আজ ‘নয়া অর্থবছরের জাতীয় বাজেট’ টেলিভিশনে উপস্থাপিত হবে। বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশের সন্ধানে আমজনতার অতি প্রান্তজন ষাটোর্র্ধ্ব গফুর, তার মেয়ে আমিনা এবং তাদের প্রিয় প্রাণিসম্পদ ও সংসারের অন্যতম অর্থনৈতিক সহযোগী সদস্য মহেশের কথা জাতীয় বাজেটে কিভাবে এবং কতটা প্রতিফলিত হতে পারে সেটি নিরিখের বিষয়টি খোদ গফুর আমিনা আর মহেশের কাছে যখন জানতে চাওয়া হয় তখন তারা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জনাব শাইখ সিরাজের ‘কৃষকের বাজেটের’ এক মফস্বল মাহফিলে গফুর একসময় যোগ দিয়েছিল আর দশজনের মতো, সে যা বলেছিল তা ছবিতে ও শব্দে ধারণ করা হয়েছিল। সে শুনেছে গফুর যা যা বলেছিল তা টিভিতে নাকি দেখানোও হয়েছিল (মহেশদের তো আর টিভি দেখার সুযোগ বিধাতা তাদের কর্মপরিধিতে রাখেননি); কিন্তু বাজেটে তার কিছু প্রতিফলন হয়তো হয়েছে-হয়তো হয়নি। তবে শিল্প ও বণিক সমিতির বড় কর্তাব্যক্তিদের মতো গফুর যদি বলতে পারত, তাদের দাবিদাওয়ার কত পার্সেন্ট প্রতিফলন হয়েছে কি হয়নি; গফুর আমিনারা তো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বারান্দায়ও ঢুকবার পারে না, আর সচিবালয়ে, যেখানে বাজেটের রান্নাবাড়া হয়? তার নিজের কৃষি মন্ত্রণালয়ে?
বাজেট বানানোর রান্নাঘরে ঢুকবার না পারলেও বাজেটে যা সাব্যস্ত হয়, অপ্রত্যক্ষ করের বোঝা টের পেতে গফুর আমিনাদের সময় লাগে না। সকালে কিংবা বিকেলে বাজেটে যদি ফোনে কথা বলার ওপর বাড়তি বিলের ‘প্রস্তাব’ পেশ হয়। প্রস্তাব পেশ হতে না হতেই সন্ধ্যা থেকে আমজনতার মোবাইলে কথা বলার ওপর বাড়তি পয়সা কাটা শুরু হয়ে যায়। এই পয়সা সরকারের খাজাঞ্চিখানায় কখন পৌঁছাবে, আদৌ পৌঁছায় কি না তার কিছুই সে জানে না, কেউ তাকে হিসাবও দেয় না। তবে সবতের কেনাবেচায় তার পকেটের পয়সা ঠিকই কাটা হয়। আমিনা তো আরো অবাক। মাসে মাত্র ৩০ টাকা ভরে তার মোবাইলে- ভাইটা মালয়েশিয়ার জঙ্গলে কাজ করে, বাজানের সাথে কথা বলে একটু রাইতে, শুধু লাইন পাবার জন্য মাসে মাত্র ৩০ টাকা ভরে- সেখানে শোনা যাচ্ছে, সেই টাকাও কমে যাবানে।
মোটাতাজাকরণ ধরনের যে তেলেসমাতি চালু হয়েছে তাতে নিজের মানসম্মান নিয়ে বংশগৌরব বজায় রেখে মহেশদের ইদানীং বেঁচে থাকা দায়। মহেশদের একসময় সম্মান ও কদর ছিল চাষাবাদে সহায়তার জন্য। এখন হালচাষের কাজও করে দেয় মেশিন। মহেশদের এখন আগামী সপ্তায় কোরবানির জন্য কাকে কত দামে বিক্রিযোগ্য করা যাবে সে ধান্ধায় থাকে সবাই। এ জন্য তাকে কত কিছু খেতে দেয়া হয়, তাকে হাইব্রিড পণ্য বানাবার জন্য। হায় অবস্থা এখন এমন হয়েছে, গফুর এক মণ ধানের যা দাম পায় তা দিয়ে এক কেজি গরুর গোশও পাওয়া দুষ্কর। গফুর চোখে সর্ষের ফুল দেখে চলেছে এ জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসেও। উৎপাদনের খরচ ওঠে না- সেই ফসলের বিনিময়মূল্য মহেশের সামান্য গোশত? মহেশ আর গফুরের মধ্যে এই দূরত্ব সৃষ্টির কারণ বা এর নিরসনের কোনো বয়ান জাতীয় বাজেটে আছে কি না- গফুর মহেশ দু’জনই জানে না। মহেশদের তো কোনো সমিতি নেই। খোদ গফুরদেরও পক্ষে বলার মতো সহায়ক সমিতি আছে কি না কে বলবে? নগরে নয়নাভিরাম শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ভবনে কেমন বাজেট চাই জাতীয় যে আলোচনা চলে মাঠে-ঘাটে, গফুরদের তখন বেবাক বেচাইন অবস্থা। বাজেট আলোচনাতেও বৈষম্যের বপু মোটা হচ্ছে। মিডিয়া ভোল পাল্টাতে পটুত্বেও প্রমাণ রাখছেই।
ব্রিটিশ আমলের গল্প সে শুনেছে। বাজেটকে ঘিরে তখনো আশা জাগানো হতো। পাড়ার পঞ্চায়েত পয়সাওয়ালাদের সাথে সাধারণের আর কোনো ফারাক থাকবে না- বৈষম্য কমে যাবে, কত কিছু। কিন্তু পরের জমানায় সে জানতে পারল- বৈষম্য কমেনি; বরং ২২ পরিবার ৯৪ লাখ পরিবারের প্রতিপক্ষ বনে গেছে। এসবের থেকে ‘মুক্তির সংগ্রামে’ গফুর নিজেও অনেক কষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছে। কিন্তু পরবর্তী ৫৩ বছরে, এখন ঘরে ঘরে শিক্ষিত বেকার সন্তানের সমাহার বাড়ছে। তাদের চাকরির বয়স চলে গেছে বা যাচ্ছে, তাদের অনেকেই এখনো চাকরি বা কোনো কর্মে নিয়োজিত হতে পারেনি। কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে অনেক কিছু খুইয়ে। আর তাদের দেশের কাজ করতে আসছে বিদেশের মানুষ। চাকরিবাকরি কর্মসৃজনে এই যে আত্মঘাতী অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে তা নিরসনে ১০ মাস আগে ছাত্র-জনতা আরেকবার ঝলসে ওঠে, প্রতিঘাতে অমূল্য জীবন ও সম্পদ সম্পত্তির সমূহ ক্ষতি। আমজনতার সেই আত্মত্যাগের বিনিময় নিয়ে জাতীয় বাজেটে কোনো কর্মপরিকল্পনা আছে কি না গফুর এখনো জানতে পারেনি।
আর আমিনা? সে শুনেছে ‘জেন্ডার বাজেট’ হচ্ছে- তাদের সার্বিক উন্নয়ন সাধনে অংশগ্রহণের জন্য। হিসাব রাখা হচ্ছে, হিসাব কষা হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধির জন্য কিন্তু ওগুলো ‘মন বোঝানোর জন্য’ না আসল কিছু। না, বেশ কিছু উন্নতি হয়েছে। আমিনা শুনেছে, তার দেশকে বাহবা দিচ্ছে বাইরের দুনিয়া। বছরখানেক আগেও বড় শহরে গিয়ে দেখেতে পেত, ইয়া বড় ব্যানারে সেসব সাফল্যগাথা লেখা রয়েছে। হ্যাঁ, সাফল্য এসেছে অনেক অনেক ক্ষেত্রেই। কিন্তু আমজনতার সর্বনাশের বেদনার বিবরে কতিপয়ের কূটবুদ্ধিও বিজয়ে বেহাত হয়েছে জাতীয় সম্পদ-সম্পত্তি। আমেনা টেলিভিশনে শুনেছে, খবরের কাগজে পড়েছে, সেসব উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
বাজেটে আমেনার বাপজান খালা ফুপুদের মতো প্রান্তজনদের সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু আসন্ন শিক্ষিতজনদের কর্মসৃজনের প্রয়াস-প্রচেষ্টায় কোনো কিছুর ভিজিবিলিটি বারবার চশমা পাল্টিয়েও বাড়ছে না। গফুর জমি চাষ করে এক ফসলের জায়গায় দুই-তিন ফসল, উচ্চ ফলনশীল শস্যের সমাহার ঘটায় কিন্তু তার বিক্রয়মূল্য যেভাবে পড়তে শুরু করেছে ভবিষ্যতে চাষবাষে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ে কি না, তার দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার বাড়াভাতে ছাই পড়ে কি না আবার খাদ্যশস্য আমদানির পথে হাঁটতে হয় কি না, গফুর কানাই করিম শামসু সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।
গফুরের কানে এসেছে আরো একটি কথা। বেশি বেশি কর দিতে হবে, হচ্ছেও। পরোক্ষ কর তো সবাইকেই দিতে হচ্ছে। আয়করের ক্ষেত্রে মহিলা, প্রতিবন্ধী, জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের বিশেষ একটা ছাড়ের পর কর দিতে হয়। গফুর এটি মনে করে কৃষি খাতের আওতাভুক্ত করে অন্যান্য আয়কে কৃষি খাতভুক্ত ধরে বাড়তি ছাড় পাওয়ার প্রয়াস চলছে। ভালো কথা। গফুরের স্বল্প ও সাদা জ্ঞানে এটি বোঝা হয়ে গেছে যে, আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে ফাঁকির পথ খোঁজে ধড়িবাজরা আর সেই ধড়িবাজদের ধরার নাম করে আইনকে করা হয় কঠিন। কিন্তু তাতে ধড়িবাজদের যতটা না নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, গফুরের মতো সাধারণ সাদা ও স্বচ্ছ মনের সুবোধদের ওপর পড়ে আইনের আঘাত। ধড়িবাজরা বরাবরই আঁতাতের আশ্রয়ে চলে যায় আর নিরীহ শান্ত সুবোধরা পড়ে বিপাকে। গফুরের মনে এই প্রবোধ ও প্রত্যয় যে, ‘চোর তো চুরি করবেই কিন্তু গৃহস্থকে সজাগ থাকতে হবে।’ এখানে গৃহস্থ যদি চোরের মাসতুতো ভাই হয় তাহলে সে সমাজে ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ শব্দ বিপর্যয়ের কবলে পড়ে ‘শিষ্টের দমন দুষ্টের পালন’ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমজনতা বাস করে যে গ্রামে সেই গ্রামীণ সমাজে বেশ কিছু পরিবর্তন তাদেরকে ভাবায় বৈকি। ডিজিটাল অগ্রগতিতে সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে অনেকগুলো ইতিবাচক সাফল্য লক্ষ করা যাচ্ছে। মালামাল পরিবহন ও মূল্য নির্ধারণ বিপণনক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি ও সফলতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধার অবৈধ ব্যবহারে উসকে দিয়ে সামাজিক ঐক্য, শান্তিু ও নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ভিনদেশী ও ভাষী উগ্র ও অসামাজিক কার্যকলাপের সাথে পরিচিতি ও ব্যবহারকে সহজলভ্য করে তুলেছে। তাদের পড়াশোনা ও জ্ঞানচর্চায় নানান অনৈতিক পন্থা ও প্রবৃত্তি অনুসরণে আগ্রহী করে তুলছে। পরীক্ষায় পাসনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাপনায় বিরাজ করছে অব্যবস্থাপনার মহোৎসব। শিক্ষকের নিয়োগ ও তাদের জ্ঞানবত্তা গুণগত মান নিয়ে সদাসর্বদা বাণিজ্য, অনিয়ম ও দুর্নীতি সর্বব্যাপী হয়ে ওঠায় শিক্ষার মানে ধস নামছে। জিপিএ ৫ পেয়েও শিক্ষার্থীরা উচ্চপর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষাতেই কুপোকাত হচ্ছে। চাকরিবাকরির পরীক্ষায় তারা সততা স্বচ্ছতার অভাবে মেধার জোরে টিকতেই পারছে না। শহরের গুটিকয়েক ভালো স্কুল ও ভালো শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করাদের কাছে আমজনতার থেকে উঠে আসারা দাঁড়াতেই পারছে না। গফুর দিব্য দৃষ্টিতে দেখছে, তার দেশ ও সমাজ একধরনের অস্বস্তিকর মেধাশূন্য পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার কারণে। শিক্ষায় ভর্তুকি দিয়ে জনশিক্ষার হার হয়তো বাড়ছে; কিন্তু গণশিক্ষা হচ্ছে না। এভাবে অন্তঃসারশূন্য শিক্ষায় শিক্ষিতরা দেশ ও সমাজের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে ‘সমস্যা’য় পরিণত হয় কি না গফুররা কাকে দেখতে বলবে?
প্রাণিসম্পদের জন্য সেবারের বাজেট বক্তৃতার ১২৫ অনুচ্ছেদের শেষের একটি বাক্য ছাড়া কিছুই মেলেনি। মহেশের মনে অনেক ক্ষোভ ও দুঃখ। সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য আজ নানান কারণে বিবিধ আক্রমণের শিকার। তাদের সুরক্ষার উন্নয়ন সম্পর্কে এবং তাদের বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়ার মতো বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বাজেটে তেমন কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই দেখে সুন্দরবনের বাঘ, বানর, হরিণ ও কুমির (বাবাহকু) সমিতি বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মহেশ এসব খবর রাখে না। তার রাখার কথাও না। মৎস্য ও পশুসম্পদ বিভাগের কাজ একত্রে থাকায় এবং মৎস্য চাষাবাদ ও ব্যবসার সাথে নগদ স্বার্থবাদিতার সম্পর্ক বেশি থাকায় মৎস্যসম্পদের দেখভাল প্রক্রিয়া পশুসম্পদের হিস্যায় ভাগ বসাচ্ছে। মহেশের মনে দুঃখ অনেক। গফুর মাছ চাষের ব্যাপারে যতটা না আন্তরিক মহেশকে দেখাশোনার ব্যাপারে ততটা নয়।
গফুর আমিনা আর মহেশের বাজেট বরাদ্দ কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতভুক্ত। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বাজেট বরাদ্দের বিপরীতে জিডিপির (যার হিসাবায়ন প্রচণ্ড ঘষামাজার শিকার) হিস্যা কমছেই। গফুর আমিনা আর মহেশরা এর কোনো কূলকিনারা পায় না।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরএর সাবেক চেয়ারম্যান