মার্কিন সেনা অফিসারের জবানে গাজার মানবিক বিপর্যয়

২০২৫ সালের মে মাসে গাজা উপত্যকা, মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২০ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস, বিশ্ব ইতিহাসের এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মঞ্চে পরিণত হয়। ধ্বংস্তূপ, অনাহার আর কান্নায় ডুবে থাকা এই উপত্যকায়, সহানুভ‚তির এক নির্ভীক কণ্ঠ উঠে আসে, সাবেক মার্কিন গ্রিন বেরেট লেফটেন্যান্ট কর্নেল অ্যান্থনি আগুইলার, যিনি মানবিক সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (GFH) স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত হন।

গাজার ক্ষুধার্ত ও নির্যাতিত জনগণের পাশে দাঁড়াতে আগুইলার বাড়িয়ে দিয়েছিলেন করুণা ও সেবার হাত। কিন্তু মাত্র ৪৮ দিনের মধ্যেই তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন। কারণ, তিনি চোখের যা সামনে দেখেছেন, তা ছিল নির্মমতা, বর্বরতা ও পরিকল্পিত গণহত্যা। সাম্প্রতিক বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তার বক্তব্য গোটা মানবজাতির বিবেককে নাড়া দেয়।

কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ : আধুনিক যুগের গণহত্যার নতুন অস্ত্র
আগুইলারের ভাষ্য অনুযায়ী- ইসরাইলি বাহিনী (IDF) উদ্দেশ্যমূলকভাবে গাজার মানবিক সহায়তা কার্যক্রম ধ্বংস করে দিয়েছে। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত, ইসরাইল জাতিসঙ্ঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোকে গাজায় খাদ্য, ওষুধ বা ন্যূনতম সাহায্যও পৌঁছাতে দিচ্ছে না। বর্তমানে মাত্র চারটি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ সহায়তার আশায় ছুটে আসেন।

এই কেন্দ্রগুলো গাজার চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধীসহ অনেকেই প্রতিদিন আট থেকে ১২ মাইল হেঁটে আসেন একটি খাবারের থলির জন্য। কিন্তু দিনের শেষে অনেকেই খালি হাতে ফিরে যান। আর যখন তারা ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ফিরে যান, তখন তাদের ওপর গুলি চালানো হয়।

‘আমি নিজ চোখে দেখেছি’ আগুইলার এক সাক্ষাৎকারে বলেন। ‘তারা হেঁটে চলে যাচ্ছিল- নিরস্ত্র, নিরীহ, ক্ষুধার্ত। তাদের ওপর গুলি চালানো হয়। এরা কোনো সন্ত্রাসী নয়। তারা সাধারণ মানুষ। শিশু, মা, বৃদ্ধ মানুষ। এর উদ্দেশ্য একটিই, তাদের ধ্বংস করা।’

যুদ্ধাপরাধের সাক্ষী : নীরব থাকতে পারেননি আগুইলার
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আগুইলার একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ সেনা কর্মকর্তা। ইরাক, আফগানিস্তান ও আফ্রিকায় তার বিশেষ বাহিনীতে দায়িত্ব পালন রয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্র তার অচেনা নয়। কিন্তু গাজায় যা দেখেছেন, তা তাকে হতবাক করেছে।‘আমি আমার সামরিক জীবনে কখনো এমন অমানবিকতা দেখিনি। এটি যুদ্ধ নয়, এটি নির্বিচারে মানুষ হত্যার উৎসব।’

তিনি ইসরাইলের কর্মকাণ্ডকে ‘বর্বর’ ও ‘আমেরিকার আদর্শ পরিপন্থী’ বলে উল্লেখ করেন। তার মতে, মার্কিন সরকার ইসরাইলকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে এই অপরাধে সহায়তা করছে।

‘আমেরিকানদের জানাতে হবে তাদের সরকার কী করছে। এটি আত্মরক্ষার যুদ্ধ নয়। এটি একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা এবং আমরাই এর অর্থ জোগাচ্ছি।’

এক পরিকল্পিত গণহত্যার চিত্র
অক্টোবর ২০২৩ সালে যুদ্ধের সূচনা থেকে গাজার জীবনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। এখন আর বড় আকারের বোমাবর্ষণ নয়; বরং ক্ষুধার অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। বিদ্যুৎ, পানি, ওষুধ নেই। ক্ষেতের ফসল ধ্বংস করা হয়েছে, হাসপাতাল ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ায় গুলি করা হচ্ছে। সবকিছুরই লক্ষ্য যেন একটিই, গাজাবাসীর জীবন অকার্যকর করে তোলা।

‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে আপনি হাসপাতালে বোমা ফেলেন, শিশুদের না খাইয়ে মেরে ফেলা কোনো নিরাপত্তা কৌশল নয়।’-আগুইলারের মন্তব্য।

বিবেক কোথায়?
আগুইলারের সততা ও বিবেকী বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও বিশ্বনেতারা এখনো চুপ। পশ্চিমা গণমাধ্যম প্রায়ই সত্য গোপন করছে। বিশ্বনেতারা এখনো ‘ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার’-এর পুরনো বুলি আওড়াচ্ছেন। অথচ বাস্তবে, ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন, যার মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি নারী ও শিশু। বহু ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন, খাদ্যবাহী ট্রাকগুলোতে হামলা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। এ ধরনের পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ এবং জনগণকে বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সরাসরি যুদ্ধাপরাধের শামিল। কিন্তু ইসরাইল মুক্তভাবে এ অপরাধ করে চলেছে, কারণ পেছনে রয়েছে আমেরিকার ক‚টনৈতিক ও সামরিক ছায়া।

আন্তর্জাতিক সচেতনতার ডাক
অ্যান্থনি আগুইলারের সাহসী বক্তব্য শুধু একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়; বরং পুরো মানবজাতির বিবেককে নাড়া দেয়া এক জাগরণী উচ্চারণ। তিনি যা দেখেছেন, তা শুধু গাজাবাসীর করুণ বাস্তবতা নয়, সেটি আধুনিক সভ্যতার এক নগ্ন প্রতিচ্ছবি, যেখানে রাষ্ট্রশক্তি পরিকল্পিতভাবে এক জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছে, আর বিশ্ব- বিশেষ করে তথাকথিত উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো নীরব দর্শকের ভূমিকায়।

আমাদের মনে রাখা উচিত, নীরবতা মানেই অপরাধে অংশগ্রহণ। যে মুহূর্তে কেউ নির্যাতনের ছবি দেখে চুপ থাকে, শিশু হত্যার খবর শুনেও প্রতিক্রিয়া জানায় না, মানবতার নামে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো পাশ কাটিয়ে যায়, সে মুহূর্তে তারা পরোক্ষভাবে অপরাধীর পাশে দাঁড়িয়ে যায়। ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে নীরবতা একটি জনগোষ্ঠীর ধ্বংস ত্বরান্বিত করেছে। গাজা সেই একই করুণ অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি।

‘আমেরিকার আত্মা জাগ্রত হওয়া উচিত’-এই বাক্যটি শুধু একটি সমালোচনামূলক বক্তব্য নয়; বরং এটি মার্কিন জনগণের প্রতি আত্মপর্যালোচনার আহ্বান। আগুইলার জানেন, আমেরিকা শুধু অস্ত্র, অর্থ বা প্রভাবের দেশ নয়; এটি ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের প্রতীক- কমপক্ষে এটাই তারা দাবি করে থাকে। তিনি সেই মূল্যবোধের পক্ষেই কথা বলছেন, যা আজ ইসরাইলকে অস্ত্র দিয়ে, ক‚টনৈতিক ঢাল দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। তিনি চেয়েছেন আমেরিকান নাগরিকদের জাগ্রত বিবেক যেন তাদের সরকারকে প্রশ্ন করে, ‘তোমরা আমাদের নামে কী করছ?’

মানবতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে, এই সত্য আজ সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। ধর্ম, রাজনীতি, ভৌগোলিক সীমারেখা কিংবা জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত, কোনোটিই শিশুহত্যার ন্যায়সঙ্গত ব্যাখ্যা হতে পারে না। গাজার শিশু জানে না রাজনীতি কী, নিরাপত্তা কী, ক‚টনীতি কী। তারা জানে শুধু ক্ষুধা, আশ্রয় আর জীবনের আকুতি। সেই নিষ্পাপ জীবনকে হত্যা করার পক্ষে কেউ কথা বললে, তারা আর মানুষ থাকে না।

ইতিহাসের অভিজ্ঞতা বলে, সত্যের কণ্ঠকে অনেক সময়ই দমন করা যায়; কিন্তু চিরতরে নয়। ইতিহাস মনে রাখে শুধু জয়ীকে নয়, প্রতিবাদীকেও। যারা অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ‘না’ বলেছে, তারা হয়তো পরাজিত হয়েছে বাহ্যিকভাবে কিন্তু তাদের নাম লেখা হয়েছে মহত্তে¡র পাতায়। ইতিহাস মনে রাখবে অ্যান্থনি আগুইলারের মতো বিবেকবান মানুষকে- যিনি নিজের পদ, পরিচয়, সম্মান ত্যাগ করে একটিবার বলে উঠেছেন, ‘এটি অন্যায়, এটি গণহত্যা।’

একইভাবে ইতিহাস মনে রাখবে সেসব নীরব রাষ্ট্রনায়ক, সুবিধাবাদী মিডিয়া এবং মেরুদণ্ডহীন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে, যারা ন্যায়ের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। হয়তো একদিন তাদের সন্তানরাও জানতে চাইবে, তোমরা কোথায় ছিলে, যখন গাজায় হাজার হাজার মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছিল?

এখনো সময় আছে। মানবতার পক্ষ নেয়ার, সত্যের পাশে দাঁড়ানোর, নিজের আত্মাকে প্রশ্ন করার। অ্যান্থনি আগুইলার একা দাঁড়িয়েছেন। আমরা কি পারি না তার পাশে দাঁড়াতে? যদি আমরা সত্যিই বিশ্বাস করি ন্যায়বিচারে, তবে আজ গাজার শিশুদের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য। একজন সৈনিকের বিবেক যখন জেগে ওঠে, তখন গোটা পৃথিবীর বিবেকেরও জেগে ওঠা উচিত। কারণ নিরীহের রক্তে যে দাগ লাগে, তা শুধু ভ‚মিতেই পড়ে না- মানবতার মুখেও চিরকালের জন্য আঁচড় ফেলে যায়।

অবিলম্বে কী করা উচিত?
১. অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও পূর্ণ মানবিক সহায়তার অনুমতি নিশ্চিত করা।

২. আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ তদন্ত শুরু করা ও দোষীদের বিচারের আওতায় আনা।

৩. ইসরাইলকে দেয়া আমেরিকার সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা পুনর্বিবেচনা।

৪. বৈশ্বিক নাগরিক সমাজের সক্রিয় প্রতিরোধ- মিছিল, বয়কট, সাইবার প্রচারণা।

৫. ধর্মীয় নেতাদের সক্রিয় ভ‚মিকা ও জুমার খুতবায় গণহত্যার নিন্দা করা।

শেষ কথা : আল্লাহ জালিমদের ছেড়ে দেন না, বিচার বিলম্বিত হতে পারে; কিন্তু বাতিল হয় না। ইসরাইল বা আমেরিকার সামরিক শক্তি কখনোই মহান আল্লাহর ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না। গাজার নিরীহ মানুষের কান্না পৌঁছেছে আসমানে। এখন পৃথিবীর দায়িত্ব- মানবতার পাশে দাঁড়ানো।

‘আর যারা জুলুম করে, তাদের সম্পর্কে তুমি মনে করো না যে, আল্লাহ তাদের প্রতি গাফিল। তিনি কেবল তাদের একটি নির্দিষ্ট দিনের জন্য অবকাশ দিচ্ছেন, যে দিন চক্ষুগুলো স্থির হয়ে যাবে আতঙ্কে।’ (আল কুরআন, সূরা ইবরাহিম-৪২)

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক