বাংলাদেশের নাটক ও জন-আকাঙ্ক্ষা

নাটক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই নাটক সমাজের রাজনৈতিক, নৈতিক ও মানবিক চেতনার বাহন হিসেবে কাজ করেছে।

মুন্সী রফিকুল ইসলাম

নাটক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই নাটক সমাজের রাজনৈতিক, নৈতিক ও মানবিক চেতনার বাহন হিসেবে কাজ করেছে। নাটকের মঞ্চে যেমন- প্রেম, প্রতিবাদ ও করুণার গল্প ফুটে উঠেছে, তেমনি সেখানে সময়ের রাজনীতি, ক্ষমতার দ্ব›দ্ব ও আদর্শিক সংগ্রামের প্রতিচ্ছবিও প্রকাশ পেয়েছে। এক অর্থে, বাংলাদেশের নাটক ছিল রাজনৈতিক আয়না, যেখানে সমাজের মূল্যবোধ ও মানসিকতার প্রতিফলন ঘটত। তবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মঞ্চগুলো জন-আকাঙ্ক্ষা ধারণের চেয়ে, বাম ও ভারতীয় আধিপত্যবাদী বয়ান প্রচারের পাশাপাশি রাজনৈতিক ঘৃণা ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করেছে।

নাটকের উৎপত্তি প্রাচীন গ্রিসে, যেখানে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে দেবতা ডায়োনিসাসকে ঘিরে উৎসবের অংশ হিসেবে প্রতিযোগিতামূলক ট্র্যাজেডি, কমেডি ও স্যাটায়ার মঞ্চস্থ হতো। বাংলা নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন ১৮৩১ সালে এবং প্রথম মৌলিক নাটক ‘ভদ্রার্জুন’ প্রকাশিত হয় ১৮৫২ সালে। বাংলার ইতিহাসে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রথম নাটক হিসেবে ‘নীলদর্পণ’ বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দীনবন্ধু মিত্র রচিত নাটকটি ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয়। এটি ব্রিটিশ শাসনামলে ও বাংলার কৃষকদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করে।

মুনীর চৌধুরী রচিত ‘কবর’ নাটকটি ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এতে বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কবরস্থানের নির্জনতায় লাশ গুমের মতো ঘৃণ্য রাজনীতিকে তুলে ধরা হয়। নাটকটি ১৯৫৩ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজনৈতিক বন্দীরা প্রথম মঞ্চস্থ করে। স্বাধীনতার পর ‘বর্ণচোর’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’, ‘এম এল সোনার বাংলা’ কিছুটা জন-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে। নব্বইয়ের পর বিশেষত মঞ্চনাটক জাতি গঠনের চেয়ে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজনের কৌশলী উপাদানে পরিণত হয়।

সে সময় থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমশ জটিল রূপ নিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই নাট্যকাররা সমাজবাস্তবতা তুলে ধরে আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটাবেন, এমনটিই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু সাংস্কৃতিক অঙ্গন, বিশেষত মঞ্চগুলো কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, প্রায় জনবিচ্ছিন্ন সস্তা বিনোদনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ঘৃণা ছড়ানোর উপাদানে পরিণত হয়। পোশাকসহ সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানকে হেয় করে এক নতুন বয়ান তৈরি করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধীদের চিহ্নিত করতে গিয়ে তাদের মুখে দাড়ি এবং মাথায় টুপি পরিয়ে দেয়া হয়; যা ইতিহাসের বিপরীত।

সমাজে যখন মতের বৈচিত্র্য থাকে, তখন শিল্প তার প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন মতের ভিন্নতা রূপ নেয় দমন বা একচেটিয়া দখলের সংস্কৃতিতে। ২০০৯-২৪ মেয়াদে এই দখল ছিল রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট। তাই, এ সময়ে শাসকের অত্যাচার, গুম-খুন, ভোট ডাকাতি, ব্যাংক লুট, অর্থপাচারের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারেনি আমাদের মঞ্চগুলো; উপহার দিতে পারেনি ‘নীলদর্পণ’ বা ‘কবর’-এর মতো কালজয়ী কোনো নাটক।

নাটক শুধুই বিনোদনের জন্য নয়। এটি রাজনৈতিক সচেতনতা গঠনের এক শক্তিশালী মাধ্যম। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে দেশের মফস্বল পর্যন্ত মঞ্চ নাটক ছিল প্রতিবাদের ভাষা। মঞ্চকর্মীরা তা দিয়ে স্বৈরাচারী ও সামরিক শাসন, সেন্সরশিপ ও রাজনৈতিক দমননীতির বিরুদ্ধে জনমানসে প্রতিরোধের বীজ বপন করেছিলেন। তবে প্রযুক্তির প্রসার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তার এবং বাণিজ্যিক বিনোদনের প্রভাবে সেই ঐতিহ্য কিছুটা ছায়াচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তবুও তরুণ প্রজন্মের কাছে নাটক এখনো এক প্রেরণার উৎস- যেখানে তারা নিজেদের ভাবনা, পরিচয় ও পরিবর্তনের স্বপ্ন খুঁজে পায়।

বর্তমান সময়ের নাট্যধারায় রাজনৈতিক প্রভাব অনেক গভীরভাবে প্রবেশ করেছে। কোনো কোনো সময় নাটক হয়ে উঠেছে দলীয় প্রচারণার বাহন, আবার কখনো তা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। এর ফলে দর্শকও অনেক সময় বিভ্রান্ত- কোনটি শিল্প, আর কোনটি কৌশলগত মতাদর্শ, তা বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই ধোঁয়াশার মধ্যেই তরুণ নাট্যকার ও নাট্যকর্মীদের জন্য নতুন দায়িত্ব তৈরি হয়েছে। নাট্যশিল্পকে যেন আবার মানুষের কণ্ঠে ফিরিয়ে আনা যায়, রাজনীতির পুতুলখেলা থেকে মুক্ত করা যায়। নাটকের মঞ্চে ফিরে আসুক মুক্ত বিতর্ক, যুক্তির সৌন্দর্য ও ভিন্নমতের সহাবস্থান।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তরুণ সমাজ নতুনভাবে সক্রিয় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃতি সংসদ এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তারা নাটককে ব্যবহার করছে চিন্তার হাতিয়ার হিসেবে। এই প্রজন্মের কাছে নাটক কেবল পাঠ্যসূচির অংশ নয়; বরং এক ধরনের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যেখানে স্বাধীন চিন্তা, মানবিকতা ও গণতন্ত্রের ধারণা বিকশিত হতে পারে। সত্যিকারের রাজনীতি মানে কেবল দলীয় প্রতিদ্ব›িদ্বতা নয়; এটি হলো ন্যায়নীতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য লালন এবং স্বপ্ন তৈরির সংস্কৃতি। আর নাটক সেই সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী, মানবিক ও প্রাণবন্ত প্রকাশভঙ্গি।

তরুণদের জন্য সবচেয়ে বড় করণীয় হলো- নাট্যচর্চায় মূল্যবোধের পুনর্গঠন করা, যেখানে না থাকবে অন্ধ অনুকরণ, না থাকবে ঘৃণা বা বিভাজনের রাজনীতি। তাদের উচিত, নাটককে সমাজ পরিবর্তনের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা; যাতে মানুষ আবার বিশ্বাস করতে পারে, সংস্কৃতি কেবল বিনোদন নয়- এটি ন্যায়ের পথে অগ্রযাত্রার সহগামী। তারা যদি স্থানীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি, লোককথা, ঐতিহ্য ও প্রযুক্তিকে একত্রে যুক্ত করতে পারে, তবে বাংলাদেশে এক ‘নতুন থিয়েটার বিপ্লব’ শুরু হতে পারে, যেখানে মঞ্চ আর স্ক্রিনের পার্থক্য মুছে যাবে; কিন্তু সত্যের অনুসন্ধান অটুট থাকবে।

শিল্পচর্চা কখনো নিছক রাজনৈতিক প্রচারণা হতে পারে না। নাটক যদি কেবল কোনো মতবাদের মুখপাত্র হয়, তবে তা প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু যখন নাটক মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, সমাজের দুঃখ-স্বপ্ন-সংগ্রামকে জীবন্ত করে তোলে, তখন সেটি রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে যায়। বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, সাংস্কৃতিক জাগরণই রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রথম ধাপ। তাই তরুণদের দায়িত্ব হবে নাটকের মঞ্চকে পুনরায় জনগণের মঞ্চে রূপান্তরিত করা, যেখানে রাজনীতির শত্রুতা নয়; বরং মানবতার সংলাপ চলবে, জ্ঞানচর্চার বিকল্প মাধ্যম হবে। এই চর্চার মাধ্যমে নতুন থিয়েটার বিপ্লব না ঘটলে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রতি উপহাসের হীন অপচর্চা না রুখতে পারলে, সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ আবারো মাঠ দখল করতে পারে।

নাটক যেমন মানুষকে হাসায়-কাঁদায়, তেমনি ভাবায়ও। বাংলাদেশের রাজনীতি যদি কখনো নাটক হয়ে থাকে, তবে এখন নাটককেই রাজনীতির আয়না বানানোর সময় এসেছে। তরুণদের হাতে এখন যে মঞ্চ, সেখানে চিত্রনাট্য হবে ন্যায়ের, সংলাপ হবে মুক্তির, আর তার দর্শক হবে পুরো জাতি। বখতিয়ার খিলজি থেকে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, নবাব সলিমুল্লাহ থেকে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী থেকে মওলানা ভাসানী, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ থেকে নূর হোসেন, চৌধুরী আলম থেকে ইলিয়াস আলী, আবরার ফাহাদ থেকে আবু সাঈদ, মীর মুগ্ধ থেকে ইয়ামিন, গণহত্যা থেকে খুন-গুম, আয়নাঘর থেকে গণরুম, অত্যাচার থেকে অর্থপাচার- ইতিহাসের সব চরিত্র-স্থান-চর্চা-ঘটনা স্বমহিমায় উঠে আসুক নাটকের মঞ্চে! শুধু খেয়াল রাখতে হবে, পর্দা নামার আগে যেন আলো নিভে না যায়, কারণ শেষ সংলাপটা এখনো বাকি!

লেখক : অনুবাদক, কেন্দ্রীয় বার্তা সংস্থা, বাংলাদেশ বেতার