তিনি কবি-আধুনিক উর্দু ও ফারসি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কণ্ঠ। তিনি দার্শনিক-মুসলিম উম্মাহ ও এশিয়ার বৌদ্ধিক ধারায় অন্যতম মৌলিক চিন্তক। তিনি রাজনীতিতাত্তি¡ক-উপমহাদেশের রাষ্ট্রচিন্তার এক শীর্ষ পুরুষ।
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখা ও বিকশিত করার তাগিদে তাদের নিজস্ব স্বাধীন আবাসভূমি পাকিস্তান গঠনের তাত্তি¡ক পুরুষ তিনি।
তার কবিতা, দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রে ছিল ইসলাম। তিনি জ্ঞান ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতাকে দেখেছেন সমন্বিত পটভূমিতে, ওহি ও দর্শনের মধ্যে দেখেছেন নিবিড় সংযোগ ও সহবোধ, মানুষের বন্দেগি ও খুদির বিকাশ বা আত্মার স্বাধীনতা ও অমরত্বে স্থাপন করেছেন যৌথ বন্ধন, ইসলামী জীবনব্যবস্থার অবিচল সত্য ও নিরন্তর চলমানতা ও গভীরতার বিশ্লেষণ করেছেন প্রগাঢ় অন্তর্দৃষ্টির আলোয়।
তার খুদি দর্শন মানুষের পরম তরক্কি বা উন্নতির পতাকা ওড়ায়। যে মানুষ খোদার প্রতিনিধিত্বের পরম প্রতিফলন ঘটিয়ে জয় করে নিতে পারে নিজের তকদিরও। সে সাধনা করে পার হতে পারে সীমানার দেয়াল।
১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর আল্লামা মুহাম্মদ ইকবালের জন্ম হয় শিয়ালকোটে। জন্মস্থানে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পর লাহোরের সরকারি কলেজে দর্শন, ইংরেজি ও আরবি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে আইনশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি এবং ঐতিহ্যবাহী লিঙ্কনস ইন থেকে ব্যারিস্টার হিসেবে সনদ লাভ করেন। ১৯০৮ সালে তিনি মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট সম্পন্ন করেন। তারপর স্বদেশে ফেরেন।
তখন উপমহাদেশে উপনিবেশের ঘোর অন্ধকার। ইংরেজরা তাদের সব কৌশল এবং বলচর্চার মাধ্যমে মুসলমানদের দাসত্ব ও অজ্ঞতার দুর্গন্ধযুক্ত খাঁচায় আবদ্ধ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ইকবালের হৃদয় তার নিপীড়িত জাতির সেবার জন্য সর্বদা স্পন্দিত ছিল। তিনি মুসলমানদের সুপ্ত ও অলস আত্মায় একটি নতুন চেতনা সঞ্চারের চেষ্টা করেন। তার লক্ষ্য ছিল নৃশংস ব্রিটিশদের থেকে মুক্তি। তিনি মুসলমানদের মনে অদম্য উৎসাহ জাগিয়ে তোলেন, অনুপ্রেরণামূলক চিঠি লিখে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ভারতীয় মুসলমানদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের আহ্বান জানান।
ইকবালের বীরত্বপূর্ণ এবং দার্শনিক কবিতা তাকে ‘প্রাচ্যের কবি’ উপাধি দান করেছে। কবিতায় তাকে পশ্চিমে মিল্টন এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যারা ছিলেন তাদের জাতির বিজয়ী কবি। তার উচ্চমার্গীয় গীতি, মহৎ কাব্যিক উদাহরণ, শিশুদের জন্য সুরেলা গান এবং দার্শনিক মর্মসুর, কাব্যিক প্রকরণ তাকে অনন্যতা দিয়েছে, এনে দিয়েছে কালজয়ী খ্যাতি। বিশ্বসাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে তিনি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। মানবমাত্রেরই সমুন্নতির অন্টোলজিক্যাল ভাষ্য অনন্য আয়তন লাভ করেছে ইকবালের খুদিতত্তে¡। তার মর্দে মুমীন তত্ত¡ মুসলিম মানসকে আল্লাহর খলিফা হিসেবে আত্মপ্রত্যয়ী, কর্মমুখী ও সৃজনশীল এক নতুন চেতনার পথে আহ্বান জানায়। এভাবে তিনি সুফিবাদের আধ্যাত্মিক শক্তিকে গ্রহণ করেন, কিন্তু নিষ্ক্রিয় বৈরাগ্য ও ব্যক্তিপূজা থেকে মুসলিম সমাজকে দূরে সরাতে চেষ্টা করেন। তবে তার এই অবস্থান নিয়ে সমালোচকরা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও হাজির করেছেন- কারো মতে তিনি সুফিবাদের মরমি ঐতিহ্যকে যথাযথ স্থান দেননি। আবার কারো মতে তিনি আধুনিক মুসলিম মানসকে সক্রিয়তার দিকে প্রবাহিত করার এক সফল কৌশল নির্মাণ করেছিলেন।
ইকবাল কেবল মুসলমানদের নন, তিনি বিশ্বজনের। সর্বজনীন মানুষ ও মানবতা ছিল তার অন্বেষা। ফলে রাজনৈতিক বিরোধের প্রখর স্রোতেও ইকবাল সর্বভারতীয় চিত্তের শ্রদ্ধাভাজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থেকেছেন। ভারতীয় রাজনীতির শ্রেষ্ঠজনের ভাষায় ইকবালের মৃত্যু ‘ভারতের জাতীয় ক্ষতি’ বলে চিত্রিত হয়। ১৯৩৮ সালের ২৩ এপ্রিল স্টেটসম্যান পত্রিকা মন্তব্য করে :
তিনি মুসলমানদের ভালো নেতৃত্ব এবং বিচক্ষণ পরামর্শ দিয়েছিলেন। এমন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি, তেজোদ্দীপক চিন্তার উন্মেষক স্মরণীয় কাব্য রচয়িতার মৃত্যুতে মুসলমান সম্প্রদায় অপেক্ষা ভারত অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং বিশ্বসাহিত্য দরিদ্রতর হলো। (অনুবাদ-ভাষাচার্য শহীদুল্লাহ)।
ইকবালের মৃত্যুতে ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শোকবার্তা পাঠান। এতে লেখেন :
‘ইকবালের মৃত্যুতে আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে যে স্থান শূন্য হইল তাহা পূরণ হইতে দীর্ঘকাল লাগিবে। আমাদের সাহিত্য জীবনে ইহা একটি মারাত্মক আঘাত। জগতে আজ ভারতের স্থান অতি সংকীর্ণ; এই সময়ে ইকবালের মতো একজন কবিকে হারানো তাহার পক্ষে খুবই কষ্টের কথা। কারণ ইকবালের কবিতার একটা বিশ্বজনীন মূল্য ছিল।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২ এপ্রিল, ১৯৩৮)
বিশ শতকের প্রথমার্ধে ইকবাল মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার যে দার্শনিক ভিত্তি উপস্থাপন করেন, তা-ই পরবর্তীতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্তে¡ দার্শনিক পুষ্টি জোগায়। লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০) এর ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। বাংলার মুসলিম নেতাদের অংশগ্রহণও এতে ছিল- শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন।
তবে বাংলার মুসলিম নেতৃত্ব দ্বিজাতিতত্ত¡কে একরকমভাবে বুঝতে পারেনি। কেউ চাইছিল যুক্তবাংলা, কেউ আবার পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে একীভূত পূর্ববাংলা। এই দ্বিধা-দ্ব›দ্ব আসলে বাঙালি মুসলমানের ঐতিহাসিক পরিচয় সঙ্কটের প্রতিফলন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র আজও তার সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়োজনে মুসলিম জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার ওপর নির্ভর করে। কাজেই ইকবালের দর্শন বাংলাদেশের আত্মসত্তাকে আজো রক্তজল সরবরাহ করছে; বাংলাদেশ যত আত্মপ্রত্যয়ী হবে, ততই ইকবালের ইনসাফ ও আদলভিত্তিক উম্মাহচেতনায় ফিরতে মনোযোগী হবে।
বাংলা ভাষায় ইকবাল অন্বেষা একটি বিস্তৃত আয়তন লাভ করেছে। ইকবালের সমকালীন ও পরবর্তী মনীষাদের বড় একটা অংশ এই অন্বেষায় যুক্ত। যারা সরাসরি ইকবালের অনুবাদ করেছেন, তাদের মধ্যে আছেন কবি ও সাহিত্যিকদের উজ্জ্বল সব নাম।
অমীয় চক্রবর্তী, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, শঙ্খ ঘোষ, বেনজীর আহমদ, মহীউদ্দীন, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, আব্দুর রশীদ খান, আ ন ম বজলুর রশীদ, মোফাখখারুল ইসলাম, সৈয়দ আলী আশরাফ, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, আবদুস সাত্তার, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ বাংলা কবিতার জ্যোতিষ্কনাম ।
কত বর্ণিল তরঙ্গ ও রোদজলে ইকবালীয় সুর বাংলার তাল-তমাল-হিন্তালের পরমাত্মীয় হয়েছে! সৈয়দ আলী আহসানের জবানিতে তা যথার্থ ভাষা লাভ করে। তিনি লেখেন : তার হৃদয়ের বিপুলতা দেখেছি বাংলার আকাশে। যেমন নবোদিত সূর্য সমুদ্রের কল্লোলের যেমন পরিমাপ হয় না অথচ তা দেখে বিহবল ও আনিন্দিত হওয়া যায়, তেমনি ইকবালের গভীরতা, ব্যাপকতা ও বিপুলতা আয়ত্তাতীত কিন্তু আমাদের জন্য সংবেদনশীল ও আনন্দদীপ্ত। তার আত্মজিজ্ঞাসার বাণী আমাদের জন্য পরম অমোঘ। ( সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা কবিতার আসরে ইকবাল, ইকবাল সংসদ-২০০৭।)
কাব্যে ও গদ্যে যারা ইকবাল অনুবাদ করেছেন কিংবা ইকবালচর্চা করেছেন, তাদের মধ্যে আমাদের বৃহত্তর মননের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী নাম আসবে অনেক। উল্লেখযোগ্য কিছু নাম থেকেই আন্দাজ করা যেতে পারে যে, ইকবাল কত গভীরভাবে বাঙালি মানসকে উদ্দীপিত করেছেন, করছেন। ১. ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ২. কবি গোলাম মোস্তফা, ৩. মোহাম্মদ সুলতান, ৪. আশরাফ আলী খান, ৫. অমিয় চক্রবর্তী, ৬. মীজানুর রহমান, ৭. বে-নজীর আহমদ, ৮. ব’ নজির আহমদ ৯. প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, ১০. মহীউদ্দীন, ১১. দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ. ১২. আবদুল কাদির, ১৩. সুফিয়া কামাল, ১৪. আবু যোহা নূর আহমদ, ১৫. আবদুল হক , ১৬. ওহীদুল আলম, ১৭.সত্য গঙ্গোপাধ্যায়, ১৮. আ ন ম বজলুর রশীদ, ১৯. তালিম হোসেন, ২০. আহসান হাবীব, ২১. ফররুখ আহমদ, ২২. আবুল হোসেন, ২৩. সৈয়দ আলী আহসান, ২৪. বিচারপতি আবদুল মওদুদ, ২৫. মওলানা মোস্তাফিজুর রহমান, ২৬. মুফাখখারুল ইসলাম, ২৭. আবদুর রশীদ খান, ২৮. আবদুল আজিজ আল আমান ২৯. মনির উদদীন ইউসুফ, ৩০. মাওলানা আবদুর রহীম, ৩১. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ৩২. ড. মুহম্মদ আবদুল্লাহ, ৩৩. কামালুদ্দীন খান, ৩৪. অধ্যাপক সাইদুর রহমান ৩৫. মুহাম্মদ মোকসেদ আলী, ৩৬. সৈয়দ আবদুল মান্নান, ৩৭. সৈয়দ আলী আশরাফ, ৩৮. আবদুস সাত্তার, ৩৯. মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, ৪০. শঙ্খ ঘোষ, ৪১. ফারুক মাহমুদ, ৪২. গোলাম সামদানী কোরেশী, ৪৩. আবুল কালাম মোস্তফা, ৪৪. নিয়ামাল বাসির, ৪৫. আ ফ ম আবদুল হক ফরিদী, ৫৬. রূহুল আমীন খান, ৪৭. মুহাম্মদ আবু তাহের সিদ্দিকী, ৪৮. আ কা শ নূর মোহাম্মদ, ৪৯. মসউদ উশ শহীদ, ৫০. মওলানা তমীযুর রহমান, ৫১. রশিদা লতিফ, ৫২. বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ৫৩. সৈয়দ শামসুল হক, ৫৪. নূরউদ্দীন আহমদ, ৫৫. আবদুল মান্নান তালিব, ৫৬. আমীনুল ইসলাম, ৫৭. ফযলুর রহমান, ৫৮. শ্রী মনীন্দ্র দত্ত, ৫৯. আল মুজাহিদী, ৬০. মুহাম্মদ জালালুদ্দীন বিশ্বাস, ৬১. হাসনাইন ইমজিয়াজ ৬২. অধ্যাপক সিরাজুল হক, ৬৩. রণেশ দাশ গুপ্ত, ৬৪. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী , ৬৫. মতিউর রহমান মল্লিক, ৬৬. ডক্টর আবদুল ওয়াহিদ, ৬৭. মো: হারুনুর রশীদ, ৬৮. আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু প্রমুখ।
মহাকবি কায়কোবাদ, মহাকবি ইসমাইল হোসেন সিরাজি কিংবা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইকবালের পঠন ও প্রভাব কবুল করেছেন। তাদের মনন ও বোধনে ইকবাল হাজির হয়েছেন শ্রদ্ধা অধিকার করে।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন ইকবালের মনোযোগী পাঠক ও গুণগ্রাহী। মোহাম্মদ সুলতান ও আশরাফ আলী খানের অনূদিত শিকওয়া-জওয়াবে শিকওয়ার (১৯৩৩) ভূমিকা লেখেন তিনি। কাজীর ভাষায় : সুলতানের ‘শেকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়ার কাব্যানুবাদ পড়লাম আসল শেকওয়া ও জওয়াবে শেকওয়া পাশে রেখে। অনুবাদের দিক দিয়ে এমন সার্থক অনুবাদ আর দেখেছি বলে মনে হয় না। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ইকবালের অপূর্ব সৃষ্টি এই ‘শেকওয়া ও জওয়াবে শেকওয়া’। উর্দুভাষী ভারতবাসীর মুখে মুখে আজ শেকওয়ার বাণী। সেই বাণীকে রূপান্তরিত করা অত্যন্ত দুরূহ মনে করেই আমি এতে হাত দিতে সাহস করিনি। কবি সুলতানের অনুবাদ পড়ে বিস্মিত হলাম। অরিজিনাল ভাবকে এতটুকু অতিক্রম না করে এর অপরিমাণ সাবলীল সহজ গতিভঙ্গী দেখে। পশ্চিমের বোরকা পরা মেয়েকে বাংলার শাড়ির অবগুণ্ঠনে যেন আরো বেশি মানিয়েছে।’
ইকবাল যে বাংলার পরম স্বজন হয়ে উঠলেন, তা কেন ও কিভাবে, ব্যাখ্যা করেছেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। তার ভাষায়... ক্রমে ইকবালের সাথে আত্মীয় পরিচয় হতে লাগল। তার শেকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া আমাদের মনের দুয়ারে দারুণ আঘাত হানল। মুসলমানের মনের দিগন্তে আশার আলো চিকমিক করে জ্বলে উঠল। তিনি বলে যেতে লাগলেন, ‘আছে আমাদের সব আছে, শুধু চাই একজন নেতা!’...
ইকবাল আমাদের সৌন্দর্যের কবি যত বড়, শক্তির কবি তার চেয়ে অনেক বড়।...
আমাদের জাতিসত্তার অগ্রযাত্রার পথরেখায় ইকবাল হয়ে উঠেছেন প্রভাবক আলোকজল। যেখানে আমাদের চৈতন্য মন্থন করছে নিজেদের প্রয়োজনে, নিজস্ব আয়োজনে। এই মন্থনের গভীর ও ব্যাপকতরো এই ধারাবাহিকতার মূলে কী আছে? সৈয়দ আলী আহসানের ভাষা ধার করে বলতে হয়, এই মন্থন চলমান প্রথমত, আমাদের হৃদয়বৃত্তির সাথে যোগসূত্র নির্ণয়ের জন্য’ দ্বিতীয়ত, ধর্মবোধের পোষকতা ও তত্ত¡জিজ্ঞাসার মীমাংসার জন্য।
হৃদয়বৃত্তির যোগসূত্র যেহেতু লয়হীন, ধর্মবোধের পোষকতা ও তত্ত¡জিজ্ঞাসা যেহেতু নিত্যপ্রসারমান, তাই ইকবাল চর্চার গতিময়তা ও ব্যাপ্তি বাড়বে, এটাই অবধারিত। তবে এই প্রসারণ কেবল প্রশস্তির জায়গা নয়- বরং সমালোচনা, পুনঃপাঠ ও নতুন ব্যাখ্যার ভেতর দিয়েই ইকবাল-চিন্তা আমাদের মননে প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে।
আজ যখন নৈতিকতার সঙ্কটে বিশ্ব বিপন্ন, যখন মানবসভ্যতা প্রযুক্তির অগ্রগতিতে আত্মার দিশা হারাচ্ছে, তখন ইকবালের আহ্বান যেন চারপাশে গুঞ্জরিত হচ্ছে। যেন ইকবাল বলছেন, নিজেকে চেন, নিজের ভেতরের সামর্থ্য ও নবনির্মাণের স্রষ্টাকে চিনে নাও; তবেই বিশ্ব তোমার আয়নায় প্রতিফলিত হবে। ইকবাল শেখান, বিশ্বাস ও জ্ঞানের সমন্বয় ছাড়া স্বাধীনতা অপূর্ণ এবং আত্মপরিচয়হীন জাতি কখনো বিশ্বমানবতার আলোয় অংশ নিতে পারে না।
আজকের বাস্তবতায় আমরা যদি নতুন সমাজ, নতুন রাষ্ট্র ও নতুন সভ্যতার স্বপ্ন দেখি, তবে ইকবালের দর্শন আমাদের এক নৈতিক ও বৌদ্ধিক মানচিত্র দেয়, যেখানে আল্লাহর বন্দেগি ও মানুষের প্রতি দায়বোধ একই সূত্রে গাঁথা।
ইকবাল সেই স্থায়ী বোধের কবি- যিনি মানবজীবনের পরম অভিলাষকে রূপ দিয়েছেন জাগরণে, কর্মে, প্রেমে ও প্রজ্ঞায়। তাই তার চিন্তা সময়ের সীমা ছাড়িয়ে যায়। তার আলোকরেখা আজও পূর্ব ও পশ্চিমের অন্ধকারে পথ দেখায়। মানুষের প্রতিটি পতনাশঙ্কার সামনে দাঁড়িয়ে ইকবালের কবিতা বলতে থাকে, যে জাতি আত্মপরিচয়ের বুনিয়াদে নিজেদের সামর্থ্যকে বুলন্দ করে, তারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই রচনা করতে পারে।
লেখক : কবি, গবেষক