জুলাই ঘোষণা ও নির্বাচন : স্বস্তি-অস্বস্তি

রাষ্ট্রের মৌলিক ১৯ সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একমত হয়েছে। এসব বিষয় হচ্ছে- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নমনীয় করণ, কমিটির ভাগাভাগি, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সংক্রান্ত বিধান আইনানুগকরণ, বিচার বিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা সীমিতকরণ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিধান ইত্যাদি

চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে গোটা জাতি আনন্দ-উদ্বেলে অতিক্রম করল একটি বছর। একই সময়ে দুটো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা এলো ৫ আগস্ট বর্ষপূর্তিতে। গণ-অভ্যুত্থানের প্রারম্ভে যে গণ-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে প্রথমত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সুশীলসমাজ ও সর্বস্তরের জনসাধারণের পক্ষ থেকে যে পরিবর্তন আকাক্সক্ষা প্রদর্শিত হয়েছে- তা এক কথায় অভূতপূর্ব। বিগত অর্ধ শতাব্দী যাবৎ রাজনৈতিক সরকারগুলো যে যথাযথভাবে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে গ্রাহ্য করেনি, এই অভ্যুত্থান এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তী দাবি-দাওয়ার বেশুমার প্রদর্শন-জমে থাকা হতাশারই প্রমাণ।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা সচেতন মানুষ জানেন। তার পরও অসচেতনভাবে প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণ, সচিবালয় এমনকি প্রধান উপদেষ্টার আবাসস্থল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে জনগণের আবেদন ও আন্দোলন। এককভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই হিমালয়সম ক্ষোভ ও ক্রোধকে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অক্ষম। তাই সঙ্গতভাবেই জন প্রতিনিধিত্বশীল সরকার অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত সরকারের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধানত তিনটি প্রত্যয় নিয়ে সরকার তার যাত্রা শুরু করে। প্রথমত এটি বৈষম্যের নিরসন। দ্বিতীয়ত এটি সংস্কার প্রস্তাবনা। তৃতীয়ত এটি গণহত্যাকারী পতিত সরকারের বিচার। বৈষম্যের নিরসন এমন একটি গণদাবি যার সাথে জড়িত আছে কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘকাল ধরে বঞ্চনার ইতিহাস। আর সংস্কার প্রস্তাবনা এতই দীর্ঘ এবং অগণিত যে হিসাব-নিকাশ একরকম অসম্ভব। সরকার এসব সংস্কার বা মেরামতের সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করে। অবশেষে ছয়টি কমিশনের মৌলিক বিষয়বস্তু নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অসম্ভব ধৈর্য ও কুশলতার সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য অর্জনের চেষ্টা করে। বাংলাদেশের জনচরিত্র বিভেদের-ঐক্যের নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঙনপ্রক্রিয়া গভীরভাবে অবলোকন করলেই এই দ্বন্দ্ব, কলহ, কোন্দল ইত্যাদির প্রমাণ মিলবে।

৩০টিরও অধিক রাজনৈতিক দল এই সংলাপে অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর শতভাগ একমত হওয়া অসম্ভব কল্পনা। তবে গরিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশির ভাগ বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করলেই- কমিশনের সার্থকতা প্রমাণিত হবে। যদিও কতিপয় মৌলিক বিষয়ে একমত হয়নি রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তবে যা অর্জিত হয়েছে এই দ্ব›দ্ব-বিদ্বেষের দেশে, তাও কম নয়।

সংস্কারের প্রধান প্রধান বিষয়গুলো ছিল সংবিধান, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রণয়ন, নির্বাচন ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ, গণপ্রতিনিধিদের সীমিত স্বাধীনতার গ্যারান্টি, আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা নির্ধারণ, শাসন ও বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনগুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিযুক্তির ন্যায্যকরণ। রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন কোনো দিক নেই যে সংস্কারের আবেদন উত্থাপিত হয়নি। রাষ্ট্রের মৌলিক ১৯ সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একমত হয়েছে। এসব বিষয় হচ্ছে- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নমনীয় করণ, কমিটির ভাগাভাগি, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সংক্রান্ত বিধান আইনানুগকরণ, বিচার বিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা সীমিতকরণ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিধান ইত্যাদি। এসব বিষয়ে সাধারণ ঐকমত্য অর্জন সরকারের একটি বড় সাফল্য। এদিকে সংস্কারের সাথে সাথে নির্বাচনের দাবি এবং ব্যবস্থাপনাও এগিয়ে চলেছে। সেই কারণে ৫ আগস্টের সুন্দর সময়ে সরকার একই সাথে দুটো গুরুত্বপূর্ণ দায় এবং দায়িত্ব পালনের ঘোষণা দিয়েছে।

যে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশিত হতে পারত অভ্যুত্থানের পরপরই, সেটি অবশেষে প্রকাশিত হলো। জুলাই বিপ্লবের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকার রেখে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। ঘোষণাপত্রে ২৮টি দফা রয়েছে। এখানে ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের স্বীকৃতি রয়েছে। ঘোষণাপত্রের ২৪ নম্বর দফায় গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রে আরো বলা হয়েছে- বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে, ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে। ঘোষণাপত্রের শেষ কথা এ রকম- ‘৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণ-অভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো। এই ঘোষণার মাধ্যমে বহুল প্রতীক্ষিত একটি বিষয়ের মীমাংসা হলো। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা বারবার এ ধরনের একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল। তারা নিজেরা ঘোষণাটি দেবে এরকম তারিখও দু-একবার দিয়েছে। সর্বশেষ এনসিপি বলেছিল, ৩ তারিখে জনসমক্ষে ঘোষণাটি প্রকাশ করা হবে। ঘোষণাটি অনেককে তুষ্ট করেছে। আবার রাজনৈতিক দলের কয়েকজন জুলাই ঘোষণায় সন্তুষ্ট হননি।

৫ আগস্ট ২০২৫ জাতীয় জীবনে গৌরবময় দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের পরপরই প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কাল ঘোষণা করেন। আগামী বছর, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই নির্বাচন আয়োজন করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি পাঠানোর কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইতোমধ্যেই সেই বহুল কাক্সিক্ষত চিঠি নির্বাচন কমিশন বরাবর পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- কমিশন যেন রমজান মাস শুরুর আগে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যার বিচার ও সংস্কারসহ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তার ভাষায়- ‘এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা, নির্বাচন অনুষ্ঠান। এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।’

নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন দূরত্ব ছিল। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন অনুষ্ঠানে বারবার ওয়াদা করছিলেন বটে, তবে সঠিকভাবে সুনির্দিষ্টভাবে তিনি কোনো কথা বলেননি। রাজনৈতিক দলগুলো স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনমুখী। যে দলটি যতটা প্রত্যয়ী তারা তত জোরেশোরে নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছিল। এই অনিশ্চিত অবস্থাটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে বেশ দ্বান্দ্বিক অবস্থা তৈরি করে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডন বৈঠকে। রাজনৈতিক মহলে মোটামুটি স্বস্তি ফিরে আসে। তবে অন্য দলগুলো বিএনপির এই প্রাধান্যের বিরোধিতা করে। যাই হোক, ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সালে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে এরকম আশ্বাসের পর রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটে। সেই ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্টের এই ঘোষণা এসেছে। এই ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো যে সংশয় ও সন্দেহে ভুগছিলেন তার অবসান ঘটে। কিন্তু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দল জুলাই ঘোষণা এবং নির্বাচনের তারিখ নিয়ে অস্বস্তির কথা বলেছে। তবে কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচন নাকচ করা বা প্রতিরোধের কথা বলেনি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে গুজব ছিল, ঘোষিত সময়সীমার বিপক্ষে অবস্থান নেবে ডান-বাম রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু অসম্পূর্ণতা, অগ্রহণযোগ্যতা ও অসহযোগিতার কথা উচ্চারিত হলেও প্রত্যাখ্যাত হয়নি ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনের দিন-ক্ষণ।

আগেই বলা হয়েছে- বিএনপি স্বস্তির মধ্যে ছিল। এই ঘোষণা দুটোর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস আরো দৃঢ়তর হবে- এটিই স্বাভাবিক। নির্বাচন ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে, বিএনপি তা স্বাগত জানায়। আমরা বিশ্বাস করি, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবিকতা, সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি নতুন, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি তৈরি হবে। নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বৈঠকে এই সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে গণতন্ত্রের উত্তরণের পথ সুগম করবে।

অপরদিকে, জামায়াতে ইসলামীর প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচনের দিন-ক্ষণকে স্বাগত জানানো হলেও জুলাই ঘোষণাকে তারা অসম্পূর্ণ ও একপেশে মনে করেন। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা: আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দাবি করেন, জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা লক্ষ করছি, নির্বাচনের উপযুক্ত যে পরিবেশ থাকার কথা ছিল তা সরকার এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। এ জন্য প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত টাইমলাইন অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তার আইনি ভিত্তি দিতে হবে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পীর সাহেব চরমোনাই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রে ’৭১, ’৭৫-এর সাত নভেম্বর ও নব্বইয়ের আন্দোলনসহ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হলেও আমাদের স্বাধীনতার প্রথম অধ্যায় ৪৭ এবং পতিত ফ্যাসিস্ট আমলের সবচেয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ড শাপলা হত্যাকাণ্ড, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও আলেম-উলামাদের প্রতি নির্যাতন-নিপীড়নের কথা উল্লেখ না করে ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ অংশ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন মনে করে, এতে ইতিহাসের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। এ বিষয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, সংস্কারের বিষয়ে আমাদের একটি জোরালো অবস্থান ছিল। সেটি হলো- জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পরই তা বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, আগামী সংসদ সেটি বাস্তবায়ন করবে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কারের জন-আকাক্সক্ষা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। জুলাই সনদ এবং নির্বাচন সম্পর্কে গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বাম ধারার প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। তবে জুলাই সনদ ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সিপিবি, বাসদসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা উপস্থিত ছিলেন না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে জন-আকাক্সক্ষার কিছু বিষয় ‘অনুপস্থিত’ থাকলেও, তা স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে দলের এই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে চলমান রাষ্ট্রসংস্কার উদ্যোগগুলো দৃশ্যমান করার বিষয়টি সরকারকে ফের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।

বাংলাদেশের মতো শতধাবিভক্ত ও রাজনৈতিক ঝগড়ায় নিত্যনিয়োজিত নেতৃত্বকে একটি সমন্বিত ও সম্মিলিত ধারায় একত্রীকরণ একটি সুকঠিন কাজ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ যে, তারা যতটা সম্ভব ‘বিরোধের মধ্যে ঐক্য’ নিশ্চিত করতে পেরেছেন। জুলাই ঘোষণা সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় কিছু অস্বস্তি লক্ষ করা গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি আগের মতো এসব রাজনৈতিক দলের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে মতামত জেনে নিত, তাহলে অদৃশ্যমান বিভেদটি দৃশ্যমান হতো না। তবে নাগরিক সাধারণ জুলাই ঘোষণার বাস্তবায়ন, জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে নির্ধারিত সংস্কার, সর্বোপরি নির্বাচনের শতভাগ নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তিনটি উপায়ে নাগরিক সাধারণের এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান করা যায়। প্রথমত, সব রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বাক্ষরে জাতীয় সনদ প্রণয়ন। দ্বিতীয়ত অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের স্বীকৃত সংশোধনীর প্রকাশ ঘটানো যায়। তৃতীয়ত রাষ্ট্রপতি তথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আইনানুগ ঘোষণাপত্র (Legal Frame Order)-এর মাধ্যমে সংস্কারকার্যক্রম এবং প্রশাসনিক দায়-দায়িত্বের ঘোষণা দেয়া যায়।

লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও

রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]