বর্তমানে আমরা ২০২৫ সালের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। যুদ্ধ-সঙ্ঘাত ও নানা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলতি বছরটি শেষ হতে চলেছে। স্বাভাবিকভাবে সবার মনে জানতে ইচ্ছে হয় আগামী বছরটি কেমন হবে? ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক উত্তেজনা তীব্রতর হওয়ার সাথে সাথে সঙ্ঘাত অব্যাহত থাকায় ২০২৬ সালেও বিশ্ব তীব্র অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শীতল যুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে বিশ্বে এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘আমেরিকা-ফার্স্ট’ নীতি বৈশ্বিক বিষয়গুলোতে আরো অস্থিরতার সৃষ্টি করবে। নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থা, তীব্র পতনের সাথে আরো খণ্ডিত হবে। বহুপক্ষীয় বা বহুত্ববাদ আরো চাপের মুখে পড়বে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করতে থাকলেও পশ্চিমা আধিপত্য হ্রাস পাবে। চীনের বৈশ্বিক শক্তি এবং ভূমিকা বৃদ্ধি পাবে। পরিবর্তনশীলতা বা প্রাণচাঞ্চল্য হবে ভঙ্গুর আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট তথা ভূদৃশ্যের একটি স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য।
ছয়টি প্রধান প্রবণতা আগামী বছরে বৈশ্বিক বিষয়গুলোকে রূপ দেবে, যদিও এটি একটি সম্পূর্ণ তালিকা নয়। প্রথমটি হলো পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট যেখানে নিয়মভাঙা এবং ভবিষ্যতে কী হতে পারে সে ব্যাপারে ব্যাপক অনিশ্চয়তা থকাবে। ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন মূলত মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউক্রেনের পরিস্থিতি কিভাবে বিকশিত হয়, মার্কিন-চীন সম্পর্কে গতিপথ এবং ট্রাম্প কর্তৃক ঘোষিত বাণিজ্যযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় দেশগুলো কিভাবে সমন্বয় করে তার ওপর নির্ভর করবে।
ট্রাম্পের বিঘ্নকারী নীতি এবং অন্যান্য শক্তির কারণে বিশ্বব্যাপী নিয়মগুলো বিপর্যস্ত হওয়ার সাথে সাথে কেউ কেউ যাকে ‘নিয়মহীন বিশ্ব’ বলে অভিহিত করে তার দিকে ঝুঁকে পড়া আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। লন্ডন-ভিত্তিক পরামর্শদাতা সংস্থা কন্ট্রোল রিস্কস, ২০২৬ সালের জন্য শীর্ষ ঝুঁকির মূল্যায়নে, এমন একটি বিশ্বের পূর্বাভাস দিয়েছে যেখানে প্রতিষ্ঠিত নিয়মগুলো ম্লান হয়ে যাবে এমনকি ভেঙে যাবে। এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোকে আরো লেনদেন এবং পরিস্থিতির সাথে খাপখাওয়ার উপযোগী করে তুলবে। এটি যুক্তি দেয় যে, স্বার্থ ‘নতুন মূল্যবোধ’ হয়ে উঠবে।
আগামী বছরও অব্যাহত থাকা দ্বিতীয় প্রবণতা হলো হার্ড পাওয়ার তথা কঠোর শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, যা ২০২৫ সালে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ছিল। এটি স্পষ্ট যে, সংলাপ এবং কূটনীতির পরিবর্তে সামরিক বা অর্থনৈতিক বলপ্রয়োগই শক্তিশালী দেশ এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর নীতিগত পছন্দ হয়ে উঠেছে, যাতে তারা অন্যান্য রাষ্ট্রকে তাদের ইচ্ছার কাছে নত করে রাখতে পারে। আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধিতা বা অমান্য করে হুমকি বা শক্তিপ্রয়োগ এই সঙ্ঘাতের নতুন যুগে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ, ইরান, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনের ওপর ইসরাইলি আক্রমণ, ইরানে মার্কিন বোমাবর্ষণ এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক পদক্ষেপ এসবই শক্তিপ্রয়োগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার প্রমাণ। এর অর্থ হলো- একটি ভঙ্গুর বিশ্বব্যবস্থা আরো ভেঙে পড়বে।
ইকোনমিস্ট তাদের বার্ষিক প্রকাশনা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাহেড’-এ প্রশ্ন তুলেছে যে, বিশ্ব কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের নেতৃত্বে একটি নতুন শীতল যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, নাকি ট্রাম্পের চুক্তি চালিত দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বকে আমেরিকান, চীনা এবং রাশিয়ান ‘প্রভাব ক্ষেত্রে’ বিভক্ত করবে যেখানে তারা প্রত্যেকেই তাদের ক্ষেত্রে খেলার নিয়ম নির্ধারণ করবে।
এটি উল্লেখ করে যে, পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে পরস্পরবিরোধী তথা দ্ব›দ্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন এবং দু’টির মধ্যে কোনটি বাস্তবায়িত হবে সে ব্যাপারে তারা তেমন একটা নিশ্চিত নন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর মতো আগামী বছরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সম্পর্কের গতিপথ হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত। এটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং এর সুদূরপ্রসারী বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে। চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের শুল্ক আক্রমণ সম্পর্ককে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবুও ট্রাম্প বারবার বলেছেন তিনি বেইজিংয়ের সাথে একটি বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষর করতে চান। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে ২০২৫ সালের অক্টোবরে তাদের মধ্যকার বৈঠকের সময় একটি বাণিজ্যচুক্তিতে পৌঁছেছিলেন। এটি উভয় দেশের বাণিজ্যযুদ্ধের ক্ষেত্রে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি চিহ্নিত করে। মার্কিন শুল্কের বিরুদ্ধে চীনের কার্যকর পদক্ষেপ দু’টি জিনিস দেখিয়েছে। চীন আমেরিকার ওপরও ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে এবং প্রয়োজনে তার শক্তি প্রদর্শনেও চীন দ্বিধা করে না। চীন ২০২৬ সালে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে এবং ইতোমধ্যে প্রায় ৭০টি দেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। যদিও উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজেনা কমানোর পারস্পরিক আগ্রহ রয়েছে, তবুও ২০২৬ সাল নির্ধারণ করবে যে, তাদের সম্পর্কের মধ্যে অস্থায়ী শান্তি কতটা টেকসই হবে।
চতুর্থত, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্যে প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় প্রাধান্য পাবে। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে অনুমোদিত ট্রাম্পের ২০ দফা গাজা শান্তি পরিকল্পনা এখনো ঝুলে আছে। কারণ এর বাস্তবায়নের পথে কোনো বাধা এখনো দূর করা হয়নি। হামাস বিভিন্ন কারণে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসরাইলিরা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন অব্যাহত রেখেছে। গাজার অর্ধেকেরও বেশি দখল এবং পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও একইভাবে অব্যাহত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে হামাস নিরস্ত্রীকরণ বাস্তবায়ন করবে না। শান্তি আলোচনার ভাগ্য ২০২৬ সালে নির্ধারিত হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে মার্কিন-রাশিয়া চুক্তি হবে কি না সেটিও আগামী বছরেই নির্ধারিত হবে। আপাতত উভয় ফ্রন্টেই অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
পঞ্চম প্রবণতা হলো মধ্যপন্থী শক্তির ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার কাঠামোগত পরিবর্তন এবং ছত্রভঙ্গ অবস্থা মধ্যপন্থী শক্তির কূটনৈতিক সক্রিয়তা এবং তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতা দেশগুলোকে সেই প্রতিদ্ব›িদ্বতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সুরেযাগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার এবং তাদের দরকষাকষির ক্ষমতা জোরদার করার সুযোগ দিয়েছে। ২০২৬ সালে এই প্রবণতা আরো জোরদার হলে বিশ্বের দুই পরাশক্তি মধ্যম শক্তিধর দেশগুলোকে সম্পৃক্ত করার জন্য আরো কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে বাধ্য হবে।
ষষ্ঠ প্রবণতা হলো এআই তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি, তবে এর অপ্রত্যাশিত খারাপ পরিণতি সম্পর্কে উদ্বেগও বাড়ছে। ব্যবসা, কর্মক্ষেত্র, বিনোদন, মিডিয়া এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে এআই মিডিয়া এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে এআই-চালিত সরঞ্জামগুলো আমাদের জীবনযাপনের পথে, শেখার ক্ষেত্রে এবং কাজ করার ধরনকে রূপান্তরিত করেছে। তবে উদ্বেগের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- চাকরির ওপর এর প্রভাব এবং সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি। এআই-এর সামরিক ব্যবহারও একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, সুপার পাওয়ারদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা, অব্যাহত দ্ব›দ্ব এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর চাপে বিশ্ব একটি অপ্রত্যাশিত ও অস্থিতিশীল অবস্থায় থাকবে।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত



