজার যে সব করুণ দৃশ্য আমরা দেখতে পাই তা সহ্য করা অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। গাজায় ইসরাইলের বর্বর হামলায় গাজা মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রায় ৬০ হাজার নিরস্ত্র মানুষ নিহত হয়েছেন; ৪০ হাজারের মতো আহত হয়ে একরকম বিনাচিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরছেন বা কোনোভাবে বেঁচে আছেন। তাদের বেশির ভাগ নারী ও শিশু। পাশাপাশি এখন মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে তাদের বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকু অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইউনিসেফ ও বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গাজার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়েছেন, ৩৯ শতাংশ অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন, ১৬ শতাংশ শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। প্রতিদিন অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছেন। মায়েদের বুকের দুধ শুকিয়ে গেছে, ফলে শিশুরা মাতৃদুগ্ধ পান করতে পারছে না। হাড্ডিসার শিশুদের ছবি দেখে আমরা আঁতকে উঠছি।
ইসরাইলের যুদ্ধবাজ শাসকগোষ্ঠী ফিলিস্তিনবাসীকে অনাহারে মেরে ফেলতে চাচ্ছে। বিশেষ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশুদের প্রতি যেন তাদের ক্ষোভের সীমা নেই। হিংস্র পশুও যেকোনো প্রাণী শিশুর প্রতি মমত্ব দেখায়। ইসরাইলি কট্টর ইহুদিদের সে মায়া-মমতাও নেই। এরা হিংস্র পশুর চেয়েও নরাধম। বিশ্বের দেশে দেশে বিশাল বিশাল সমাবেশ হচ্ছে ফিলিস্তিনের সমর্থনে। এসব দেশের অধিকাংশ পাশ্চাত্যের। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর অধিকাংশ যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইসরাইলের প্রতি অন্ধ সমর্থন ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। যদিও ওইসব দেশের সাধারণ মানুষের বিশাল অংশ ইসরাইলের ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন। কিন্তু তাদের শাসকরা তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করছে না।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জাতিসঙ্ঘ যুক্তরাষ্ট্রের অহমিকার সামনে এখন একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক কোনো আইন, বিধি-বিধান, আদালত কোনো কিছু ইসরাইলের টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারছে না। মানবসভ্যতা যেন একটি চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এক সময়ে ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’-এর কথা বলেছিল। আজ দুনিয়া যে কোন অর্ডারে চলছে তা বোঝা মুশকিল। আসলে কোনো সিস্টেম এখন আর কাজ করছে না। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হচ্ছে না, ফিলিস্তিনের দুর্দশা অবসানের কোনো লক্ষণ নেই। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ বন্ধের কোনো লক্ষণ নেই।
সবচেয়ে হাতাশার বিষয় হলো- ফিলিস্তিনের ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের নীরব ভূমিকা। একমাত্র ইরান ইসরাইলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, তারা হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি যোদ্ধাদের সাহায্য সমর্থন দিয়ে আসছে। আরব দেশগুলোর ভূমিকায় মুসলিম উম্মাহ একেবারে হতাশ। আমরা আজকে পরীক্ষা করে দেখব, মুসলিম রাষ্ট্রগুলো কেন নীরব ভূমিকা পালন করছে। শুধু নীরবতা নয়; বরং কোনো কোনো দেশ রীতিমতো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। মিসর, জর্দান, আরব-আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো ইসরাইলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। তুরস্কের ভূমিকাও পরিষ্কার নয়। তারা মুখে বড় বড় কথা বললেও কাজে তেমন দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধের কথা না হয় বাদই দিলাম। ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি ভাইবোন শিশুদের আহাজারি কি এসব মুসলিম শাসকের হ্রদয়কে নাড়া দেয় না। ইউরোপ থেকে অমুসলিম অ্যাক্টিভিস্টরা তো আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, তারা লাখ লাখ মানুষের বিক্ষোভ করে তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করছেন। সেখানে প্রতিবেশী মুসলিম ধনী দেশগুলো বিলাসিতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তারা অস্ত্র পাঠাতে না হয় সাহস পায় না, তাই বলে কি শুধু খাবারও পাঠাতে পারে না?
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ইসরাইলের দীর্ঘদিনের সখ্যতা। ফিলিস্তিন ভূখণ্ড অন্যায়ভাবে জবরদখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টিতে প্রধানত দায়ী রাষ্ট্র যুক্তরাজ্য। এসব দেশের বিদেশ নীতি, জাতিসঙ্ঘে তাদের ভোটিং আচরণ ও বক্তৃতা-বিবৃতি, সব ইসরাইলের পক্ষে যায়। সাম্প্রতিককালে ইউরোপের কয়েকটি দেশ যেমন আয়ারল্যান্ড, স্পেন, বেলজিয়াম ফিলিস্তিনের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। ফ্রান্স, সুইডেন, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া একই ধরনের আভাস দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইসরাইলের পক্ষে অনড়। জাতিসঙ্ঘে বহুবার যুদ্ধবিরতি বা ইসরাইলের বিরুদ্ধে রেজুলেশন আনা হয়েছে। প্রতিবার যুক্তরাষ্ট্র তাতে ভেটো দিয়েছে। এ অবস্থা আর কত দিন চলবে তা পরিষ্কার নয়। এমনকি মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রেও তাদের হ্রদয় গলছে না।
আরব দেশগুলোর প্রায় সব ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী রাজা-বাদশাহ রয়েছেন। তারা ফিলিস্তিনের পক্ষে জনগণকে কোনো কথা বলতে পর্যন্ত দেন না। ওইসব দেশে মতপ্রকাশের বা সভা মিছিল বা রাজনৈতিক সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয় না। তারা ভয় পায়, এরূপ সুযোগ দেয়া হলে জনগণ তাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। বাস্তবে এটি সত্য যে, প্রায় সব আরব রাষ্ট্রে হামাস ও ইখওয়ানুল মুসলিমিনের বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে। তারা গণতন্ত্রের ছোঁয়া পেলে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে পারে। এ কারণে কোনো কোনো দেশে এসব সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মজার বিষয় হলোÑ পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য নিয়মিত চিৎকার করলেও এসব আরব রাষ্ট্রের স্বৈরশাসন নিয়ে কখনো কথা বলে না।
অবশ্য আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে উসমানীয় খিলাফত ধ্বংস করে নিজেদের স্বার্থে আরব ভূখণ্ডকে বণ্টন করার লক্ষ্যে যেসব রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়, তারা আজকের দিনেও পশ্চিমাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে নীরবতা পালন করছে। এসব দেশের শাসকেরা নিজেদের ক্ষমতা রক্ষায় বিশাল সামরিক শক্তি ও অস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তুলছে এবং এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করছে। কিন্তু তাদের সে সামরিক শক্তি ইসরাইলের দিকে ফিরেও তাকায় না। তথাকথিত আব্রাহাম অ্যাকর্ডের মাধ্যমে আরব-আমিরাত ও বাহরাইন ইসরাইলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। তাদের মধ্যে ব্যবসায়-বাণিজ্যও চলমান রয়েছে। সৌদি আরব সরাসরি ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে না তুললেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ইসরাইলের ব্যাপারে শক্ত কোনো ভূমিকা নেয় না। শুধু বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আরব বিশ্বের সাথে ইরানের সম্পর্ক কখনো গভীর হয়নি। একটি শ্রেণী সবসময় শিয়া-সুন্নি বিভেদ জিইয়ে রাখতে সচেষ্ট থাকে। আমরা যখন দেখি, ইরান ও সৌদি আরব সম্পর্ক উন্নয়ন করছে তখন খুশি হই এবং আশায় বুক বাধি। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতে আবার পস্পরের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বস্তুত যারা মুসলিম উম্মাহর ঐক্য দেখতে চায় না; তারা নানা অজুহাতে শিয়া-সুন্নি বিরোধ জিইয়ে রাখার অপচেষ্টা করে। এর মধ্যে এক শ্রেণীর ধর্মীয় গোষ্ঠীও রয়েছে।
গাজায় পাঠানোর জন্য হাজার হাজার ত্রাণবাহী যানবাহন মিসর সীমান্তে অপেক্ষা করছে। কিন্তু সেগুলো গাজায় পাঠানোর জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ বলে মনে হচ্ছে। যেসব মুসলিম দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে তারাও সফলভাবে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে শুনতে পাইনি। ফলে ফিলিস্তিনবাসী তাদের মুসলিম প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে কোনো প্রকার সাহায্য পাচ্ছে না বললে চলে। সামান্য যা যাচ্ছে, তা দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে যথেষ্ট নয়।
বেশ কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে রয়েছে, যেমন- সিরিয়া, ইরাক, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, সুদান, লেবানন। এ দেশগুলোর করুণ পরিণতির জন্য পাশ্চাত্য দেশগুলো দায়ী। এসব দেশ অস্তিত্ব সঙ্কটে রয়েছে। তাদের পক্ষে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কথা বলা বা পদক্ষেপ নেয়ার অবস্থা নেই। যদিও বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্রে অনেক বিক্ষোভ হয়েছে কিন্তু সেগুলোর কোনো প্রভাব কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি।
পরিশেষে বলা যেতে পারে, মুসলিম দেশগুলো নিজেদের অস্তিত্ব সঙ্কট, কৌশলগত ভীরুতা, অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও আপসকামিতার নীতি নেয়ায় ইসরাইল সাহস পাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের টুঁটি চেপে ধরতে। যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ে সবাই যেন চুপসে গেছে। এখন সময় এসেছে মুসলিম উম্মাহর সাধারণ মানুষের জেগে ওঠার। জালিমের দাম্ভিকতা চূর্ণ করে দিতে সবার আগে দরকার জনগণের সরকার কায়েম করা।
আজকে যেভাবে পাশ্চাত্যের সাধারণ মানুষ মজলুম ফিলিস্তিনবাসীর পক্ষে সোচ্চার হচ্ছেন, তাদের সাথে সুর মিলিয়ে মুসলিম উম্মাহর যুবকদেরও জেগে উঠতে হবে। শাসকদের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে হবে মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে। স্পেনের বার্সেলোনা থেকে যে শত শত জাহাজ গাজা অবরোধ ভেঙে মানবিক সাহায্য নিয়ে ভূমধ্যসাগরের জলরাশি ভেদ করে এগিয়ে চলছে, আমাদেরও তেমনি সোচ্চার হতে হবে।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
[email protected]