সাঈদ বারী
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব নতুন নয়; বরং রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই দেশের রাজনৈতিক বিন্যাস, ক্ষমতার ধারাবাহিকতা ও নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রে ছিল সেনাশক্তির দৃশ্যমান-অদৃশ্য ছায়া। তবু সাম্প্রতিক সময়ে যে একক সামরিক ক্ষমতার পুনর্গঠন ঘটেছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন জেনারেল (অধুনা ফিল্ড মার্শাল) আসিম মুনির- বর্তমান সেনাপ্রধান, যার উত্থান পাকিস্তানের ক্ষমতাকাঠামোকে নতুন এক পর্বে পৌঁছে দিয়েছে। তার নেতৃত্ব শুধু সেনাপ্রধান হিসেবে নয়, বরং দেশের রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই পাকিস্তানের বর্তমান সঙ্কট, ক্ষমতার দ্ব›দ্ব ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পথরেখা বুঝতে হলে আসিম মুনিরকে বিশ্লেষণের কেন্দ্রে রাখতে হয়।
আসিম মুনিরের উত্থানের প্রেক্ষাপট জটিল ও বহুমাত্রিক। সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবে পরিচিত ডিরেক্টর জেনারেল মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স (ডিএমআই) এবং পরে আইএসআইয়ের মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করে তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, রাজনৈতিক গোপনচক্র এবং আন্তর্জাতিক গোয়েন্দাবৃত্তির জটিল নেটওয়ার্কের গভীরে যুক্ত ছিলেন। এই অভিজ্ঞতাই তাকে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে তথ্যসমৃদ্ধ, নেটওয়ার্ক শক্তিশালী এবং কৌশলী নেতাদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ইমরান খান ক্ষমতায় থাকাকালে তার সাথে মুনিরের দূরত্ব তৈরির ঘটনাটি আজ পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রায় কিংবদন্তি, আর সেই পর্যায় থেকেই ক্ষমতার বাস্তব পালাবদলের বীজ বোনা শুরু হয়।
দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে ‘ক্ষমতার ত্রিভুজ’- সেনাবাহিনী, ইমরান খান ও বেসামরিক রাজনৈতিক দলগুলো টানাপড়েন তৈরি করে রেখেছিল, মুনিরের উত্থান সেখানে নতুন এক গাণিতিক সমীকরণ সৃষ্টি করে। ইমরান খানের পতনের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, মুনির দ্রুত সেই শূন্যতাকে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে রূপান্তর করেন।
বর্তমান পাকিস্তান এক ধরনের প্রহসনমূলক নির্বাচনী কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে- মূল প্রতিদ্ব›দ্বী কারাগারে, আদালত ক্ষমতাসীন জোটের সহায়ক শক্তিতে রূপ নেয়, আর সরকারের নেপথ্য নিয়ন্ত্রণ দৃঢ়ভাবে সেনাবাহিনীর হাতে। এর কেন্দ্রে আছেন আসিম মুনির।
তবে শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনই নয়, মুনিরের ক্ষমতার বিস্তার আরো সুদূরপ্রসারী। পাকিস্তানের অর্থনীতি যখন দেউলিয়া অবস্থার কিনারায় দাঁড়িয়ে, তখন সেনাবাহিনীর ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য- এফাউজি ফাউন্ডেশন, এএফডব্লিউও, কৃষি জমির সামরিক মালিকানা- সবই তার আমলে আরো বর্ধিত হচ্ছে। বেসামরিক খাত যখন সঙ্কুচিত, তখন সামরিক ব্যবসায়িক স্বার্থ বরং আরো দৃঢ় হচ্ছে, এ সত্য পাকিস্তানের ক্ষমতার অন্দরমহল বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মুনির নতুন এক কূটনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উষ্ণ করা, সৌদি আরব ও চীনের কাছে পাকিস্তানের স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেয়া, আফগানিস্তান সীমান্তে নতুন সামরিক অবস্থান- এসবই তার নেতৃত্বকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সীমা ছাড়িয়ে বহিঃনীতির শক্তিশালী নিয়ন্ত্রকে পরিণত করেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্ব›িদ্বতার চাপে যে সূ² ভারসাম্য পাকিস্তানকে বজায় রাখতে হয়, মুনির তা আপাতদৃষ্টিতে দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছেন। তবে এই সফলতা দেশকে গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে, নাকি আরো গভীর সামরিকীকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এই প্রশ্ন থেকেই যায়।
আসিম মুনিরের সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো, তার ‘জিরো টলারেন্স’ রাজনৈতিক নীতি। ইমরান খানকে একেবারে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার পর পাকিস্তানের যে সামান্য গণতান্ত্রিক পরিসর ছিল, তা আরো সঙ্কুচিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, মানবাধিকারকর্মীদের ওপর নজরদারি, রাজনৈতিক বৈঠকে সেনা গোয়েন্দাদের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ- সবই এখন স্বাভাবিক ঘটনা।
সেনাবাহিনীকে জাতীয় নিরাপত্তার নামে সর্বময় ক্ষমতা দেয়ার ফলে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এমনকি পিএমএল-এন বা পিপিপি- মূল ধারার দলগুলোরও কণ্ঠস্বর এখন অনেকাংশে সংযত; কারণ তারা জানে, সেনাবাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে চলাই রাজনীতিতে টিকে থাকার একমাত্র উপায়।
মুনিরের নেতৃত্বের আরেকটি দিক হলো তার ঘোষিত ‘নৈতিক শৃঙ্খলা পুনর্গঠন’ প্রকল্প। তিনি প্রকাশ্যে ধর্মীয় নৈতিকতার ওপর জোর দেন, দুর্নীতি দমনের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে টার্গেট করেন এবং রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার একরৈখিক সামরিক সংজ্ঞা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। পাকিস্তানের মতো বহুমতের রাষ্ট্রে এই একমাত্রিক নৈতিকতার চাপ গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক; কারণ সামরিক নৈতিকতা সাধারণত মতপ্রকাশ ও বৈচিত্র্যের জায়গা সঙ্কুচিত করে।
তবে আসিম মুনিরের উত্থানকে শুধু নেতিবাচক চোখে দেখা হলে পুরো চিত্রটি পাওয়া যায় না। অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ, তেহরিক-ই-তালেবানের পুনর্জাগরণ, সীমান্তে ঘনঘন হামলা, বিচ্ছিন্নতাবাদী উত্তেজনা- এসব মোকাবেলায় একজন কঠোর, সংগঠিত নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল- এমন যুক্তি পাকিস্তানের বহু বিশ্লেষকই দেন। সেনাবাহিনী দেশটির সবচেয়ে সংগঠিত প্রতিষ্ঠান; তাই তাদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য- এ ধারণাও প্রচলিত। মুনিরের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান কিছু ক্ষেত্রে কার্যকর হয়েছে, এ দাবি পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র কি চিরকাল নিরাপত্তাকে ভিত্তি করে টিকে থাকতে পারে? পাকিস্তান কি সারা জীবন ‘নিরাপত্তা রাষ্ট্র’ হিসেবে চলবে? গণতন্ত্র, নাগরিক স্বাধীনতা, বহুমত- এসব কি সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে স্থগিত থাকবে? আজ পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সঙ্কট রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য পুরোপুরি ভেঙে পড়া। বেসামরিক রাজনীতি দুর্বল, নির্বাচনী কাঠামো প্রশ্নবিদ্ধ, বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে, আর সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সব স্তরে প্রবেশ করেছে।
এই বাস্তবতায় আসিম মুনিরের নেতৃত্ব পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে যাবে? বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হয়, পাকিস্তান আবারো ‘ম্যানেজড ডেমোক্র্যাসি’র দিকে যাচ্ছে, যেখানে ভোট-দল-নির্বাচন থাকবে, কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা থাকবে সেনাবাহিনীর হাতে। কিছুটা তুরস্কের পুরনো কেমালিস্ট মডেল কিংবা মিসরের সিসি শাসনের মতো- যেখানে সামরিক বাহিনী রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনের ওপর পূর্ণ আধিপত্য বজায় রাখে।
আইয়ুব খান, জিয়াউল হক, পারভেজ মুশাররফ, এই সামরিক শাসকদের উত্থান-পতন ছিল নাটকীয়। কিন্তু আসিম মুনির নতুন ধরনের এক সামরিক নেতা যিনি প্রকাশ্যে ক্ষমতা দখল করছেন না; বরং গণতন্ত্রের কাঠামোর আড়ালে থেকে কর্তৃত্ববাদের সূ², সংগঠিত রূপ নির্মাণ করছেন। এটিই তাকে আরো প্রভাবশালী ও দীর্ঘস্থায়ী করে তুলতে পারে। এটি পাকিস্তানের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়- যেখানে সামরিক নিয়ন্ত্রণ আরো নিখুঁত, আরো পদ্ধতিগত ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।
পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ তাই নির্ভর করছে তিনটি বিষয়ের ওপর, প্রকৃত রাজনৈতিক নেতৃত্বের পুনরুত্থান হবে কি না; অর্থনৈতিক সঙ্কট সামরিক নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে কি না এবং আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলো এই সামরিক আধিপত্যকে কতটা সমর্থন বা সহনশীলতা দেখাবে। আপাতত সামরিক নেতৃত্বের অবস্থান দৃঢ় হলেও, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক চাপ বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
আসিম মুনিরের উত্থান তাই একদিকে সামরিক প্রতিষ্ঠানের শক্তিমত্তার প্রতীক, অন্যদিকে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক পরিসর সঙ্কুচিত হওয়ার সঙ্কেত। সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্র কোনো দিন স্থায়ী স্থিতি পায় না- এ কথা পাকিস্তানের ইতিহাসই বলে। তাই পাকিস্তানের স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী বেসামরিক নেতৃত্ব, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ও জনগণের ক্ষমতায়ন। কিন্তু আজ দেশ সেই পথ থেকে অনেকটাই দূরে।
আসিম মুনির পাকিস্তানকে কি আরো সামরিক-অধীন রাষ্ট্রে পরিণত করবেন, নাকি একসময় উপলব্ধি করবেন যে টেকসই স্থিতির জন্য বেসামরিক রাজনীতিই অপরিহার্য- এর উত্তর সময়ই দেবে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, পাকিস্তানে সামরিক নিয়ন্ত্রণের নতুন যুগ শুরু হয়েছে এবং তার মূল স্থপতি আসিম মুনির। তার উত্থান পাকিস্তানের রাজনীতিকে দীর্ঘদিন ধরেই প্রভাবিত করবে- আর সেই প্রভাব কতটা শুভ বা অশুভ হবে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
লেখক : কলামিস্ট, প্রকাশক


