হিন্দুত্ববাদ বনাম হিন্দুত্ববাদ

এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের সরকার ক্ষমতায় ছিল। তাদের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে তারা প্রশ্রয় দেয়নি।

আমাদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু একবার বলেছিলেন, বিজেপি-আরএসএসকে আমি চিনি। ওদের হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা নিয়ে আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত। কিন্তু যাদের ধর্মনিরপেক্ষ দল বলছি, তাদের মধ্যে কংগ্রেস নরম সাম্প্রদায়িক, বামপন্থী বা কমিউনিস্টরা সূ² সাম্প্রদায়িক, তৃণমূল নৌটঙ্কির খেলা।

আমাদের সেই বন্ধু নেহাত মন্দ বলেননি; কিন্তু তার ফাঁকেও কিছু কথা থেকে যায়। গান্ধী পরিবার বা নেহরু পরিবার ভারতের সংখ্যালঘুদের প্রতি বিশেষ করে মুসলিম সমাজের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। ১৯৪৭ সালে নেহরুর মন্ত্রিসভাতে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ঠাঁই পেয়েছিলেন। পরে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের সেই হিন্দু মহাসভা ছিল আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা। দেশভাগের আগে ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত ভারতের অবিভক্ত বঙ্গে কৃষক প্রজাপার্টির নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে ১৯৪০ সালে মন্ত্রিসভা গড়েছিলেন। ইতিহাসে যেটিকে বলে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা। আর কি হক সাহেব রাজনীতিতে সেভাবে উঠতে পেরেছিলেন এই ঘটনায়?

শ্যামাপ্রসাদ জাতীয় কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করার স্বপ্ন দেখালেন। হিন্দু মহাসভা থেকে জনসঙ্ঘ গড়ে সেটিই হলো আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা। জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম নেতা ও পরবর্তীতে ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল আরএসএসের সাথে দারুণ সম্পর্ক গড়েন। কিন্তু পরে আরএসএসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন। কংগ্রেসকে বলেছিলেন আরএসএসের ভয়ঙ্করতার কথা। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠেছিল মোরারজি দেশাইয়ের জনতা দল। যদিও এর কারিগর হলেন জননেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ। কিন্তু সিআইএর কথা শুনে মোরারজি দেশাই জনসঙ্ঘের নেতা অটল বিহারি বাজপেয়িকে বিদেশ মন্ত্রী করার পরিণতি কিন্তু হাড়ে হাড়ে দিতে হয়েছিল তাকে। জনতা ভেঙে গেল। ওই দলের চৌধুরী চরন সিং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হলেন। চরন সিংও কয়েক মাস টিকে ছিলেন। ১৯৮০ সালে ভারতের অন্যতম ডায়নামিক নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওভারকাম করেছিলেন; যার পেছনে ছিল তৎকালীন সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির হাত। পরবর্তীতে একেবারে জনতা দল ধাপে ধাপে ভেঙেছে। জনতা দল (সেকুলার), জনতা দল (ইউনাইটেড), মুলায়েম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি, বিহারের লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি), রামবিলাস পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি, ওড়িশ্যায় বিজু জনতা দল- এভাবে জনতা দল কার্যত টুকরো টুকরো হয়েছে।

১৯৮৯ সালে কংগ্রেসকে জানি দুশমন ভাবতে গিয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের জনতা দল বাইরে থেকে বিজেপি ও বামপন্থীদের সমর্থনে সরকার করলে বিজেপির আসল চরিত্র ফুটে উঠে। তারা ৮৮টি আসন পেয়ে ইস্যু করল বাবরি মসজিদ-রামমন্দির। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং প্রধানমন্ত্রিত্ব খোয়ালেন। প্রধানমন্ত্রী হলেন জনতা দলের চন্দ্রশেখর কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে। জনতা দলের করুণ অবস্থা। ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাজপেয়িকে নিয়ে কলকাতার ব্রিগেডে সমাবেশ করে জনতা দল। যেখানে সিপিআইসহ (এম) বাম দলগুলোর নেতারাও ছিলেন।

কথাগুলো এ কারণে বললাম, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সিদ্ধান্ত বিজেপি-আরএসএসের শক্তি বাড়িয়েছে। এটি আমাদের কাছে এক করুণ ট্র্যাজেডি। ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে তাদের সুপ্ত হিন্দুত্বাদ বিজেপি-আরএসএসকে প্রসারিত করেছে। লালুপ্রসাদ যাদব বিজেপির রামরথ যাত্রায় বিহারের সমস্তিপুরে লালকৃষ্ণ আদভানিকে গ্রেফতার করার সাহস দেখান। অন্য দিকে লখনৌয়ে অটলবিহারি বাজপেয়িকে গ্রেফতার করে সাহস দেখিয়েছেন মুলায়েম সিং যাদব। তারপরে ভারত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অনেক কিছু ঘটে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে দুর্বল করার জন্য আরএসএস-বিজেপি মমতাকে নিয়ে তৈরি করল তৃণমূল-কংগ্রেস। তৃণমূলের হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির খাতা খোলা শুরু। একসময় অটলবিহারির আমলে বিজেপি সরকারের রেলমন্ত্রী, দফতরহীন মন্ত্রী ও কয়লামন্ত্রী হন মমতা ব্যানার্জি। মমতা নিজে বলেছিলেন, বিজেপিকে সাথে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বামফ্রন্ট উৎখাত করব। মমতাকে আরএসএস-বিজেপি বলত আরএসএসের দুর্গা। কিন্তু ২০১১ সালে মুসলিম ভোটকে তুরুপের তাস করতে নামেমাত্র বিজেপির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। সে সময় সাচার রিপোর্ট, কলকাতার পার্কসার্কাস তিলজলা লেনে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার রেজওয়ানুর রহমানের রহস্য মত্যু ও ৩৪ বছরের বাম সরকারের পরিবর্তন ঘটাতে মুসলিমরা সেদিন তৃণমূলের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এটি ছিল মমতার এক ধরনের ছলনা। মুসলিম সমর্থন ধরে রাখতে মমতা ব্যানার্জি ইনশা আল্লাহ-মাশা আল্লাহ-আসসালামু আলাইকুম- শব্দগুলো ব্যবহার করে চূড়ান্ত অভিনয় করেন। কলকাতাতে মোদির সাথে কুস্তি আর দিল্লিতে দোস্তি।

শুধু কি তাই, কলকাতার রেড রোডে খিলাফত কমিটির ডাকা ঈদের নামাজে একেবারে ভাইপোকে সাথে নিয়ে মুসলিম উন্নয়নের গালভরা ফিরিস্তি। ২০১৬ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি শূন্য থেকে তিনটি আসন পেল। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এক লাফে ১৮টি আসনে জিতল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মনে হচ্ছিল বিজেপি ক্ষমতায় চলে আসবে। কিন্তু তারা ৭৭-এসে আটকে গেল। সিপিআই (এম) তথা বামফ্রন্ট ‘আগে রাম পরে বাম’ করতে গিয়ে নিজেদের ২০১১ সালে পাওয়া ৪৩ শতাংশ ভোট খুইয়ে ৫ শতাংশে ঠেকাল। এর ফলে বিজেপি-তৃণমূলের বাইনারি পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গাদাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করল।

বাম-কংগ্রেস কার্যত মানুষের কাছে অচ্ছুত। মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কার্যত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কার্যত ক্ষয় করে দিলো। তৃণমূল-বিজেপি ভাবতে লাগল, তারা পরস্পর বিরোধী। মুসলিমরা ভেবে নিলো, বামফ্রন্টের অবস্থা দুর্বল। তাই তারা অন্য কোনো বিকল্প বা উপায় না পেয়ে তৃণমূলকে ভোট দিতে বাধ্য হন। মমতার বৈশিষ্ট্য তারা ধরে ফেলেছিলেন। কিন্তু নিরুপায়। মুসলিমরা নিরুপায় বলে বিভিন্ন জায়গায় বিজেপির রামনবমীর মিছিলের পাল্টা তৃণমূলের রামনবমীর মিছিল। আর এভাবে হাওড়ার ধুলাগড়ে দীর্ঘদিন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দাঙ্গা শিবপুর, আসানসোল, মেদিনিপুর, চন্দননগর, নৈহাটি, বারুইপুর, মেটিয়াবুরুজ, বেলডাঙ্গা, ধুলিয়া-অরঙ্গাবাদ। আসানসোলে এক ইমামের ছেলে খুন হলে পুলিশ পারেনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। শেষে ইমাম সাহেব যেভাবে রাস্তায় নেমে মানুষের সকরুণ আবেদন, আমার একটি ছেলের বদলে আর আমি লাশ দেখতে চাই না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ব্যাপক সাড়া দেন।

একটি রামনবমীর মিছিলের বদলে তৃণমূলের পাল্টা রামনবমীর মিছিল মানে তা হিন্দুত্ববাদ বা পাল্টা হিন্দুত্ববাদ উজ্জীবিত করা। একটি বাবরি মসজিদের জায়গায় পাল্টা দিঘাতে তৃণমূলের জগন্নাথ মন্দির মানে তো হিন্দুত্ববাদের প্রতিযোগিতা। দুর্গা-উদ্যান বা পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে আরো একাটি মন্দির মানে তো হিন্দুত্ববাদ বনাম হিন্দুত্ববাদের প্রতিযোগিতা।

কেন তৃণমূল পরিচালিত কলকাতা করপোরেশন বিজেপি, হিন্দু মহাসভা আরএসএস নেতা শ্যামাপ্রসাদের জন্মদিন পালন করে? রাজ্যের কোষাগার থেকে অর্থ খরচ করে তৃণমূল সরকার রেড রোডে পূজার কার্নিভাল করে? কেন পূজার সময় কয়েক লাখ ক্লাবকে লক্ষাধিক টাকা অনুদান দেয় তৃণমূল সরকার? ধর্ম ক্ষেত্রে তো রাষ্ট্রীয় আনুগত্য ও হস্তক্ষেপ একেবারে ভারতের সংবিধানবিরোধী। বিজেপি তো করছেই। তাহলে তৃণমূল করবে কেন?

এ দিকে তৃণমূলের প্রতি রাগ ঝাড়তে গিয়ে সিপিআই (এম) বামেদের ভোটব্যাংক চলে গেছে বিজেপির দিকে। ২০১১ সালের ৪৩ শতাংশ ভোট এসে ঠেকেছে ৫ শতাংশে। ‘আগে রাম তারপরে বাম’ করতে গিয়ে বামেরা নিজেদের নিজেরা কুড়াল মেরেছে। আজ ত্রিপুরাতে বামেদের বিজেপি বান্ডিল করে দিয়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা বুঝে গেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা কী জিনিস। তৃণমূলের সাথে বিজেপির যে আগের সম্পর্ক এখনো অটুট তা তো অনেকখানি বুঝে গেছেন। মুসলিমরা বুঝে গেছেন, তৃণমূল কতখানি দুর্নীতিগ্রস্ত দল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষাসহ কী দুর্নীতি? তৃণমূলের চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, পাচার-কেলেঙ্কারি, কয়লা-কেলেঙ্কারি, লিপ্স অ্যান্ড বাউন্স-কেলেঙ্কারিতে মমতার নিজের ভাইপোসহ তৃণমূলের রাঘববোয়ালরা যুক্ত। এগুলো থেকে রেহাই পেতে গেলে আরএসএস সুপ্রিমো মোহন ভাগবত তার ভরসা। মোদি তার ভরসা। তাই হিন্দুত্ববাদ বনাম হিন্দুত্ববাদ মমতার প্রধান অস্ত্র।

এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের সরকার ক্ষমতায় ছিল। তাদের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে তারা প্রশ্রয় দেয়নি। আজ তৃণমূলের জমানায় আরএসএস তো কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গে কিলবিল করছে। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের জমানায় মুসলিমদের চাকরির হালহকিকত করুণ কেন? যে রাজ্যে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি মুসলিম। সেখানে সূ² হিন্দুত্ববাদ কাজ করেছে। হিন্দুত্ববাদ বনাম হিন্দুত্ববাদ এক বিপজ্জনক খেলা।

লেখক : পশ্চিমবঙ্গের কবি ও সাংবাদিক