ওয়াহিদুল ইসলাম
বাংলাদেশের আর্থিক সুশাসনের মূলভিত্তি তিনটি- স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জবাবদিহি। এ তিন স্তম্ভ কার্যকর রাখতে হলে অডিট (নিরীক্ষা) ও অ্যাকাউন্টস (হিসাবরক্ষণ) সার্ভিস একই কর্তৃপক্ষ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) অধীনে রাখা সাংবিধানিকভাবে অপরিহার্য। সংবিধানের ১২৮ ও ১৩১ অনুচ্ছেদ স্পষ্টভাবে বলে যে, মহাহিসাব-নিরীক্ষক (সিএজি) তার দায়িত্ব পালনে কোনো বাহ্যিক কর্তৃপক্ষের অধীন নন এবং প্রজাতন্ত্রের হিসাব কীভাবে রক্ষিত হবে, সেটি নির্ধারণের ক্ষমতা কেবল তার। অর্থাৎ- হিসাবরক্ষণ যদি নির্বাহী বিভাগে স্থানান্তরিত হয়, তবে এ সাংবিধানিক স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হবে এবং নিরীক্ষার স্বাধীনতা হারাবে ভিত্তি।
কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো যেমন- ভারত, পাকিস্তান, কানাডা সবখানে অডিট ও হিসাব একই কাঠামোর অধীনে ছিল। কারণ, এভাবে থাকলে আর্থিক তথ্যের প্রবাহ স্বচ্ছ হয়, কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা একত্রে কাজে লাগে এবং ভুল বা অনিয়ম প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা যায়।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় সবচেয়ে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হলো প্রি-অডিট অর্থাৎ- অর্থ খরচের আগে বিলের বৈধতা যাচাই। এটি সক্রিয় নিয়ন্ত্রণ, যা দুর্নীতি ঘটার আগে রোধ করে। অন্যদিকে, পোস্ট-অডিট অর্থাৎ- ব্যয়ের পর নিরীক্ষা খুব সীমিত পরিসরে হয়। ব্যয় হয়ে যাওয়ার পর যদি অনিয়ম ধরা পড়ে, ততক্ষণে অর্থ ফেরত আনা প্রায় অসম্ভব।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি ব্যয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্র পোস্ট-অডিটের বাইরে থেকে যায়। তাই প্রি-অডিট হচ্ছে আর্থিক অনিয়ম ঠেকানোর একমাত্র কার্যকর হাতিয়ার।
যদি হিসাবরক্ষণ নির্বাহী বিভাগের অধীনে চলে যায়, তবে এই প্রি-অডিট ব্যবস্থা বিলুপ্ত হবে। তখন যারা অর্থ খরচের অনুমোদন দেন, তারা বিলের বৈধতা যাচাই করবেন, এটি ‘স্বার্থের সঙ্ঘাত’ তৈরি করবে। এতে আর্থিক দুর্নীতি আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে।
অডিট ও হিসাব সার্ভিস আলাদা করলে নিম্নোক্ত বিপদগুলো দেখা দেবে-
ক. স্বার্থের সঙ্ঘাত ও নির্বাহী প্রভাব : হিসাব যদি অর্থ বিভাগে যায়, তবে বিল তৈরি ও অনুমোদন উভয়ই নির্বাহী বিভাগের হাতে যাবে। এতে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স ব্যবস্থা নষ্ট হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাব বাড়বে। নিরীক্ষকরা আর স্বাধীন থাকবেন না।
খ. প্রশাসনিক ও ক্যাডার বৈষম্য : ইকোনমিক ক্যাডার যেমন প্রশাসন ক্যাডারের সাথে একীভূত হয়েছিল, তেমনি হিসাব সার্ভিসকেও সেই পথে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এতে কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈষম্য, অসন্তোষ ও অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।
গ. পূর্ব অভিজ্ঞতা : ২০১০-১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এমন উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ব্যর্থ হয়। তবু একই প্রস্তাব পুনরায় আনা আস্থাহীনতা তৈরি করে।
ঘ. সংসদীয় তদারকির দুর্বলতা : সিএজি দুর্বল হলে সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিও দুর্বল হবে। সংসদীয় গণতন্ত্রে এটি একটি মৌলিক বিপর্যয়।
৪. জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫-এর প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ : ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য নিয়েছে, তা পূরণে সনদে প্রস্তাব করা হয়েছে সিএজির অধীন অডিট ও হিসাব সার্ভিস পৃথক করে নিরীক্ষকের স্বাধীনতা বাড়ানো হবে।
বাস্তবে, বাংলাদেশের মতো উচ্চ দুর্নীতির ঝুঁকিপূর্ণ দেশে এ পদক্ষেপ বিপরীত ফল দেবে বলে আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সাংবিধানিক স্বাধীনতা হারাবে সিএজি : হিসাবরক্ষণ সিএজির নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে সংবিধানের ১২৮ ও ১৩১ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘটবে।
প্রি-অডিট বিলুপ্ত হবে: অর্থ খরচের আগে যাচাই করার ব্যবস্থা না থাকলে দুর্নীতি আগেভাগে ঠেকানো সম্ভব হবে না।
স্বার্থের সঙ্ঘাত তৈরি হবে : অর্থবিল তৈরির ক্ষমতা ও অনুমোদন এক হাতে গেলে জবাবদিহি বিলীন হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের ক্ষয় : একীভূত সার্ভিস ভেঙে দিলে কর্মকর্তাদের আর্থিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে।
অতএব, সনদের লক্ষ্য পূরণে প্রয়োজন পৃথকীকরণ নয়; বরং সংস্কার ও শক্তিশালী একীভূত কাঠামো।
বাংলাদেশে আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- দুর্নীতি, বিলম্বিত ব্যয় এবং অনিয়ন্ত্রিত প্রকল্প ব্যবস্থাপনা। এ বাস্তবতায় অডিট ও অ্যাকাউন্টস সার্ভিসের একীভূত কাঠামো সংস্কার করে আরো কার্যকর করা জরুরি।
সংস্কারের প্রধান দিকগুলো হতে পারে-
১. ডিজিটাল প্রি-অডিট সিস্টেম চালু করা, যাতে প্রতিটি বিল তাৎক্ষণিকভাবে সিএজি অফিসে যাচাই হয়। ২. সিএজি অফিসকে প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বায়ত্তশাসন দেয়া, যাতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করা যায়। ৩. কর্মকর্তাদের আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ দেয়া, যাতে নিরীক্ষা প্রক্রিয়া দ্রুত ও নির্ভুল হয়। ৪. সিএজির ক্ষমতা ও সম্পদ বাড়ানো, যাতে নিরীক্ষা প্রতিবেদনের পরবর্তী কার্যক্রম নিশ্চিত হয়। ৫. দুর্নীতি মোটাদাগে কম বেতন কাঠামো থেকে উৎসারিত হওয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিততে হলে কম বেতন কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়তে হবে নীতিনির্ধারকদের। ৬. নিয়মিত নৈতিকতার প্রশিক্ষণ কাঠামোবদ্ধ না করলে দুর্নীতি কখনোই দূর হবে না। এভাবে কাঠামো শক্তিশালী করা গেলে জুলাই সনদের মূল লক্ষ্য স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন বাস্তবায়িত হবে, পৃথকীকরণের মাধ্যমে নয়।
উপসংহার : বাংলাদেশের সংবিধান শুধু সিএজির স্বাধীনতাকে নয়; বরং রাষ্ট্রীয় কোষাগারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি রক্ষার গ্যারান্টিও দিয়েছে। এ গ্যারান্টি তখনই কার্যকর, যখন অডিট ও অ্যাকাউন্টস সার্ভিস একীভূত অবস্থায় থাকে। সার্ভিস পৃথক করে হিসাবরক্ষণ নির্বাহী বিভাগের হাতে দিলে দুর্নীতি ও অনিয়ম বাড়বে, রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পাবে এবং রাষ্ট্রের মৌলিক চেক অ্যান্ড ব্যালান্স ভেঙে পড়বে। ‘যিনি আইন বানান তিনিই প্রয়োগ করেন’ বা জুরি ও জুরর ধরনের সমস্যা হতে বাধ্য।
অতএব, বাংলাদেশের আর্থিক সুশাসনের স্বার্থে অডিট ও অ্যাকাউন্টস সার্ভিসকে সিএজির অধীনে একীভূত রাখা সাংবিধানিক, বাস্তব ও নৈতিকভাবে অপরিহার্য। পৃথকীকরণের পথে না গিয়ে এই একীভূত কাঠামোকে নৈতিকভাবে শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করাই ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর প্রকৃত চেতনা বাস্তবে রূপ দেয়ার সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর উপায় বলে আমরা মনে করি।



