১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাজনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ব-পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাহাড়ি এই জনপদ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ১৩ হাজার ১৮৪ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। ১৯৮৪ সাল পূর্ববর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি, রামগড় ও বান্দরবান- এ তিন মহকুমা সমন্বয়ে গঠিত ছিল। ১৯৮৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি (রামগড়)- এই তিন জেলায় রূপান্তর করা হয়। চট্টগ্রাম বিভাগের এই এলাকা পাহাড় ও উপত্যকায়পূর্ণ বলে এর নামকরণ পার্বত্য চট্টগ্রাম করা হয়েছে। ১৮৬০ সালের আগে চট্টগ্রাম জেলার অংশ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম, যার সদর দফতর ছিল রাঙ্গামাটি। দেশের বনভূমির এক বিশাল অংশ এ অঞ্চলে অবস্থিত। অঞ্চলটির মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রধান নদী হলো কর্ণফুলী। এছাড়া ফেনী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী নামের তিনটি নদী এ অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত।
পাকিস্তান শাসনামলে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে পার্বত্য চট্টগ্রাম সঙ্ঘাতের সূচনা হয়। ১৯৬২ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হলে লক্ষাধিক লোক স্থানচ্যুত হন। তাদের স্থানচ্যুতিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার গুরুত্ব না দেয়ায় হাজারো পরিবার ভারতে চলে যায়। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণে এ অঞ্চলের মোট আবাদি জমির ৪০ শতাংশসহ (৫০ হাজার একর জমি) প্রায় ৬৪৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমা রাজনীতিবিদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্বায়ত্তশাসন ও ওই অঞ্চলের জনগণের অধিকার স্বীকৃতি দেয়ার দাবি উত্থাপন করেন। লারমা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়ার বিপক্ষে অবস্থান নেন।
তাদের অভিমত, এই সংবিধানে নৃ-জাতিগোষ্ঠীকে স্বীকৃতিসহ অমুসলিম ও অবাঙালিদের সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। সরকারের নীতি কেবল বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষা ঘিরে। তাছাড়া বাংলাদেশের সব নাগরিককে বাঙালি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আলোচনান্তে জানানো হয়, পার্বত্য নৃ-জাতিগোষ্ঠী বাঙালি হিসেবে পরিচিতি লাভে একমত পোষণ করেছেন। এছাড়া শেখ মুজিব জানিয়েছেন, পার্বত্য এলাকায় মুসলিম বাঙালিদের জোরপূর্বক আবাসনে স্থানীয় বৌদ্ধ ও সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী মেনে নিতে পারছেন না।
১৯৭৩ সালে লারমা ও অন্যান্য নেতা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-পিসিজেএসএস’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সমিতিতে স্থানীয় নৃ-গোষ্ঠীর ও উপজাতীয় লোকেরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন। পিসিজেএসএসের সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী সরকারি নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিতে সচেষ্ট হয়। শেখ মুজিবের জরুরি শাসনামলে এ সঙ্কটের সূচনা। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যানবাহনে প্রথমবারের মতো শান্তিবাহিনী আক্রমণ করে। ভারত সরকার সীমান্তে ঘাঁটি গড়তে শান্তিবাহিনীকে সহায়তা করে।
শান্তিবাহিনী আক্রমণ পরিচালনার সুবিধার্থে এ অঞ্চলকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে। স্থানীয় অধিবাসীদের জোরপূর্বক সংগঠনে যোগ দিতে বাধ্য করে ও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়। বাঙালি পুলিশ ও সৈনিক, সরকারি কার্যালয়, সরকারি কর্মকর্তা ও এতদঞ্চলের বাঙালি মুসলিম অধিবাসীদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাতে থাকে। তাছাড়া এ বাহিনীর বিপক্ষে অবস্থানরত যেকোনো অধিবাসী ও সরকারকে সমর্থন দানকারীকেও আক্রমণ করতে দ্বিধাবোধ করেনি। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ১৯৮০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার নিরীহ শান্তিকামী মানুষ সশস্ত্র শান্তি বাহিনীর হাতে প্রাণ হারায়।
সত্তরের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সরকারের তত্ত¡াবধানে লোকজনকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। দাবি করা হয়, প্রায় পাঁচ লাখ বাঙালিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে চার লাখ নেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। সে সংখ্যা এখন বেড়ে কত হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা না গেলেও গবেষকদের দাবি, চার দশকের বেশি সময় পর পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে পাহাড়ি ও বাঙালির সংখ্যা প্রায় সমান সমান।
এই বাঙালিদের বলা হয় সেটেলার। প্রত্যেককে পাঁচ একর করে জায়গা দেয়ার কথা বলে সেখানে নেয়া হয়েছিল। ক্রমবর্ধমান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের জন্য আলাদা করে গুচ্ছগ্রাম তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে গুচ্ছগ্রামেও হামলা অব্যাহত থাকে। বাঙালি সংগঠনের দাবি, পাহাড়িদের সংগঠন নিষিদ্ধ করা হোক। পাহাড়িদের দাবি, বহিরাগত বাঙালিদের যেখান থেকে আনা হয়েছে সেখানে তাদের পুনর্বাসন করা হোক।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগ নেয়। মন্ত্রিসভায় একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে এবং কমিটিতে আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদসদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও বিএনপির সংসদ সদস্যরা কমিটির কাজে অংশগ্রহণ করেননি। কয়েক দফা সংলাপের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সে সময়কার প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন সন্তু লারমা ও আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাহাড়িদের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) থেকে পৃথক হয়ে ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ’ নামের আরেকটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তীতে এ দু’টি সংগঠন ভেঙে আরো কয়েকটি তৈরি হয়, ফলে বর্তমানে চারটি সশস্ত্র দল পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় রয়েছে।
শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিরা ‘সম অধিকার আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। পাহাড়িরা যেখানে সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানায়, সম অধিকার আন্দোলন তার বিরোধিতা করে। সম অধিকার আন্দোলনের নেতাদের আশঙ্কা চুক্তি বাস্তবায়িত হলে বাঙালিরা পাহাড়িদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।
শান্তি চুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সন্তু লারমা বিভিন্ন সময় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রামের হুমকি দেন। ২০২৩ সালে তিনি বলেন, চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর অতিবাহিত হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
শান্তি চুক্তির শর্তানুযায়ী, পার্বত্য অঞ্চলে স্থানীয় পরিষদের অনুমোদন ছাড়া ভূমি কেনাবেচা এবং হস্তান্তর নিষিদ্ধ করা হলেও এ নীতির বিরোধিতা করছে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের সংগঠন সম অধিকার আন্দোলন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির মালিকানা নিয়ে ব্রিটিশ আমল থেকে কিছু আইন প্রচলিত ছিল। এসব আইনানুসারে ভূমির মালিকানা প্রথাগতভাবে সেখানে যারা বসবাস করে আসছে; সেসব পাহাড়ি মানুষের। পাহাড়িদের কাছে এসব ভূমির মালিকানার কোনো দলিলপত্র নেই। কিন্তু পরবর্তীতে যখন বাঙালিদের সেখানে নিয়ে গিয়ে বসতি করে দেয়া হয়, তখন শুরু হয় ভূমি নিয়ে বিরোধ। মূলত এটি সঙ্কটের মূল কারণ।
শান্তি চুক্তির মধ্যে অনেক সমস্যা ছিল। চুক্তিতে ভূমি কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও সেখানে বাঙালি সেটেলারদের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এ সমস্যা সমাধানে ২০০১ সালে ভূমি কমিশন গঠন-পরবর্তী এখন পর্যন্ত ভূমি কমিশন কোনো ভূমি বিরোধের সমাধান করতে পারেনি।
শান্তি চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালে গঠিত হয়েছিল আঞ্চলিক পরিষদ এবং বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি- এ তিন জেলার জন্য পার্বত্য জেলা পরিষদ। কিন্তু গঠন পরবর্তী এখন পর্যন্ত একবারের জন্যও এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। গঠন পরবর্তী যাদের সেসব পরিষদে বসানো হয়েছিল তারা দীর্ঘকাল এগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন বা আছেন। স্থানীয় ভোটারদের ভোটে এসব পরিষদের কর্মকর্তাদের নির্বাচিত হওয়ার বিধান করা হলেও কারা ভোটার হবেন এবং কারা হবেন না- এ নিয়েও রয়েছে বিরোধ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্কটের পেছনে এর ভৌগোলিক অবস্থানও একটি কারণ। দুর্গম পাহাড়ি ও প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় নিরাপত্তা বাহিনী খুব দ্রুত ও সহজে সেখানে পৌঁছাতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো এমন দুর্গম জায়গা রয়েছে যেখানে যেতে হয় হেঁটে এবং সেসব জায়গায় পৌঁছাতে দুই-তিন দিনও লেগে যায়।
পর্যটনের দিক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আকর্ষণ বাংলাদেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে ব্যাপক। বর্তমানে সারা বছর তিনটি পার্বত্য জেলায় বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আগমন ঘটে। যদিও মাঝে মধ্যে সশস্ত্র সঙ্ঘাতে পর্যটক আগমনে ছেদ পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনাবাদি যে বিপুল পাহাড়ি ভূমি রয়েছে তা আম, কাঁঠাল, কমলা, মাল্টা, পেয়ারা, পেঁপে, আনারস, কলা প্রভৃতি চাষের উপযোগী। এ সব অনাবাদি ভূমিতে ফল-ফলাদি চাষের ব্যবস্থা করা গেলে তা এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে যেমন স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করবে; পাশাপাশি দেশের ফল-ফলাদির চাহিদা মেটাতে সহায়ক হবে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি-বাঙালি উভয়ে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসে উদ্যোগী হয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখলে, আশা করা যায়- সমস্যা ও সঙ্কট উভয়ের উত্তরণ সম্ভব হবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক