ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি এক সপ্তাহ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে অবশেষে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তার মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ঘাতকের নির্মম বুলেটের শিকার হয়ে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন তিনি। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে যে ক’জন তরুণ নেতৃত্ব জাতিকে আন্দোলিত করে আসছিলেন, তিনি তাদের একজন। হাদি দৃঢ়তার সাথে সত্য উচ্চারণ করতেন। জাতির স্বার্থে অনেক অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করে সবাইকে সতর্ক করে দিতেন। ব্যক্তিজীবনে হাদি এমন সব কথা বলতেন যা তার উন্নত জীবনবোধ ও দর্শনের ইঙ্গিতবহ ছিল।
সাম্প্রতিককালে হাদি এমন সব কথাবার্তা বলতেন, তাতে মনে হয় তিনি যেন তার জীবনের ছন্দপতনের আগাম ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সরল জীবনযাপনের অধিকারী। নিজে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি, তবে ইনকিলাব মঞ্চ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার পরিকল্পনা নিয়ে প্রচার চালাচ্ছিলেন।
বড় কোনো দলের নেতা না হয়েও ওসমান হাদি দেশের মানুষের কাছে এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, যা তার আহত হওয়ার পর আরো জোরালোভাবে অনুভব করা গেছে। তার শহীদি মৃত্যুর পর সরকারপ্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব যে ভাষায় কথা বলেছে, তাতে এটি বেশ সুস্পষ্ট যে, তিনি দেশের রাজনীতিতে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। সুতরাং তার মৃত্যু একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। সেটি হচ্ছে জুলাই বিপ্লবের প্রতিপক্ষ শক্তির জিঘাংসার একটি পদক্ষেপ ও জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষের জন্য একটি সতর্কবার্তা। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকার ও তাদের পোষ্য ঘাতক এবং সন্ত্রাসী বাহিনী তাদের আশ্রয়দাতার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে মরণকামড় দিতে শুরু করেছে। ওসমান হাদি হলো তার প্রথম শিকার।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবিরোধী সংগ্রামের অমর সৈনিক ওসমান হাদির প্রয়াণ দেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিসরে এক অপূরণীয় ক্ষতি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, হাদি ছিলেন এক সাহসী রাজনৈতিক কর্মী এবং নির্ভীক কণ্ঠস্বর, যিনি সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, ওসমান হাদি ছিলেন ইনসাফ ও ন্যায়ের পথে দৃঢ়তা, ত্যাগ ও সাহসিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও দেশবাসী হাদির জন্য প্রাণভরে দোয়া করছেন, যাতে তিনি শহীদের মর্যাদা নিয়ে জান্নাতবাসী হতে পারেন।
হাদির তিরোধানের খবর প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে সারা দেশে তীব্র ক্ষোভের ঝড় ওঠে। প্রায় সব প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল থেকে যেসব স্লোগান উঠেছে তা ছিল সুস্পষ্টভাবে পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার আশ্রয়দাতা ভারতের বিরুদ্ধে। জুলাই বিপ্লবের আগে ও পরে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে পতিত ফ্যাসিবাদ ও ভারতবিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছে।
ভারতের সরকার, দেশটির এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া যেভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তা শুধু সাম্প্রতিককালের নয়। ঐতিহাসিকভাবে ভারতের উঁচু মহল তথা ব্রাহ্মণকুল আমাদের বিরুদ্ধে লেগে আছে। ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলে ভারত তা লুফে নেয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। মুক্তিযুদ্ধকে নিছক সামরিক লড়াই হিসেবে বিবেচনা না করে তারা এর মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শও অন্তর্ভুক্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণের ব্যাপারে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল। এমনকি প্রবাসী সরকারকে এমন চুক্তি করতে বাধ্য করা হয়েছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে নিজস্ব সামরিক বাহিনী, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বা নিজস্ব প্রশাসন বলে কিছু থাকবে না; সব ভারতের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে।
১৬ ডিসেম্বরের পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে থাকতে দেয়া হয়নি। আত্মসমর্পণের পরে বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ভারতীয় বাহিনীর হাতে চলে যায়। এটি এখন স্পষ্ট যে, ভারত নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। তাদের এ সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের জনগণ অবশ্যই ভারতকে ধন্যবাদ দিতে কার্পণ্য করেনি। কিন্তু শুরু থেকে ভারত কুমতলব হাসিলের চেষ্টা করে গেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে শত শত কোটি টাকার সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জাম লুটে নেয়। এমনকি শিল্প-কারখানার ভারী মেশিনারি পর্যন্ত বাদ দেয়নি। এর প্রতিবাদ করলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলকে তারা আটক করে রাখে। তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার এর কোনো প্রতিকার করেনি।
বাংলাদেশের মানুষ শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধকে এ জন্য সমর্থন করেছিল যে, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু শেখ মুজিব ও তার দল ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথে বিরোধী দলগুলোর উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাতে থাকে। ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে অরাজকতা চালায়। এভাবে তারা নির্বাচনকে কলুষিত করার সূচনা করে। মাত্র তিন বছরের মাথায় শেখ মুজিব সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে একদলীয় বাকশাল প্রবর্তন করেন; যার ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটে। এসব কাজে শেখ মুজিবকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে ভারত। দেশটি ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিয়ে আমাদের পানিসঙ্কটের সূচনা করে।
মূলত, শুরু থেকে ভারত বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব ও স্বার্থ বিবেচনা না করে একটি দল তথা আওয়ামী লীগ ও শেখ পরিবারের সাথে সখ্য গড়ে তোলাকে প্রাধান্য দেয়।
শেখ মুজিবের পতনের পরে দেশের মানুষ শোকের পরিবর্তে স্বস্তি প্রকাশের পরও ভারতের বোধোদয় হয়নি। জিয়াউর রহমান স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়ে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা শুরু করলে তাকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। এরপর জেনারেল এরশাদ সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। এরশাদের সাথে ছিল ভারতের গভীর সখ্যতা।
২০০৮ সালে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ভারতের মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে তাদের ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বইয়ে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। জাতীয় পার্টি সব সময় শেখ হাসিনার কব্জায় ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে সরাসরি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটান। প্রহসনের প্রতিটি নির্বাচনের পর ভারত হাসিনা সরকারকে সবার আগে স্বীকৃতি দিয়েছে। ওই সব নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রতি ছিল প্রচণ্ড চপেটাঘাত; তা জেনেও ভারত আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন দেয়। এদেশের মানুষ ভারতের এই ভূমিকা সহজভাবে নেয়নি।
আওয়ামী লীগ শুরু থেকে ভারতের প্রতি অনুরক্ত একটি দল। দীর্ঘ দিন ধরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সাথে আওয়ামী লীগের বিশেষ সম্পর্ক। অবশ্য নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় এলেও একই মাত্রায় আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক দেখা যায়। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বেশি মাত্রায় ভারতের প্রতি অনুরাগী ভূমিকা পালন করেছে। বিরোধী দলের মতে, আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় ‘ভারতমুখী ও নতজানু’ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে। একইসাথে ভারতের স্বার্থে কাজ করে।
লক্ষণীয়, বিগত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে চলেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে অনিষ্পন্ন অবস্থায় থাকায় বাংলাদেশ অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সরকারের পক্ষ থেকে অতীতে বহু উদ্যোগ যে নেয়া হয়নি তা নয়; কিন্তু ভারতের অসহযোগিতা ও আন্তরিকতার অভাবে কাক্সিক্ষত সাফল্য আসেনি।
গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ভারতের সাথে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালের পর থেকে কোনো চুক্তি ছাড়া গঙ্গার পানি বণ্টিত হচ্ছিল। এ নিয়ে দু’দেশের সরকারি পর্যায়ে বহুবার যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও কোনো সমঝোতা হয়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন-সংক্রান্ত ৩০ বছর মেয়াদি এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে কোনো প্রকার ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ রাখা হয়নি। শুধু তাই নয়, চুক্তির ফলে বাংলাদেশ নিজের ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামেও উত্থাপনের অধিকার পাবে না।
ভারতের টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ায় বাংলাদেশের বিরাট এলাকা হুমকিতে পড়তে যাচ্ছে। দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিপাইমুখে বাঁধ হলে তা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনবে। ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ছিলেন সোচ্চার। এক পর্যায়ে তিনি গুম হয়ে যান।
ভারত দীর্ঘদিন থেকে নিজের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিট বা করিডোর পেতে অনুরোধ করে আসছিল। বাংলাদেশের অতীত সরকারগুলো জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে ভারতের অনুরোধ রক্ষা করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের অনুরোধ রক্ষা করে সম্ভাব্য সব প্রকার ট্রানজিট সুবিধা ভারতকে দিতে সম্মত হয়।
ভারত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে চায় এবং আওয়ামী লীগ সরকার ভারত কর্তৃক সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সম্মতিও দিয়েছিল। ভারতের উদ্দেশ্য হচ্ছে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে পরিচালিত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নির্মূল করা। এ জন্য তারা সহজে ও কম খরচে সে রাজ্যগুলোতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যেতে চায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনগুলো। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো- আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়টি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত শান্তিবাহিনী দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি বিরাট হুমকির কারণ ছিল। ১৯৯৬ সালে সন্ত্রাসী বাহিনীর সাথে শান্তি চুক্তি হলেও তা শেষ হয়ে গেছে বলা যাবে না। সবাই জানে, আমাদের কোন প্রতিবেশী দেশ সন্ত্রাসী শান্তিবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার সন্ত্রাসী শান্তিবাহিনীর সাথে অসাংবিধানিক চুক্তি করে সমস্যাকে আরো গভীরতর করে দিয়েছে। পুশইন আর পুশব্যাকের ঘটনাও কম নয়। এ ছাড়া অপরাধ বিষয়ে পরস্পরকে আইনি সহায়তা প্রদান চুক্তি, সাজাপ্রাপ্ত বন্দিবিনিময় চুক্তি ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সংঘটিত অপরাধ ও অবৈধ মাদক পাচার মোকাবেলায় যৌথব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকে ফিরিয়ে দিতে ভারত বাধ্য। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে ভারতকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু দিল্লি তাতে সাড়া দিচ্ছে না।
কোনো শান্তিপূর্ণ ও সভ্য দু’টি দেশের মধ্যে সীমান্ত থাকে উন্মুক্ত এবং পারস্পরিক মর্যাদা ও আস্থার ভিত্তিতে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ভারত সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আমাদের অসম্মান করছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে প্রতিনিয়ত নিরস্ত্র বাংলাদেশীকে নির্বিচারে হত্যা করছে ভারতীয় বিএসএফ। এ নিয়ে হাসিনা সরকার কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। আমাদের বিজিবির হাতে কোনো ভারতীয় নাগরিক মারা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বিভিন্ন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে।
ভারত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এক বৃহৎ প্রতিবেশী। ভৌগোলিক কারণে প্রতিবেশীর অবস্থান একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা। ঐতিহাসিকভাবে তাদের সাথে রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। ভারত বিশাল দেশ এবং পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। তার সামরিক শক্তিও বিশ্বের প্রথম সারিতে পড়ে। ভারত মহাসাগরে তার প্রভাব অনেক। দেশটির অর্থনীতিও বাংলাদেশের তুলনায় নানাদিক থেকে এগিয়ে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর ৫৪টি এসেছে ভারত থেকে। সুতরাং প্রতিবেশী ভারতকে উপেক্ষা করে চলার মতো অবস্থা বাংলাদেশের নেই। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ চায় ভারতের সাথে সম্পর্কটি হোক সমমর্যাদার ভিত্তিতে। কিন্তু ভারতের আচরণ হচ্ছে মোড়লগিরি করা। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের সাথে তার অন্যান্য প্রতিবেশী পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটানের সাথেও সম্পর্ক মধুর নয়।
শরিফ ওসমান হাদি ভারতের এসব আধিপত্যবাদী মনোভাব ও সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। এর আগে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারও ভারতের অন্যায্য পানি রাজনীতির বিরুদ্ধে সামান্য একটু প্রতিবাদ করলে তাকেও জীবন দিতে হয়। জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক দলকেও ভারত তাদের লক্ষ্য হাসিলে প্রতিবন্ধক মনে করে আসছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে জামায়াতের উত্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো দলের উত্থান ঘটতে পারে। তাতে প্রতিবেশী দেশের গাত্রদাহের কারণ কী? এটি এখন অনেকে বিশ্বাস করেন, ভারতের ইশারায় জামায়াত নেতাদের জুডিশিয়াল কিলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে।
শেখ হাসিনা ও তার প্রভু ভারত জুলাই বিপ্লব ঠেকাতে পারেনি। হাজার হাজার মানুষ হতাহত করেও শেখ হাসিনা বা তার দলের কোনো নেতাকর্মীর মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই; বরং বাংলাদেশ নিয়ে তাদের ষড়যন্ত্রের এবং তার পক্ষে বয়ানের শেষ নেই। তাদের এসব কর্মকাণ্ড কবে শেষ হবে বলা মুশকিল। তবে তারা যে আমাদের জ্বালাতে থাকবে; তা নিশ্চিত ধরে নেয়া যায়। সেটি প্রতিহতে ওসমান হাদির মনোভাব আমাদের অনুভবে জাগরূক রাখতে হবে।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব



