১. উপনিবেশ প্রথমে দখল করে ভূমি, পরে দখল করে ভাষা, শেষে দখল করে চিন্তা। ফলে তার প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান হলেও উপনিবেশের অবসান হয় না। এখানেই ডিকলোনিয়াল চিন্তা ও প্রকল্পের জরুরত।
ডিকলোনিয়াল চিন্তার সা¤প্রতিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে লাতিন আমেরিকান দার্শনিক পরিমণ্ডলে। আনিবাল কুইহানো, ওয়াল্টার মিনোলো, এনরিক দাসেল প্রমুখের লেখায়। তারা ঔপনিবেশিকতার মূলে ক্রিয়াশীল জ্ঞান উৎপাদনের একচ্ছত্রতা উন্মোচন করেছেন। মানব অভিজ্ঞতার বহুত্ব পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছেন। কিন্তু মুসলিম দুনিয়ায় এই চিন্তা নতুন নয়। ইসলামী দার্শনিক ঐতিহ্যে ইবনে খালদুনের ইলমুল উমরান, ইমাম গাজ্জালির নৈতিক জ্ঞানতত্ত¡, শাহ ওয়ালিউল্লাহর ইরতিফাকাত ও মুহাম্মদ ইকবালের জবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ ড়ভ জবষরমরড়ঁং ঞযড়ঁমযঃ রহ ওংষধস বিউপনিবেশায়নের পথনির্দেশ করে। সবখানেই জ্ঞানের মুক্তি, নৈতিক দায়বদ্ধতা ও সভ্যতার আত্মসচেতনতার সন্ধান আছে।
অতএব, ডিকলোনিয়াল বাংলাদেশ বলতে পশ্চিমা ডিকলোনিয়াল ধারার অনুকরণের কথা বলছি না, বলছি ইসলামী দার্শনিক চেতনায় জ্ঞান ও সভ্যতার পুনঃস্বদেশীকরণ। যে সভ্যতা নিজের জ্ঞানভাষা হারায়, সে কেবল অন্যের বর্ণমালায় নিজের শোকগাথা লিখতে থাকে।
আধুনিকতার সাথে পশ্চিমা প্রাধান্যকে এক করে দেখে ডিকলোনিয়াল চিন্তা। কারণ এখানে আছে সেই প্রকল্প, যা পশ্চিমা যুক্তি, বিজ্ঞান ও উন্নয়নবাদকে বিশ্বচেতনার একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। এই মানদণ্ড অনুসরণের মানে হলো আপনি নিজের ইতিহাস, সমাজ ও নৈতিকতা বোধকে পশ্চিমি ফ্রেমে অনুবাদ করবেন। এটি স্বাধীনতার অভ্যন্তরীণ অর্থকে কতল করে। আমাদের স্বশক্তি ও আত্মপরিচয় বিকৃত করে।
বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রনীতি, উন্নয়ন মডেল এবং সাংস্কৃতিক নীতিতে পশ্চিমা তত্ত¡ ও মানদণ্ডের অনুকরণ প্রতিষ্ঠিত। আমাদের ইতিহাস, ধর্ম, ভাষা, সমাজচেতনাকে ব্যাখ্যা করা হয় বহির্বিশ্বের দৃষ্টিকোণ থেকে। ফলে স্বাতন্ত্র্য ও আত্মপরিচয়ের স্বাভাবিক মূল্যায়ন সম্ভব হয় না।
ডিকলোনিয়াল চিন্তার লক্ষ্য স্থানীয় ও অন্তর্নিহিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং নৈতিকতার পুনর্গঠনের মাধ্যমে বিকল্প বিশ্বদৃষ্টি প্রতিষ্ঠা। এটি বিরোধের দর্শন নয়; পুনর্গঠনের দর্শন। এতে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক নতুনভাবে নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশে এর অর্থ দাঁড়ায়- আমাদের ইতিহাসকে নতুন চোখে দেখা, ধর্ম ও নৈতিকতাকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা, ভাষা ও সংস্কৃতির শক্তিকে আত্মসত্তার অংশ হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এর সাথেই নিবিড়ভাবে যুক্ত আমাদের মুক্তি। মুক্তি কখনো আগের প্রজন্মের লড়াইয়ে সম্পূর্ণ হয়ে যায় না, প্রতিটি প্রজন্মকে নিজের স্বাধীনতা নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়। ইতিহাসের দাসেরা অতীত পুনরাবৃত্তি করে, ইতিহাসের নির্মাতারা অতীতের পুনঃব্যাখ্যা দেন। এক কথায়, ডিকলোনিয়াল বাংলাদেশ মানে নকল আধুনিকতা ও জ্ঞানশাসন থেকে চিন্তার মুক্তি। এটি অস্তিত্বগত পুনর্গঠন।
সভ্যতার জন্ম হয় এক অন্তর্লিখিত প্রশ্ন থেকে। প্রশ্নটি হচ্ছে- ‘আমি কে?’, ডিকলোনিয়াল চিন্তার প্রথম পদক্ষেপ, সেই প্রশ্নের জবাবের দিকে ফিরে যাওয়া। বিউপনিবেশায়ন কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি এক আত্মিক প্রত্যাবর্তন।
২. উপনিবেশ খুব চতুর। সে শুধু ভূখণ্ডে থাকে না। ঢুকে যায় চেতনার গভীরতম স্থানে। অতএব ডিকলোনিয়াল বাংলাদেশের পুনর্গঠনকে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক সংস্কারে সীমিত করার সুযোগ নেই। এটি এক গভীর দার্শনিক ও জ্ঞানতাত্তি¡ক পুনর্গঠন, যা ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা নির্দেশিত হবে। ইসলামী দার্শনিকতা জ্ঞানকে কেবল ব্যবহারিক বা উপযোগী বিষয় হিসেবে দেখেনি; বরং জ্ঞান এখানে নৈতিক দায়বদ্ধতার সাথে সম্পৃক্ত ক্রিয়া হিসেবে স্বীকৃত। ব্যক্তি বা সমাজের জন্য জ্ঞানের কার্যকর হওয়ার প্রাথমিক শর্ত হলো নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংহতি। আখলাক ছাড়া জ্ঞান আগুনের মতো, উজ্জ্বল; কিন্তু বিধ্বংসী।
সভ্যতার উত্থান ও পতন মূলত নির্ভর করে নৈতিকতা ও জ্ঞানের শুদ্ধতার ওপর। যদি জ্ঞান কেবল ক্ষমতা বা সুবিধার জন্য ব্যবহৃত হয়, তা সভ্যতার আত্মবিনাশের পথ প্রস্তুত করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে পুনর্গঠনের তত্ত¡কে তিনটি পরস্পর-সংক্রান্ত স্তরে বিশ্লেষণ করা যায় :
ক. জ্ঞানকে ঈমান ও আখলাকের পরিসরে ফিরিয়ে আনা। এর মানে হলো- যেকোনো শিক্ষণ, গবেষণা বা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টাকে নৈতিক দায়িত্ববোধের সাথে যুক্ত হতে হবে। প্রযুক্তি বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা ধরা যাক। তার ব্যবহার শুধু লাভ বা আধিপত্যের জন্য হতে পারে না; বরং তাকে সমাজের কল্যাণ ও ন্যায়ের সাথে সমন্বিত হতে হবে।
খ. ইসলামী দর্শনের সাথে আধুনিক উন্নয়নচিন্তাকে সংযুক্ত করা। অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও সামাজিক নীতি কেবল ফলাফলের দিকে ধাবিত না হয়ে নৈতিক ও মানবিক উদ্দেশ্যের প্রতিও যেন দায়বদ্ধ হয়। এটি আধুনিক নৈতিকতার সাথে ঐতিহ্যগত দার্শনিক মূল্যবোধের সংমিশ্রণের বিশেষ দিক।
গ. শিক্ষাকে বাজারভিত্তিক দক্ষতা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে দেখলে চলবে না; বরং তাকে সমাজ ও আধ্যাত্মিক জীবনের পুনর্গঠনের হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জ্ঞানের সাথে ইসলামী, স্থানীয় ও বৈশ্বিক জ্ঞানের সৃজনশীল সংমিশ্রণ ঘটানোর বিকল্প নেই।
ডিকলোনিয়াল বাংলাদেশের দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে এমন এক জ্ঞান-পুনর্গঠন, যা নৈতিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক ন্যায় এবং রূহানি সমন্বয়কে কেন্দ্রে রাখে। একে কেবল একটি চিন্তাগত আন্দোলন মনে করার সুযোগ নেই। জ্ঞান তখনই মুক্ত, যখন তা নৈতিকতার অধীন। রূহানি জ্ঞান ছাড়া উন্নয়ন কেবল পরিশীলিত অবক্ষয়।
৩. ডিকলোনিয়াল বাংলাদেশের পুনর্গঠন একটি ত্রিসংগঠিত প্রক্রিয়া। চিন্তার মুক্তি, ইতিহাসের পুনর্লিখন এবং ন্যায় ও নৈতিকতার রাজনীতি। এই তিন স্তর পরস্পর আন্তঃসংযুক্ত। একক স্তরে এগুলোকে আলাদা করে দেখা সম্ভব হলেও কার্যকরী পুনর্গঠন তখনই সম্ভব হবে, যখন সব স্তর সমন্বিতভাবে চলবে।
কিন্তু আমরা চিন্তার মুক্তির যে দাবি তুলছি, এর চাহিদা কী? সে কী চায়? পশ্চিমকেন্দ্রিক চিন্তাব্যবস্থা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টি সীমিত করেছে। আধুনিকতার পশ্চিমা ধারণা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও উন্নয়নবাদ মানদণ্ড হয়ে আমাদের মাথার উপর ঝুলছে।
অতএব বুদ্ধিবৃত্তির মুক্তি চাই। এই মুক্তির চাহিদা হলো, চিন্তা ও বিশ্লেষণকে প্রান্তিক বা ঔপনিবেশিক মানদণ্ডের বাইরে নিয়ে আসা। যাতে বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাব্যবস্থা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে সক্ষম হয়। যেন এমন জ্ঞানকেন্দ্রিক সমাজ গঠন সহজ হয় যা পশ্চিমা তত্ত¡ ও দৃষ্টিভঙ্গির একচ্ছত্রতার বিপরীতে ইলমুল কালাম (মুসলিম ধর্মদর্শন) ও উলুমুল উমরান (মানবিক-সামাজিক জ্ঞানসমূহ)-এর পুনর্গঠন নিশ্চিত করবে।
নৈতিক বিচারে চিন্তার ব্যবহারে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে এবং বুদ্ধিবৃত্তিতে নৈতিক পরিপ্রেক্ষিত প্রতিষ্ঠিত হবে। সৃজনশীলতার বিচারে নতুন পালাবদল ঘটবে। অধ্যয়ন, বিশ্লেষণ ও সমস্যার সমাধানে ওহির প্রজ্ঞা, স্থানীয় অভিজ্ঞতা এবং ইতিহাস ও সামাজিক বাস্তবতা তার ভূমিকা পালন করবে।
চিন্তাগত মুক্তির পাশাপাশি ইতিহাসের পুনর্লিখন জরুরি। ডিকলোনিয়াল ইতিহাসচেতনায় মুসলিম, বাঙালি ও মানবিক অভিজ্ঞতার সম্মিলিত পাঠ প্রতিষ্ঠিত হবে। বাঙালি মুসলিম অভিজ্ঞতা, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের সাথে মিলে এটি একটি সংহত জাতীয়-সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় গঠন করবে।
এ জন্য জরুরি হলো স্থানীয় ও ইসলামী প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের পুনঃপাঠ। পরিচয় গঠনে ভাষা, শিল্প, সাহিত্য ও ধর্মীয় রীতিনীতির অন্তর্ভুক্তি। ইতিহাস থেকে ন্যায় ও দায়বদ্ধতার শিক্ষা গ্রহণ।
এর মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হবে- ক. অতীতকে পশ্চিমা বা ঔপনিবেশিক ব্যাখ্যার বাইরে নিয়ে আসা; খ. ইতিহাসের শিক্ষা দিয়ে সমাজে ন্যায়, দায়িত্ব ও সততার প্রচার এবং গ. স্থানীয় ভাষা, ধর্ম, রীতিনীতি ও সামাজিক প্রথাকে কেন্দ্রে রাখা।
ইতিহাসের পুনর্লিখন জাতীয় আত্মপরিচয়কে শক্তিশালী করবে। জাতীয় আত্মসচেতনতা বাড়াবে। সামাজিক ন্যায় ও সামাজিক সংহতির ধারণা উদ্দীপিত হবে, যা রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের মধ্যে সমন্বয় ঘটাবে।
তৃতীয় জরুরি কাজ হলো ন্যায় ও নৈতিকতার রাজনীতির প্রতিষ্ঠা। এটি কেবল আইন বা প্রশাসনিক কাঠামো নয়; বরং সে সামাজিক আচরণ, রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনৈতিক নীতিকে এক নৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে।
নৈতিক আত্মচেতনা এ জন্য জরুরি। ইসলামী প্রেক্ষাপটে নৈতিক আত্মচেতনা আল্লাহকেন্দ্রিক দায়িত্ববোধ গঠন করে, মানবকে তার কর্মকাণ্ডের জন্য বহুমাত্রিক জবাবদিহির আওতায় আনে।
নৈতিক বিচারে যা প্রতিটি কাজের পেছনে নিয়ত বা নৈতিক উদ্দেশ্য স্থাপন করে। সামাজিক বিচারে নাগরিক ও রাষ্ট্রকর্মী উভয়কেই দায়বদ্ধ করে। রাজনৈতিক অর্থে নীতিনির্ধারণে স্বার্থবাদী না হয়ে সর্বজনীন কল্যাণকে কেন্দ্রে রাখতে দিশাদান করে।
ফলে সমাজ-রাষ্ট্রে মানুষ শুধু আইনের কাছে দায়ী থাকে না; বরং একই সাথে সে নিজের অন্তর্নিহিত নৈতিক দায়িত্ববোধে সজাগ হয়, চালিত হয়। সেই সাপেক্ষে নিজেকে চালিত করে, সমাজকে প্রভাবিত করে ও রাষ্ট্রকে প্রণোদিত করে।
ইসলামী রাজনীতি দর্শনের কেন্দ্রে আছে তাওহিদ, আমানাহ ও আদল। এই নীতিগুলো শুধু ধর্মীয় নির্দেশ নয়; বরং রাজনৈতিক ও নৈতিক কর্মপরিকল্পনার ভিত্তি। এর চাহিদা হলো- রাষ্ট্র ও নাগরিকের দায়িত্ববোধকে কেন্দ্র করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, যা নিশ্চিত হলে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের নৈতিক স্থায়িত্ব আসে। রাজনীতিতে এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ও নীতির প্রয়োগে নৈতিক সীমারেখা সংজ্ঞায়িত হবে। এর অর্থনৈতিক প্রয়োগে বাজার, সম্পদ বণ্টন ও উন্নয়ন নীতিকে নৈতিক লক্ষ্য অনুসারে পরিচালিত করা হবে।
ইতিহাসচেতনা শক্তিশালী হলে সাংস্কৃতিক ও জাতীয় স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়। জ্ঞানচেতনা নিশ্চিত হলে সৃজনশীলতা, বৈজ্ঞানিক বিচক্ষণতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা কায়েম হয়।
এই ত্রিধারার সমন্বয় জরুরি। কারণ জ্ঞানতাত্তি¡ক মুক্তি ছাড়া ইতিহাসকে সঠিকভাবে পুনর্লিখন সম্ভব নয়। ইতিহাসের পুনর্লিখন ছাড়া ন্যায় ও নৈতিকতার রাজনীতি স্থায়ী হবে না। অতএব তিনটি স্তরের সংমিশ্রণই ডিকলোনিয়াল বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত দর্শন ও পুনর্গঠন নিশ্চিত করবে।
৪. ডিকলোনিয়াল বাংলাদেশ চায় অস্তিত্বগত পুনর্গঠন। যেখানে রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের সম্পর্কের মূল কাঠামো পুনঃনির্ধারণ করা হবে। এটি একটি দার্শনিক প্রক্রিয়া। এতে জ্ঞান, নৈতিকতা ও সভ্যতার সংজ্ঞা একত্রে কথা বলবে।
ইবনে খালদুনের ইলমুল উমরান অনুসারে, সভ্যতার গঠন ও উত্থান নির্ভর করে তিনটি মূল স্তরের সংমিশ্রণে : জ্ঞান, সামাজিক নীতি ও অর্থনৈতিক কাঠামোর শুদ্ধতা। ডিকলোনিয়াল বাংলাদেশের পুনর্গঠনও এই তিন স্তরে সংঘটিত হতে পারে।
জ্ঞানগত পুনর্গঠন প্রথম ধাপ। শিক্ষার কাঠামো পরিবর্তন হলেই এই পুনর্গঠন হয়ে যায় না। জ্ঞানিক পুনর্গঠন মানে চিন্তাধারার স্বাধীনতা ও বুদ্ধিবৃত্তির মুক্তিও। পশ্চিমা চিন্তা যেখানে জ্ঞানকে শক্তি হিসেবে দেখে, ইসলামী দৃষ্টিতে জ্ঞান হলো দায়িত্ব বা আমানাহ। এখানেই বিউপনিবেশিত ইসলামী পুনর্গঠনের ভেতরকার রূহানি মাত্রা নিহিত।
এই দর্শনের দাবি হলো- রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্রগুলোকে পুনর্গঠন করতে হবে। তা করতে হবে স্থানীয় বাস্তবতা ও ইসলামী নীতিশাস্ত্রের আলোকে চিন্তাশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে। পাঠক্রমে স্থানীয় ইতিহাস, ভাষা, শিল্প ও বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করার বিকল্প নেই। শিক্ষার্থী ও গবেষককে স্বাধীন চিন্তাভাবনার সুযোগ দিতে হবে। চিন্তার বিকাশ ও আনুকূল্য নিশ্চিত করতে হবে। জ্ঞানের পুনর্গঠনের দাবি হলো সামাজিক পুনর্গঠন।
সমাজ পুনর্গঠন মানে উম্মাহভিত্তিক ন্যায়, আখলাক ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এটি ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ নৈতিকতা ও সামাজিক ন্যায়বোধকে সমন্বিত করে। এর প্রতিষ্ঠা সব নাগরিককে ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে প্রস্তুত করবে, বাধ্য করবে। সাংস্কৃতিক জীবনে সহানুভূতি, পরস্পরের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি করবে। রাজনৈতিক মাত্রায় রাষ্ট্রব্যবস্থায় নৈতিকতা ও ন্যায়ের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে।
এর মধ্য দিয়ে সমাজ গড়ে উঠবে সহানুভূতিশীল, ন্যায়পরায়ণ ও আখলাকিভিত্তিক উম্মাহ হিসেবে। যা রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়ের জন্য নৈতিক পরিবেশ ও আনুকূল্য অবধারিত করে। কিন্তু এই বাস্তবতা প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের বিকল্প নেই।
অর্থনৈতিক পুনর্গঠন মানে বাজার, সম্পদ এবং উৎপাদন ব্যবস্থাকে নৈতিক ও মানবিক উদ্দেশ্যের অধীনে আনা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কেবল লাভের জন্য পরিচালিত হবে না; বরং সামাজিক কল্যাণ ও ন্যায়ের মানদণ্ডে পরিচালিত হবে। এর ফলে ব্যবসায় ও উৎপাদন ন্যায় ও সৎ আচরণের সাথে সঙ্গতি রাখবে। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও শোষণ হ্রাস হবে। জাকাত, সাদাকা, করজে হাসানাহ ও আধ্যাত্মিক দায়ও বৈষম্য নিরসনে একত্রে কাজ করবে। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক নীতি রাষ্ট্রের নৈতিক লক্ষ্যকে সমর্থন করবে।
ফলে অর্থনীতি কেবল বাজারভিত্তিক থাকবে না; বরং সামাজিক ও নৈতিক কল্যাণ নিশ্চিতকারী ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে।
খোলাসা : ডিকলোনিয়াল বাংলাদেশ মানে অস্তিত্বের পুনর্গঠন। এই পুনর্গঠনের মর্মকথা হলো- জ্ঞান ও চিন্তা যদি আমানাহ হয়, তবে মানুষই তার যোগ্য ধারক, মানুষ যদি জ্ঞানের আমানাহ ধারণ করে, তা হলে সমাজই তার ন্যায্য উত্তরাধিকারী। সমাজ যে আমানতের উত্তরাধিকার বহন করে, রাষ্ট্র হবে তার রক্ষক, ব্যবস্থাপক।
ঔপনিবেশিক আধুনিকতা মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, সমাজকে আত্মাহীন করেছে এবং জ্ঞানকে শক্তির উপকরণে রূপ দিয়েছে। ডিকলোনিয়াল বাংলাদেশের দর্শন সেই বিচ্ছিন্নতাকে অতিক্রম করতে চায়।
ইবনে খালদুনের ভাষায়- সভ্যতার স্থায়িত্ব নিহিত থাকে আদল (ন্যায়), ইলম (জ্ঞান) ও আখলাক (নৈতিকতা)-এর সংহতিতে।
এই সংহতিই বিউপনিবেশিত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের দর্শন।
যেখানে আজাদি কেবল রাজনৈতিক অর্থে সীমিত নয়; বরং অস্তিত্বগত আজাদিই হবে অন্বেষা। মানুষ নিজের সত্তাকে জানবে, জ্ঞানের উৎসকে চিনবে, আর সভ্যতার দিকনির্দেশকে পুনরায় বিন্যস্ত করবে জ্ঞান, চিন্তা ও বাস্তব জীবন যাপনের কিতাবে।
লেখক : কবি, গবেষক



