অস্থির চিত্ত, চিত্তের অস্থিরতা

আমরা এখনো মনে মনে অন্যের অনিষ্ট কামনা করছি কি না, কারো কারো দাবি ও অধিকার হরণের মানসিকতায় আছি কি না, প্রবঞ্চনা-প্রতারণার পথ খুঁজে ফিরছি কি না, এসব বিষয়ে আত্মজিজ্ঞাসায় আনত হলে, আত্মানুসন্ধানে ব্যাপৃত হলেই মিলবে প্রভু নিরঞ্জনের ক্ষমা, ভালোবাসা, প্রেমদর্শন ও অস্থিরতার বিপদ থেকে উদ্ধার।

সাপখালির আরজান মণ্ডল ইদানীং বেশ মনোকষ্টে আছেন। তার সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো মনে হচ্ছে। চার দিকে দুশ্চিন্তার নানা কারণ ও উপলক্ষ কেমন যেন বেপরোয়া। আরজান ছোটবেলায় দেখেছে খাল-বিল, জলাশয়, জমি, নদীর প্রবাহ, দেশী মাছ, ফল-ফসলের মধ্যে সাধ আহ্লাদ আস্বাদনের একটি ধারাবাহিক অবস্থায় ছিল। মনে হতো ভোরের বাতাস ছিল নির্মল, প্রশান্তিদায়ক, ভোররাতের ইবাদত ও ক্লাসের পড়াশোনায় একধরনের মনোযোগ মনোসংযোগ ছিল অবারিত। যেমন কবি শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা তুমি কবিতায় উল্লেখ ছিল- ‘পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন’, ফররুখ আহমদের ‘রাতভর ডাহুকের ডাক’, ‘নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা’ কিংবা ‘রাত পোহাবার কত দেরি, পাঞ্জেরী? এসব কাব্যকথা তার চেতনায় আলোড়ন তুলত। আরজান এখনো কান পেতে শুনতে পায় কবি আল মাহমুদের ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে, হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে’র কাব্য-কাহিনী, কিংবা ‘নদী ঝলমল, সুনীল সাগরের কাছে’ সুকণ্ঠী গায়িকার ‘অনেক ঋণ আছে’ এসব গীতিকবিতা তার মনে অনুরণন তুলত।

কিন্তু আজকাল আরজান বড় বেচাইন অবস্থায় পাচ্ছে নিজেকে। বাইরের পরিবেশ তার মনের শান্ত সমাহিত পুকুরে ঢিল ছুড়ছে। অনেক কিছুই ভালোভাবে ঠাহর হচ্ছে না তার। বয়স বেড়েছে ঠিকই প্রযুক্তির বদৌলতে অনেক কঠিন কাজ সহজ হয়েছে। কিন্তু তার মন সে সহজীকরণের সাহায্যে সংযোগ, সখ্য পাতাতে পারছে কি? ‘পিন’ ও ’পাসওয়ার্ড’ মনে রাখতে গিয়ে হয়রান হচ্ছে সে। পিন, পাসওয়ার্ড দিয়ে তার সব সুবিধার দহলিজে এমনকি খাস কামরায় ঢুকতেও কষ্ট হচ্ছে। পিন, পাসওয়ার্ড নাকি রক্ষাকবচ। আগে স্মৃতিশক্তি সবল ছিল, পাসওয়ার্ড লাগত না। সবই সাধ্যমতো ব্যবহার চলত। এখন পাসওয়ার্ড, শোনা যায় একেক জনের একেক কাজের জন্য একেকটি। মনোযোগ না দিলে পাসওয়ার্ড হারিয়ে গেলে বেহাত হয়ে যেতে পারে তার তাবৎ তথ্য। হ্যাক হয়ে যাচ্ছে পুরো অ্যাকাউন্ট। সব কন্টাক্ট পারসন পাচ্ছেন টাকা পাঠানোর অনুরোধ। কী মুশকিল! পুঁজিবাদী তস্কর এআই, ভার্র্চুয়াল সংস্কৃতি তাকে নানাভাবে বেপথু করার সুযোগ পাচ্ছে। আগে ধর্মগ্রন্থের বাণী, মনীষীদের কথা সবার মনে সাহস ও প্রেরণার জোয়ার জাগাত, নতুন পথ বাতলাতে সাহায্য করত। এখন প্রত্যাশার পাসওয়ার্ড ছাড়া মনের তালা খুলছে না। আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ এখন এত বেশি জটিল জাগতিকের পাল্লায় পড়ছে যে, তার রূহানি শক্তি ভোঁতা হতে চলেছে। পরমাত্মার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিভ্রান্তিতে পড়ছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ও কামে বহুত্ববাদের ধারণা হুড়মুড় করে তার একাত্মবাদের ঘরে ঢুকে নাস্তানাবুদ করে দিয়ে যাচ্ছে তার ভালো-মন্দ ও শ্রেয় জ্ঞানচর্চাকে। বাসায়, বারান্দায়, করিডোরে, কর্নারে, রাস্তায় কেন এত সিসি ক্যামেরা, এতে সন্ত্রাসী ও চোর-ডাকাতদের পক্ষ থেকে আপত্তি উঠছে। তাদের আদি ব্যবসায় বাদ সাধছে এই সিসি ক্যামেরা।

আরজান এখন আর কুরআনের আয়াত, মহামনীষীদের কথা যত্রতত্র উচ্চারণ করতে পারে না। পাছে পচা সমাজ তাকে প্রাচীনপন্থীর অপবাদ দিয়ে একটি বিব্রতকর পরিচয়ের ট্যাগ লাগিয়ে না দেয়! কোথা থেকে এসেছে সে জানে না, ঘুণে ধরা নাস্তিক নিয়মে মৃত ব্যক্তির জন্য নীরবে এক মিনিট দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানায়। নিষ্ফলা এই প্রথার পরিবর্তে এক মিনিটে দাঁড়িয়ে যার যার ধর্মমতে মৃত ব্যক্তির জন্য প্রার্থনা ও দোয়া দরূদ পড়ে তার রূহের মাগফিরাত কামনা করা যায় এবং এর ফলে নিজেরও মৃত্যু সম্পর্কে একটি স্বাভাবিক উপলব্ধি জাগা কল্যাণবহ হতে পারে।

আরজান লক্ষ করেছে অসাম্প্রদায়িকতার জিগির তারাই তুলছে যারা বেশি সাম্প্রদায়িক আচরণে অভ্যস্ত। এখন সে কেন যেন ভোরের বাতাস, পাখপাখালির কূজন, নদীর খল খল, বৃষ্টির টাপুর-টুপুর শব্দের ঝনঝনানিতে মন দিতে পারে না। অন্যের স্বার্থ দেখতে গিয়ে নিজের স্বার্থ, আচার-আচরণ বেঁধে রাখতে পারছে না। যারা তার বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের ক্ষেতের ভেতর ঢুকছে, সে তাদের না পারছে ঠেকাতে, না পারছে নিজের বেড়া টপকিয়ে তাদের সীমানায় ঢোকার সাহস। পাশের ঘর থেকে যখন তার গোছানো সংসার অগোছালো, তার সমৃদ্ধির সুযোগ ও সম্ভাবনা কচুকাটা করা হচ্ছে, নিজের ঘরে তখন সে বহুত্ববাদ ও আপস করার বাণী প্রবাহের চেষ্টা চলছে।

এখন আরজানের চিন্তাচেতনার উঠানে, কর্তব্যের ময়দানে নানান সংশয়-সন্দেহ, দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনার আশঙ্কা আশকারা পেয়েই চলেছে। শয়তানের স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানই প্ল্যানিং কমিশনের অনুমোদন পাচ্ছে, সদাচার, সুশাসন, নীতিনির্ভরতার ভাবভাবনারা সেখানে পাত্তা পাচ্ছে না। অন্যায়-অনিয়ম যারা ঠেকাবে তারা হীনবল হয়ে পড়ছে। ভালো-মন্দ জ্ঞানের বোধ বিশ্বাস দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং জুলাই আন্দোলনে রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সক্রিয় ছিল। পাঁচ দশকের বেশি সময় পার করেও গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তিতে দাঁড়িয়েছে বলার সময় এখনো আসেনি। সহনশীলতা, ধৈর্যশীলতা, সবার জন্য আইনের সমপ্রয়োগ নিয়ে এখনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ মেলে। সঙ্ঘাত-সহিংসতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে এখনো বেরিয়ে আসা যায়নি। জনগণ এখনো রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করে থাকেন। নাগরিকদের আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধ চেতনা গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন উদ্বেগ ও শঙ্কামুক্ত, ঐকমত্যের বলীয়ান শক্তির। প্রয়োজন আস্থাবান, সুশাসন, সততা ও জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব।

স্বাধীনতা অর্জনে বেশি প্রয়োজন সংগ্রাম ও শক্তির। আর স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন প্রযুক্তি, কৌশল, ঐক্য ও ন্যায়বোধ। এ ছাড়া বিপ্লবের অর্জন রক্ষা করতে জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা, সুস্বাস্থ্য ও সৎ বিবেচনা কাজে লাগানো একান্ত অপরিহার্য। জনগণ যথেষ্ট সচেতন ও সঙ্ঘবদ্ধ না হলে স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য স্বাধীনতার মর্যাদা দিতে হয় এবং সদা সতর্ক থাকতে হয়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের এই মৌল চেতনায় সবারই অনুপ্রাণিত হওয়ার বিকল্প নেই।

যদিও অনেকসময় এটিও দেখা গেছে, রাজনীতি অর্থনীতিকে শাসিয়েছে, নিয়ন্ত্রণ করেছে; আবার অর্থনীতি রাজনীতিকে অবজ্ঞার অবয়বে নিয়ে যেতে চেয়েছে। এ কথা ঠিক বহমান বর্তমান বিশ্বে অর্থনীতি ক্রমেই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে। কেননা, মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে শুরু করে, সব পর্যায়ে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বিনোদন, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান সবকিছুতেই নীতিনির্ধারণে অর্থ নিয়ামক ভূমিকায়। সিদ্ধান্ত হয় আর্থিক প্রভাবের, সক্ষম সম্ভাবনার নিরিখে। রাজনীতি নীতিনির্ধারণ করে অর্থনৈতিক জীবনযাপনকে জাবাবদিহি, সুশৃঙ্খল, সুশোভন, সুবিন্যস্ত করবে- এটিই ঠিক; কিন্তু নীতিনির্ধারক যদি নিজেই ভক্ষক হয়ে অর্থনৈতিক টানাপড়েন সৃষ্টির কারণ হয়, তখন আমজনতার অর্থনৈতিক জীবনযাপন পোষিত (ভধপরষরঃধঃবফ, ংঁঢ়ঢ়ড়ৎঃবফ) হয় না। পরিবর্তে তাদেরকে নিজস্ব তাগিদে ও প্রয়োজনে নিজস্ব উপায়ে উপকরণ সংগ্রহে ব্যাপৃত হতে হয়। আর এভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের এখতিয়ার ও ক্ষমতা খর্ব হয়।

দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচি হবে দলমত নিরপেক্ষভাবে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুযোগ-সুবিধা অধিকার আদান-প্রদান, নীতি-নিয়মকানুন, আইনশৃঙ্খলার বিধানাবলি বলবৎ, প্রয়োগ ও বাস্তবায়িত হবে- এটি সাংবিধানিক সত্য ও প্রথা। দেখতে হবে, যেকোনো পরিবেশেই যেন রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে, নিয়ন্ত্রক ও নিয়ন্ত্রিতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি না হয়।

অস্থিরচিত্ততার যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের নিকেতনে নিজের কর্মকাণ্ডের বোধ-বিশ্বাসের সালতামামি হতে পারে। যেমন নামাজের মধ্যে আল্লাহর সন্দর্শন সাক্ষাৎ (মিরাজ) হয়ে থাকে জানি; কিন্তু তার সাথে সাক্ষাতের প্রটোকল প্রকৃত অর্থে মানি কি? তাহলে নামাজে অমনোযোগিতা আসে কিভাবে? কেন নামাজে যা পড়ছি তার প্রতি মনোযোগ থাকছে না। কেন মনে মনে ভাবনায় কামনায়-বাসনায় বারবার তার নির্দেশনার বরখেলাপ করি? সব দেখেশুনে মনে হয় যেন অভিনয় করে চলেছি। হায় দুর্ভাগ্য! কুরআনে আল্লাহ বলছেন- ‘তোমরা একই অপকর্ম বারবার করো অথচ তোমরা কেতাব পড়ো, অর্থাৎ- জেনেশুনেও তোমরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করো। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো।’ মুনাজাতে বলছি, ‘হে আল্লাহ, আমাকে কামেল ঈমান দাও, সাচ্চা একিন দাও যেন বুঝতে পারি আমার ভালো-মন্দ সবই তোমার ইচ্ছায় হচ্ছে, তোমার ভয়ে ভীত অন্তর দাও, তোমার স্মরণে লিপ্ত জিহ্বা দাও।’ আল্লাহরই শিখিয়ে দেয়া মুনাজাতে এটিও বলছি, ‘হে আল্লাহ যদি আমি বা আমরা ভুল করি তুমি আমাদের ভুলের জন্য পাকড়াও করো না- আমাদের ওপর এমন বোঝা চাপিও না যেমন বোঝা অতীতের ভাইদের ওপর চাপিয়েছিলে, আমি যা বহন করতে পারি এমন বোঝা আমার ওপর দাও’ ইত্যাদি। এ মুনাজাত করছি; কিন্তু বারবার তো একই ভুল করে চলেছি- একই অবাধ্যতা চলছে। তাহলে ওই মুনাজাত কি মনের থেকে বলছি না?

আমরা এখনো মনে মনে অন্যের অনিষ্ট কামনা করছি কি না, কারো কারো দাবি ও অধিকার হরণের মানসিকতায় আছি কি না, প্রবঞ্চনা-প্রতারণার পথ খুঁজে ফিরছি কি না, এসব বিষয়ে আত্মজিজ্ঞাসায় আনত হলে, আত্মানুসন্ধানে ব্যাপৃত হলেই মিলবে প্রভু নিরঞ্জনের ক্ষমা, ভালোবাসা, প্রেমদর্শন ও অস্থিরতার বিপদ থেকে উদ্ধার।

লেখক : অনুচিন্তক