বেখবর থাকা বুদ্ধিহীনতা

প্রফেসর ইউনূস এখন কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের চোখের বালি। আজ হোক বা কাল হোক তিনি অবসরে যাবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের ইমেজটা যে আকাশচুম্বী করেছেন, সরে গেলে সেই ইমেজের যে ভূপতন ঘটবে, সেটি ঠেকাবে কে? কোনো দলের এমন একজন ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করুন, না হয় সব দল মিলে একটি নামের কথা বলুন। ধীরে সজনি ধীরে। শৈশবে-কৈশোরে মাঠে-ঘাটে সর্বত্র একটি কথা শুনতাম, বিড়াল দিয়ে কখনো ক্ষেতে মই তাড়ানো যায় না

বিদেশে এসে আমি বিস্ময়ে হতবাক। এখানে প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেশের (বাংলাদেশ) নাড়ি-নক্ষত্রের খবর পর্যন্ত রাখছেন। শুধু অতীতের নয়, একেবারে হালনাগাদ খবর পর্যন্ত। এখানে মেলবোর্ন ও সিডনির অনেক প্রবাসীজন কথা প্রসঙ্গে জানালেন, তারা প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটি সময় ইন্টারনেটে প্রবেশ করেন। দেশ ও দুনিয়ার খবরাখবর নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকতে চান। দেশের সাথে নাড়িচ্যুত হতে চান না বলেই ইন্টারনেটের প্রতি তাদের এই আকর্ষণ। দেশ নিয়ে প্রতিদিন আমাকে এত প্রশ্নের মখোমুখি হতে হচ্ছে যে, তার অনেক কথারই জবাব আমার কাছে নেই। তাদের প্রশ্নের ধরন শুনে মনে হয়েছে, তারা দেশের হাঁড়ির খবর পর্যন্ত রাখেন। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজ-বাস্তবতা, নীতিনৈতিকতা, সরকার, বিরোধী দল, আগামী নির্বাচন ছাড়াও বহু স্পর্শকাতর বিষয়েও তাদের যেন অন্তহীন জিজ্ঞাসা।

এখানে পড়তে আসা এক যুবক আচমকা এক প্রশ্ন করল, আচ্ছা, বলুন তো বাংলাদেশে এক ব্যাগ তাজা, খাঁটি রক্তের মূল্য কত! ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে ’২৪-এর জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে প্রাণ দিয়েছে হাজারো শিশু, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, সবল-দুর্বল, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। শরীরের হাজার হাজার লিটার রক্ত দিয়ে সেই পথ করেছিল পিচ্ছিল। সেই রক্তের ঋণ কতটা আপনারা পরিশোধ করেছেন! যার হুকুমে এবং যারা এমন রক্ত ঝরিয়েছে সরকার তাদের কী করেছে, রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে কে কী দাবি করেছে। সবাই তো এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে। ডে অব জাজমেন্টে আপনারা এর কী জবাব দেবেন! ভুলে যাচ্ছেন কেন, আজ চোখ বন্ধ হলে কালই তো সেই বিচারের দিন। তখন পালাবেন কোথায়, একবার ভেবে দেখেছেন কি, সেখানে সে দিন কী অজুহাত দাঁড় করাবেন! যেসব কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী আপনাদের মুক্ত করতে অকালে জীবন দিলো তাদের আত্মত্যাগের পরিমাণ কতটা তার হিসাবটা কেউ কি করেছেন।

তাদের ভাষায় আমরা অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর ও অপরিণামদর্শী। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রতীক হিসেবে কয়টি মিনার নির্মিত হচ্ছে। তাদের পরিবার-পরিজনদের পাশে দাঁড়াতে কতজন নাম লিখিয়েছেন, তাদের পরিজনদের সত্যিকারের সহায়তার জন্য কয়টি ফাউন্ডেশন সরকার গঠন করেছে। আমরা প্রবাসীরা যৎকিঞ্চিৎ যা কিছু পারি, সে সহায়তা নেয়ারও কি কোনো বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। দূর থেকে এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছি, জাতি হিসেবে আমরা ‘কথায় বড় ফাস্ট অথচ কাজে বড্ড স্লো’। সারা দিন আমরা কথার মালা গাঁথি, দিন শেষে সব কথা ভুলে যাই। দেশে সবাই এখন ঐক্য ঐক্য বলে চিৎকার করছে। এমন বিপদে কেন ঐক্য হয় না এ নিয়ে কেউ কি ভাবছে? ঐক্যের জন্য কার কতটুকু ছাড় দেয়া প্রয়োজন তা কি আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি? কেউ কেউ তো বাইরে থেকে প্রেসক্রিপশন পাওয়ার জন্য চাতকের মতো তৃঞ্চার্ত হয়ে আছি।

মেলবোর্নে একজন আইটি শিক্ষক জানতে চাইলেন, ভাই এখন সব রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা রক্তভেজা রাজপথে বীরদর্পে বুক ফুলিয়ে নানা দাবিতে লংমার্চ করছে। আমরা তো গুগল সাহেবের হাত ধরে বহু নেতা-নেত্রীর আচরণ-বিচরণ দেখেছি এবং দেখছি। কেউ টিলায় চড়ে শুধু অপেক্ষা করছিলেন, কেউ নিরাপদ আশ্রয়ে একটু সবুর করেছিলেন। কখন কে কী বলেছেন সবই আমি গুগুল সাহেবের কাছে জমা রেখেছি। সময় এলে তাদের নগ্নপদ করব।

মেলবোর্নে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে গবেষণারত এক যুবক সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে আমেরিকায় পৌঁছে এক প্রশ্ন করলেন। বলুন তো, কমলা হ্যারিস নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন কেন। তার পেছনে ওবামা ও মিশেল ছিলেন, আরো ছিলেন গ্রেট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারিও। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তো কমলার জন্য বিরাট সেক্রিফাইস করেছিলেন। এতসবের পরও কমলা কেন গো-হারা হেরেছেন জানেন? কারণটা কী ছিল? সবচেয়ে বড় কারণ ছিল দ্রব্যমূল্য। আমেরিকার একজন সাধারণ মানুষকে বাইডেনের আমলে এক পাউন্ড রুটি তিনগুণ মূল্যে কিনতে হয়েছে। এই সাধারণরাই তো ডিসাইসিভ ভোটার। শেখ হাসিনার সময় দেশের মানুষ প্রতিটি ভোগ্যপণ্য চার-পাঁচগুণ মূল্যে কিনেছে। যারা এত দামে জিনিস কিনতে পারেননি, কখনো কিছু একটা খেয়েছেন আবার না খেয়েও দিন-রাত যাপন করেছেন। এ নিয়ে আপনারা (প্রেস) কেবল দায় সেরেছেন আর রাজনীতিকরা কেবল লিপসার্ভিস দিয়ে গেছেন। এবার ঈদে আপনারা সব কিছুই তো দেখেছেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ে কেউ কি সরকারকে একটুও ‘প্রেইজ’ করেছিলেন?

এ কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বাণিজ্য উপদেষ্টাকে একটু সাধুবাদও কেউ জানাননি। অথচ দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে তাকে বহুজন কটাক্ষ ও কটূক্তি করেছেন। তার কাজটা দেখতে এতটুকুও অপেক্ষা করেনি। সংবাদপত্রগুলো কেবল তথ্য প্রকাশ করেছে; কিন্তু কোনো মন্তব্য প্রতিবেদন করেনি। পলিটিক্যাল অ্যারেনা থেকে ‘বিপ্লবের’ পর গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বিরুদ্ধে বারবার একটি অভিযোগ উঠানো হয়েছে এরা অদক্ষ, অনভিজ্ঞ। এর শতভাগ সত্য না হলেও খানিকটা তো সত্য। অবশ্যই উপদেষ্টাদের কাজের মূল্যায়ন করা উচিত ছিল। তাহলে জনগণ এই সরকারের কাছ থেকে আরো সুফল পেত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে অবাক বিস্ময়ে দেখেছি, হতে যাওয়া একটি সাংবিধানিক ক্যু কী পরিমাণ দক্ষতার সাথে ছাত্র সহায়তায় আইন উপদেষ্টা ভণ্ডুল করে দিয়েছেন। এরপর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও অ্যাপিলেট ডিভিশনে যে পুনর্বিন্যাস ঘটিয়েছেন তাকে কিভাবে খাটো করে দেখবেন। এভাবেই প্রতিবিপ্লব ঠেকানো হয়েছে। তা না হলে কাকে কোথায় পালাতে হতো, আবারো কত রক্ত ঝরত কে জানে। সেটি নিয়ে কেউ তো কোনো কথা বলেননি। কিছু দিন আগে জনাব ফওজুল কবির খানের একটি লেখা ঢাকার এক পত্রিকায় পড়েছি। চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে তিনি যেভাবে পরিকল্পনার একটি ছক তৈরি করেছেন, এক কথায় সেটি অনবদ্য ও কালোত্তীর্ণ। রাজনৈতিক মহল থেকে কেন এসব নিয়ে কোনো কথা নেই। কেন নেই তা আমরা জানি, তবে কারো যোগ্যতা নিয়ে আজ আর প্রশ্ন তুলতে চাই না।

গবেষক ছাত্র আরো বলল, গবেষণার কাজে আমি অনলাইনে বিশ্বের অনেক পত্র-পত্রিকা পড়ি। ঢাকার পত্রিকা প্রায় প্রতিদিনই পড়ি। ঢাকার সব পত্রিকায় শুধু ব্যর্থতা, অরাজকতা আর অপকর্মের কথা শুনি। কিন্তু নেপথ্যের খলনায়কদের কলকাঠি নাড়ার কথাটি বলতে সবার যেন একটু বেশিই লজ্জা। তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে অবশ্য। অর্থনীতি গতি পাচ্ছে, ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, রেমিট্যান্স দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু হাসিনার ফলোয়াররা এসব দেখে তেলেবেগুনে জ্বলছে। কিভাবে এসব ইউটার্ন করানো যায় তা নিয়ে পাড়াপড়শীদের সাথে আলাপ-আলোচনায় তাদের দিন কাটছে।

আচ্ছা ভাই, আপনারা সহজ কথা কঠিন করে বলতে চান কেন! আপনারা কঠিন শব্দ ‘সংস্কার সংস্কার’ করে উচ্চকণ্ঠ কেন? কেন বলেছেন না অবশ্যই একটি পরিবর্তন দরকার। এটিই সহজ কথা। ৫০ বছরের পুরনো একটি ঘর যখন নড়বড়ে হয়ে যায়, তখন তার অনেক কিছুই পাল্টানো ও মেরামতের দরকার হয়। ধরুন, একটি ঘর পরিষ্কার করার ঝাড়ু; যেটি অনেক পুরনো হয়ে গেছে। এটি দিয়ে আর কাজ হচ্ছে না। তখন এর পরিবর্তন না করলে ঘর তো আর বাসযোগ্য থাকবে না। এর পরিবর্তন না করে কি বনে গিয়ে বাস করবেন? পৃথিবীর সব দেশে, এমনকি ক্ষুদ্র কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রার্থীদের সবাই বলেন, জনগণের স্বার্থে আমরা এসব ব্যবস্থার পরিবর্তন করব। আর বাংলাদেশে পরিবর্তনের প্রশ্নে রাজনীতিকরা ভাবছে, পরিবর্তন হলে যেন তাদের ‘বাড়া ভাতে ছাই পড়বে’ মাথায় যেন আকাশ পড়বে। তাদের এমন অনমনীয়তা মনে করিয়ে দিচ্ছে তাদের কেউ কেউ এখন হাসিনা হতে চাচ্ছেন।

প্রফেসর ইউনূস এখন কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের চোখের বালি। আজ হোক বা কাল হোক তিনি অবসরে যাবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের ইমেজটা যে আকাশচুম্বী করেছেন, সরে গেলে সেই ইমেজের যে ভূপতন ঘটবে, সেটি ঠেকাবে কে? কোনো দলের এমন একজন ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করুন, না হয় সব দল মিলে একটি নামের কথা বলুন। ধীরে সজনি ধীরে। শৈশবে-কৈশোরে মাঠে-ঘাটে সর্বত্র একটি কথা শুনতাম, বিড়াল দিয়ে কখনো ক্ষেতে মই তাড়ানো যায় না।

তাই পুরনো ব্যবস্থাটাই ভালো। দেশের অবস্থা তো সব দল মিলেমিশে সেই ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’- এর কোনো পরিবর্তন চান না। শেষ কথা, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা। রাজনৈতিক নেতারা কি দেশের প্রতিরক্ষা নীতিটা নিয়ে কখনো ভেবেছেন এবং ফরেন পলিসি নিয়ে? এসব নিয়ে তাদের উদাসীন ও বেখবর থাকাটা তো বুদ্ধিহীনতা।

[email protected]