অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জন-আশা

অন্তর্বর্তী সরকার এমনভাবে এগোবে যাতে জাতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে না হয়। অনিশ্চয়তা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।

নয়া দিগন্ত

জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে স্বাধীনতা-পরবর্তী এক বছরের মাথায় আমাদের যে সংবিধান রচিত হয় তার মূল ভিত্তি ছিল জনপ্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোয় অনুষ্ঠিত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে দেশের শাসনক্ষমতা পরিচালনার অধিকার লাভ করে। কিন্তু বৈধ কারণ ছাড়া তা থেকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে বঞ্চিত করায় রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির আবির্ভাব।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মের পর আওয়ামী লীগ দেশের শাসনভার গ্রহণ করলে জনগণের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় যে, নবীন রাষ্ট্রটি জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হবে। কিন্তু জনগণের সে আশায় প্রথম ছেদ পড়ে যখন দেখা গেল, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনকে প্রভাবিত করে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে বিজয় নিশ্চিত করার এক অশুভ খেলায় মত্ত হয়। সে নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করত। কিন্তু অশুভ খেলার পরিণতি যে কত ভয়াবহ হতে পারে সেটি উপলব্ধি করতে হয়তো দলটির একটু সময় লেগেছিল। শেখ মুজিব সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করলেও মতলববাজ বামপন্থীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মৃত্যুর ছয় মাসাধিককাল আগে নিজের দীর্ঘ দিনের লালিত গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের সিদ্ধান্তটি যে ভুল ছিল তিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেও তার অনুসারীরা কি তা থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছিলেন? আর না পারায় দেখা গেল, তাদের দ্বারা জন-আশা পূরণ বারবার ব্যাহত হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত-পরবর্তী ১৯৭৫ সাল থেকে জিয়াউর রহমান নিহত অবধি ১৯৮১ সাল ছিল ঘাত-প্রতিঘাত পরিপূর্ণ ও ঘটনাবহুল। শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা-পরবর্তী খন্দকার মোশতাককে তিন মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে অবমাননাকর ও লাঞ্ছিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। রাজনীতির মাঠে জিয়াউর রহমানের আগমন ছিল আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। বস্তুত ঘটনাপ্রবাহ তাকে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করে। সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ-পরবর্তী ধীরে ধীরে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ জিয়াউর রহমানের হাতে চলে এলেও সেনাবাহিনীর হারানো শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তাকে প্রতিনিয়ত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। সেনা কর্মকর্তা থেকে রাজনীতিক হিসেবে আবিভর্ূত জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে বড় সাফল্য বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার। জিয়াউর রহমান সব দলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃসূচনা করেন। কিন্তু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা নির্মমভাবে নিহত হলে পুনরায় তার মৃত্যুর এক বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে দেশ সামরিক শাসনের কবলে পতিত হয়। দ্বিতীয়বারের মতো দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ছেদ পড়ে। আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা-পূর্ব গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও দ্বিতীয় দফায় দেশ সামরিক শাসনের কবলে পতিত হলে সে সামরিক শাসকের ক্ষমতা গ্রহণকে শুভ হিসেবে দেখে দলটি। তখন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব শেখ হাসিনা বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘আই এম নট আনহ্যাপি’। এই সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ প্রায় ১০ বছরের শাসনামলে যুগান্তকারী কিছু প্রশাসনিক সংস্কার আনলেও সামগ্রিকভাবে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করে এক কলঙ্কময় ইতিহাস রচনা করেন। তার শাসনামলে এ দেশে ১৯৮৬ সালের তৃতীয় এবং ১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উভয় নির্বাচনের কোনোটিতে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে সরকার গঠিত হয়নি। তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন প্রধান দু’টি বিরোধী দলের অন্যতম বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করার কথা না থাকলেও, দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের ‘যে দল নির্বাচনে যাবে সে দল হবে জাতীয় বেঈমান’-এমন উক্তিকে কালিমায় আবৃত করে বিএনপিকে অনেকটা বিপদে ফেলে, অকস্মাৎ দলটি নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছিল। নির্বাচনটিতে যদিও জনমতের প্রতিফলনে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের কথা ছিল; কিন্তু কূটবুদ্ধিসম্পন্ন সামরিক শাসকের পাতানো জালে পা ফেলে শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে সামরিক শাসকের দল জাতীয় পার্টির দুই-তৃতীয়াংশের অধিক আসনে জয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুতের সহযোগী হিসেবে ছিল।

নির্বাচনবিরোধী যৌথ আন্দোলনের পিঠে সওয়ার হয়ে কেন হঠাৎ আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছিল; সেটি আজো রহস্যাবৃত। বিএনপির এ নির্বাচন বর্জন তাৎক্ষণিক বিবেচনায় ক্ষতিকর মনে হলেও পরিণামে যে শুভ ফলদায়ক ছিল, বাংলাদেশের ইতিহাসে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে দলটির বিজয় তার ইঙ্গিতবহ। এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে দেশের বড় দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে একতরফা মাঠে পাতানো ও সাজানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাসদ গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সময়কে এ দেশে গণতন্ত্রের নবযাত্রা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার অভিপ্রায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দল নিজ নিজ সুবিধাজনক স্থানে থাকাবস্থায় আন্তরিকতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অতীতের ১৯৯১ সালের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচন এবং ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন তুলনামূলক বিচারে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণসহ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও পরাভূত দল নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে- এমন স্বীকৃতি দেয়নি। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নবম যে সংসদ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়, সে নির্বাচনে প্রায় ৮৮ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি বাস্তবতার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হলেও নির্বাচনে বিজিত দল ফল মেনে নেয়ায় বিজয়ী দল সংসদের নির্ধারিত মেয়াদকাল পাঁচ বছর পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিল। নির্বাচনটি পরবর্তী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় সরকারের যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এর কোনোটিতে এত অধিক হারে ভোট প্রদান এ দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেননি, যদিও সচরাচর অঞ্চলভিত্তিক প্রার্থীদের ব্যক্তিগত উদ্যোগের কারণে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার অধিক হয়ে থাকে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-পরবর্তী দলীয় সরকারের অধীনে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ যে তিনটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে নির্বাচনগুলো গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাপকাঠিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বলার অবকাশ নেই। তা ছাড়া এ নির্বাচনগুলোর প্রথমটিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের জন্য উন্মুক্ত ৩০০টি আসনের অর্ধেকেরও বেশি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাচনটি যে আদৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল না সে বিষয়ে কারো মধ্যে কোনো সংশয় নেই। অবশিষ্ট অর্ধেকের কম আসনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে ভোটার উপস্থিতির তুলনায় যে ভোটের হার দেখানো হয়েছে; তা দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। একাদশ সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট আনুষ্ঠানিক ভোট গ্রহণের নির্ধারিত তারিখের পূর্ববর্তী রাতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও দলীয় নেতাকর্মীদের সহায়তায় সম্পন্ন করায় যেকোনো মানদণ্ডের বিচারে এটিকে কোনোভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন বলার অবকাশ নেই। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিক করে দেন দলীয় ও বিরোধীদলীয় প্রার্থী কে হবেন এবং কাকে নির্বাচনে বিজয়ী করা হবে। বস্তুত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এমন তিনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও প্রহসনমূলক নির্বাচনের আয়োজন করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির দাবি- দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না, এটি প্রতিষ্ঠিত করেছে।

পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ অবসানে কী পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- এটি একটি মীমাংসিত বিষয়। আমাদের দেশে এটিকে মীমাংসিত করে স্থায়ী রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হলেও সেটি যেকোনো কারণে হোক, দীর্ঘকালের জন্য ফলপ্রসূ হতে পারেনি। যে আশা ও লক্ষ্য নিয়ে প্রথমত ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ এবং দ্বিতীয়ত পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে এ দেশে জন-আশার প্রতিফলনে স্বল্পসংখ্যকবার সরকার গঠনের পর মেয়াদ পূর্ণতায় পুনঃনির্বাচনের সময় আগত হয়েছে, তখনই দেখা গেছে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে অশুভ উদ্যোগ। এ অশুভ উদ্যোগের কাছে জন-আকাঙ্ক্ষা বারবার পরাভূত হয়েছে।

দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জন-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে আওয়ামী লীগের তথাকথিত বিজয় হলেও এ বিজয় যে গৌরবের ছিল না তা দেশের সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এ নির্বাচন তিনটির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কপালে যে কলঙ্কের তিলক লেগেছে তা সহজে মুছবার নয়।

গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ন্যূনতম সংস্কার-পরবর্তী সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। সে আয়োজনের পথে তারা প্রকৃতপক্ষে অগ্রসর হচ্ছেন কি না কিংবা কতটুকু আগ্রহী তা সামনের দিনে বোঝা যাবে। অন্তর্বর্তী সরকার এমনভাবে এগোবে যাতে জাতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে না হয়। অনিশ্চয়তা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের আগামী দিনের কর্মসূচি ও কার্যাবলির ওপর দেশের ভাগ্য নির্ভর করছে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক