বিশ্বে অশান্তির ঐতিহাসিক কারণ

তুর্কি ওসমানীয় সালতানাত (অটোমান এম্পায়ার) এবং ভারতের মুঘল বাদশাহীর পতন আজকের জগতের দুই বিষফোঁড়া-ইহুদিবাদ (জায়নিজম) এবং ভারতের আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদের জন্ম দিয়েছে।

আরব বিজয়ী বীর মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পর ৭০০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছেন মুসলমানরা। কিন্তু কোনো একটি মুসলিম রাজবংশের আমলে ভারতের হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-শৈব-শাক্ত, ক্ষুদ্র উপজাতির ওপর দমন বা বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করার নজির নেই ইতিহাসে। যে আওরঙ্গজেবকে বলা হয় ‘কট্টর মৌলবাদী’, সেই তিনি বরং নতুন নতুন মন্দির গড়ে দিয়েছেন। সাথে সাথে এক শান্তিপূর্ণ, অভিনব পন্থায় হিন্দু বিধবা মহিলাদের ‘সতীদাহ’ বা জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার বীভৎস নৃশংসতার অবসান ঘটান। তিনি ভারতবর্ষজুড়ে কোতোয়ালদের (তখনকার দিনের ওসি) নির্দেশ দেন তারা সতীদাহ স্থানে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করবেন হিন্দু বিধবা নারী স্বেচ্ছায় সহমরণে চিতায় উঠছেন, নাকি সম্পত্তির লোভে পরিবারটি এই মর্মবিদারক অপকর্ম করছে; কিংবা তাকে নেশাগ্রস্ত করে চিতায় পাঠানো হচ্ছে কি না? তবে স্বেচ্ছামরণে কোনো বাধা দিতে বারণ করেন। যদি জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার পেছনে সম্পত্তি যা নেশা-মাদকের সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে এ মৃত্যুর বীভৎসতা থেকে তাকে রক্ষা করার কথা বলেন তিনি। ব্যাস, আর যায় কোথায়? ওই বাদশাহী ফরমান জারির দিন থেকে ৭০ শতাংশ সহমরণ বন্ধ হয়ে গেল!

সোমনাথ মন্দির লুটের কথা কেউ বলে থাকেন। কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা পশ্চিম বাংলার এক প্রবীণ বুদ্ধিজীবীর লেখায় পড়েছি : ‘মন্দির সুরক্ষিত থাকার কারণে অনেক ধনী ব্যক্তি ও শাসক তাদের সোনা-রুপা-মূল্যবান সম্পদ-প্রভৃতি মন্দিরের কোষে হেফাজতে রাখতেন। আজকাল যেভাবে ব্যাংক লুট হয়। সেই যুগে একইভাবে মন্দিরের কোষাখানা বিজয়ীরা লুট করত। এটাকে কোনোভাবে মন্দিরের অসম্মান বা মন্দির লুট করা বোঝায় না।’ ভারতীয় ইতিহাসবিদরা এভাবে বহু ঘটন-অঘটনের বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা না করে সাম্প্রদায়িক দায় চাপিয়েছেন এবং তা করেছেন বিন্দুমাত্র অনুশোচনা-বোধ ছাড়া।

বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সেই চমৎকার পন্থার নির্দেশে সতীদাহ প্রথা ব্যাপকভাবে কমে গেলেও হিন্দু উচ্চবর্ণ শ্রেণী গোপনে বিধবা নারীদের জীবন্ত চিতায় পুড়িয়ে হত্যা করা চালিয়ে যেতে থাকে। পরে বহু সংস্কার এবং আইনগত বিধিবিধান প্রণয়ন করেও পুরোপুরি এ মর্মবিদারী ধর্মীয় প্রথা ভারতের অনেক জায়গায় ঘটতে থাকে, যে অভিশাপ থেকে ভারত আজ পর্যন্ত বের হতে পারেনি পুরোপুরি। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের মূলনীতির ওপর দাঁড়িয়ে ১৯৮৭ সালে ইন্ডিয়ান সতী (প্রোহিবিটিশন) অ্যাক্ট অব ১৯৮৭ প্রণীত হয়। এরও আগে শিখ ধর্মীয় গুরু অমর দাশ সতীদাহের মতো বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে এক বড় আন্দোলন গড়ে তোলেন। ব্রিটিশরাও আইন করে সতীদাহ প্রথা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে সাব্যস্ত করে (বেঙ্গল সতী রেুগুলেশন অ্যাক্ট অব ১৮২৯)। তবে এ আইনের কার্যকারিতা সীমিত ছিল কেবল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে। মুরশিদাবাদের কাসিমবাজারে পাতালেশ্বর শিবমন্দিরে যাগ-যজ্ঞের মাধ্যমে সতীদাহ প্রথা কার্যকর হতো। সেই হিম-শীতল নারকীয়তার কথা এখনো স্থানীয় জনগণ বংশ পরম্পরায় স্মরণে আছে। বহরমপুর আদালত এবং কাশিমবাজার রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে সেই সতীদাহ ঘাটলা বা সতীঘাটার স্মৃতিচিহ্ন এখনো রয়েছে। অথচ এ ধরনের পৈশাচিক জুলুমের প্রথার কথা কোনো বিশ্বস্ত হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্রে কোথাও কোনো উল্লেখ নেই। এটা ছিল নিতান্ত একটি সামাজিক অন্যায়, যা নিষ্ঠুরভাবে কার্যকর করত হিন্দু-সমাজপতিরা।

কলকাতায় ১৭৯৮ সালে সতীদাহ দাফতরিকভাবে রদ হওয়ার পরও নাকি এই কাসিমবাজার সতীঘাটায় জঘন্য নিষ্ঠুরতা বহু দিন ধরে চালু ছিল। অথচ কলকাতা থেকে বহরমপুরের কাসিমবাজারের দূরত্ব মাত্র ১৯৫ কিলোমিটার। এক জরিপে দেখা যায়, ভারতের অন্যান্য স্থানে গোপনে এবং আইনের চোখে ধুলা দিয়ে সতীদাহর প্রথা চলার পাশাপাশি শুধু ১৮১৭-১৮২৮ পর্যন্ত মাত্র ১১ বছরে হিন্দু বিধবা এ সতীঘাটার ১০০ জনের মতো অসহায় বলি হন যাদের এই রাক্ষুসী কায়দায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। ১৮০৩ সালে ব্রিটিশ নিয়োগ পেয়ে রাজা রামমোহন রায় এসেছিলেন কাসিমবাজারে। কালীগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই সতীঘাটায় এ ধরনের অমানবিক পৈশাচিকতার অবসান কল্পে উদ্যোগ নেন রাজা রামমোহন।

প্রথাবিরোধী আইনকে নির্বাহী আদেশ জারি করে দমন করেন তৎকালীন বড় লাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। বাংলায় মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠিত থাকাকালে হিন্দু সমাজপতিরা নিষ্ঠুর এই প্রথা অতি গোপনে এবং রাতের আঁধারে স্বামীর চিতার আগুন নতুন করে জ্বালিয়ে নেশাগ্রস্ত বিধবাদের জোর জবরদস্তি ধরে এনে সহমরণের চিতায় তুলত। বিধবার প্রাণভিক্ষার আকুল প্রার্থনা, এমনকি তার সন্তানদের মায়ের প্রাণভিক্ষার কোনো ফরিয়াদেও মন গলত না ধর্মান্ধ হিন্দু সমাজপতিদের। রামাই পণ্ডিত প্রাচীন শূন্য পুরাণের ওপর ভিত্তি করে যে ধর্মশীলা বিধান প্রণয়ন করেছিলেন, সেসবের প্রতিও অবজ্ঞা দেখাত রক্তপিপাসু হিন্দু-সমাজপতিরা। ১৭৭০ সাল নাগাদ বড় লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনামলে বাংলায় যখন বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন হিন্দু সমাজপতিরা সেই খাদ্যসঙ্কটের জন্য হিন্দু নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মে এবং ইসলামে ধর্মান্তরের মতো প্রবণতাকে দায়ী করতে থাকে। সেই সামাজিক সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে এই ‘সতীদাহ প্রথা’ চালু করতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সমাজপতিরা এ জন্য ঠাকুর-পুরোহিতদের মন জয় করতে তাদের সম্মানী বা রুজি-রোজগার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয় এবং নেশা-উপকরণের ছড়াছড়ি ফেলে দেয়।

বর্ণ হিন্দু বাবু বুদ্ধিজীবী এবং ইতিহাস ‘আবিষ্কারকরা’ মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের শান্তিপূর্ণ পন্থায় সতীদাহের মতো কুপ্রথা বন্ধের কৃতিত্ব ইতিহাস থেকে নির্বাসন দিয়ে ৩০০ বছর পরের সংস্কারক যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শ্রীরামচন্দ্র পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখকে সতীদাহ প্রথা নির্মূলে কৃতিত্ব প্রদান করেন। অথচ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেটি করেছেন সেটি হলো বিধবা বিয়ের পক্ষে জনমত গঠন। সতীদাহ প্রথা তখনো দেদার চলছিল ভারতবর্ষের গ্রাম-গ্রামান্তরে। আমাদের জেলা যশোরে সাতক্ষীরা যাওয়ার পথে যশোর থেকে ৮-৯ কিলোমিটার দূরে একটা জায়গা আছে, যার নাম সতীঘাটা। জনশ্রুতি রয়েছে, ১৯৪০-এর দশকেও এখানে স্বামীর চিতায় জ্যান্ত হিন্দু বিধবা মহিলাদের ধরে ধরে পোড়ানো হতো। এমনকি ঢাকা শহরে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে একসময় নরবলি দেয়া হতো!

উচ্চবর্ণ হিন্দু সমাজপতিরা কেবল যে মুসলিমবিদ্বেষী তাই-ই নয়, স্বধর্মের নিম্নবর্ণের মানুষকেও তারা কোনো দিন ভালো চোখে দেখেনি। এই জাতপাত-বর্ণবৈষম্য তাদের মজ্জাগত। ভারতের পৌনে ২০০ বছরের ব্রিটিশ দখলিরাজ্যে এই উচ্চবর্ণ হিন্দু সমাজপতিদের ঘৃণা বিদ্বেষ-শোষণ-লুণ্ঠন-ভোগদখল সীমাহীন পর্যায়ে চলে যায়। ব্রিটিশদের ভারত দখলে তারা সহযোগিতার অর্ঘ্য উজাড় করে দিয়েছিল। তারই এনাম পেয়েছে তারা রাজানুগ্রহ, নিষ্কর মুসলিমদের জায়গা জমি, বসতভিটে দখল করে এবং রাজা-মহারাজা-মনসবদার-মহালদার-হাওলাদার প্রভৃতি উপাধি-প্রাপ্তিতে। ইংরেজি রপ্ত করে ব্রিটিশ সরকারি চাকরি-ঠিকাদারি-সরবরাহ আদালতে আইনপেশা রমরমা হয়ে ওঠে তাদের। মুসলিম প্রজাদের নিষ্পেষণ এবং কলকাতায় বসে ছড়ি ঘোরানো কমে যাওয়ার আশঙ্কায় তারা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রুখে দাঁড়ায়। উথলে ওঠে তাদের দেশপ্রেম এবং দেশমাতৃকার ভক্তি।

অথচ এ দেশের প্রথম আজাদী সংগ্রাম ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালে তারা স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের সমূলে বিনাশে হেন কোনো সহযোগিতা নেই, যা করেনি ব্রিটিশদের। এই ঐতিহাসিক অপকর্মে বাংলার তথাকথিত বর্ণহিন্দু সমাজপতিদের সত্যিকার দোসর ছিল মারাঠিরা।

আমাদের দেশের মানুষ মনে রেখেছেন মারোয়াড়ি পুঁজিপতি বেনিয়াদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন কার্ল মার্কস, ফরাসি দার্শনিক ফাঁনো প্রমুখ। ব্রিটিশরা তাদের জুলুম হিসেবে নিন্দা কুড়িয়েছে সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েলের। মামলুকদের বিরুদ্ধে মিসর যতটা নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে, উত্তর আফ্রিকায় ফরাসিরা যা করেছে; লুটপাট ও শোষণ করেছে বাংলার ‘কম্পাডর’ ও ‘বেনিয়া মারোয়াড়ের বণিক গোষ্ঠী। তারা সুদখোর মহাজন হিসেবে বাংলার সমাজজীবন তছনছ করেছে। এই মারোয়াড়ি কুসিদজীবীরা দোষ চাপিয়েছে ওয়ারেন হেস্টিংসের ওপর। কিন্তু কাজ করেছে এই মহাজনেরা, যারা ছিল জগৎশেঠ, রাজা রায়দুর্লভদের বংশধর।

১৭৫৭ সালে মীর জাফর আলী খান বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, ইতিহাসে তার পুরোপুরি সত্যতা মেলে না। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতাকে রাজা বায়দুর্লভ, জগৎশেঠেরা লর্ড ক্লাইভের হাতে তুলে দিয়েছিল। এর আগে তরুণ নবাব সিরাজ যখন আলিপুর ও সুতানটিতে ইংরেজ বণিকদের দুর্গ হামলা করেন, তখন ৭৬ বছর বয়সী সেনাপতি মীর জাফর আলী খান নবাবের এ সিদ্ধান্ত এ জন্য মেনে নিতে পারেননি যে, ইংরেজরা মুঘল সম্রাটের দরবার থেকে বাণিজ্যের লিখিত অনুমোদন (খিলাত) নিয়ে এসেছিল। বৃদ্ধ সেনাপতি তরুণ নবাবকে এ কথা বোঝাতে পারেননি যে, ভারতের সার্বভৌমত্ব মুর্শিদাবাদে নয়, ছিল দিল্লি, ফতেহপুর সিক্রি কিংবা আগ্রায়। সেই অর্থে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল হতো। তবে মীর জাফরের উচিত ছিল পদত্যাগ করে অবসরে যাওয়া কিংবা বিনাযুদ্ধে পলাশী ত্যাগ না করে যুদ্ধ চালিয়ে সামান্যসংখ্যক ইংরেজ ও তাদের পালা-পোষা স্থানীয় সৈনিকদের কবর রচনা করা। সেনাপতির এ ভুলের খেসারত দিতে গিয়ে শুধু বাংলা নয়, গোটা মুঘল বাদশাহীর পতন ঘটে।

তুর্কি ওসমানীয় সালতানাত (অটোমান এম্পায়ার) এবং ভারতের মুঘল বাদশাহীর পতন আজকের জগতের দুই বিষফোঁড়া-ইহুদিবাদ (জায়নিজম) এবং ভারতের আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদের জন্ম দিয়েছে। জগতের ওপর নেমে আসে প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বীভিষিকা। অথচ গোটা দুনিয়া যখন তুর্কি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে; তখন ভারতবর্ষে আমাদের মুসলমান পূর্বপুরুষরা তুর্কি খেলাফত পুনরুদ্ধারে সংগ্রামে নামেন, যার নাম ঐতিহাসিক খেলাফত আন্দোলন। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ে দেশে ফিরে তরুণ মোহাম্মদ জিন্নাহ এ খেলাফত আন্দোলনের হাল ধরেন মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীকে সরিয়ে। জিন্নাহর যুক্তি ছিল তুরস্কের মুসলিম ওসমানীয় সালতানাত পুনরুজ্জীবনের দায়িত্ব হিন্দু নেতা গান্ধী পালন করবেন কিভাবে এবং কোন যুক্তিতে?

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক