দেশ স্বাধীন করতে অসংখ্য মানুষ হাসিমুখে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু ঠিক কতজন মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন তার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায় না। কোনো তালিকাই নেই। প্রচলিত আছে যে, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে। কিন্তু এ সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারণ সংখ্যাটি কোনো তালিকার ভিত্তিতে বলা হয়নি, এটি অনেকটাই অনুমাননির্ভর।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন যান এবং তিনি সেখানে সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তিন মিলিয়ন মানুষ মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছে। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শহীদ হওয়ার বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে, যা আজো চালু। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ই শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন এবং এ সময়ে তার সাথে কারো কোনো যোগাযোগ ছিল না।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে কতজন মানুষ শহীদ হন তার সঠিক তালিকা তৈরি করা দরকার। কারণ অনুমাননির্ভর কোনো তথ্যের ভিত্তিতে একটি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস রচিত হতে পারে না।
বাস্তবতার আলোকে ৩০ লাখ শহীদ : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি বা ৭০০ লাখ। ৩০ লাখ মানুষ মারা গেলে গড়ে প্রতি ২৪ জনে একজন মানুষ মারা যাওয়ার কথা। প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় শহীদের কবর থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে সে রকম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২৬৬ দিন মুক্তিযুদ্ধ চলে। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ১১ হাজার ২৭৮ জন মানুষ মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছয় বছরে জার্মানির নাৎসি বাহিনী কর্তৃক ৬০ লাখ ইহুদি হত্যার কথা প্রচলিত আছে। এতে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার ৭৪০ জন মানুষ মারা যায়। সাম্প্রতিককালে ইসরাইলের হামলায় দুই বছরে গাজায় ৭০ হাজার মানুষ মারা যায়, এতে প্রতিদিন গড়ে ৯৬ জন মানুষ মারা যায়। স্বাভাবিকভাবেই এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রতিদিন নিহত মানুষের যে সংখ্যা আসছে তা অত্যধিক বেশি এবং বাস্তবসম্বমত নয় বলেই অনুমেয়।
শহীদের সংখ্যা নিয়ে কিছু গবেষণা রিপোর্ট : মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের সঠিক সংখ্যা বের করতে স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারি ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটি প্রায় দুই বছর কাজ করার পর ৫৮ থেকে ৬৫ হাজারের কাছাকাছি শহীদের তথ্য পায়। কিন্তু অজানা কারণে সেই কমিটি তার কাজ সম্পন্ন করেনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. শর্মিলা বসু প্রণীত ‘ডেড রেকনিং : মেমোরিজ অব দ্য ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার’ নামক বইয়ে মুক্তিযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা ৫০ হাজার থেকে এক লাখ বলে বর্ণনা করেন। এ রকম বহু গবেষণা হয়েছে; কিন্তু কোনোটিতেই এ সংখ্যা ৩০ লাখের ধারেকাছেও পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বলেন, ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজার ৭৯৫ জন শহীদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দুই লাখ পাঁচ হাজার ২০৬ জন মুক্তিযোদ্ধা সরকারি ভাতা পান। কোনো যুদ্ধে যত মানুষ মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মানুষ আহত হয়। এটি স্বাভাবিক ঘটনা। অথচ মারা গেছে ৩০ লাখ, আর ভাতা দুই লাখের সামান্য বেশি, যা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
শহীদদের তালিকা করা হোক : ১৮ কোটি মানুষের শুমারি, ১২ কোটি ভোটারের তালিকা ও পরিচয়পত্র তৈরি করা গেলে ৩০ লাখ শহীদের তালিকা অবশ্যই করা যাবে। মুক্তিযুদ্ধে জীবন দানকারীদের কোনো না কোনো আত্মীয়স্বজন এবং উত্তরাধিকারী এখনো বেঁচে আছে। তারা সহজেই শহীদদের নাম-ঠিকানা জমা দিতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী সব শহীদের তালিকা তৈরি করে সব বিতর্কের অবসান করে সঠিক ইতিহাস রচিত হোক।
লেখক : প্রকৌশলী



