কেপি শর্মা ওলি প্রথম দফায় ২০১৫ সালে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের পর ভারতনির্ভরতা কমাতে চীনের সাথে বাণিজ্য ও পরিবহন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সে সময় সরকারগঠনে ওলিকে সমর্থন জুগিয়েছিল নেপালের একীভূত কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী), রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি, মাদেশি অধিকার ফোরাম এবং অন্যান্য ১৩টি ছোট দল। অতঃপর নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি ২০১৬ সালের ১৩ জুলাই জোট সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে এবং ১৪ জুলাই অনাস্থা প্রস্তাব আনে। এর ধারাবাহিকতায় জোটের অন্তর্ভুক্ত অপর দু’টি বড় দল রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি ও মাদেশি অধিকার ফোরাম জোট সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে। এর ফলে ২৪ জুলাই, ২০১৬ ওলি পদত্যাগ করেন।
দেশটিতে ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ওলি সমর্থিত সিপিএন-ইউএমএল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ওলি ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। অতঃপর ২০২১ সালের ১০ মে আস্থা ভোটে ব্যর্থ হয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারান। এরপর আদালত শের বাহাদুর দেউবাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের নির্দেশ দিলে ওলির তৃতীয় মেয়াদ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে দাহাল সরকার আস্থা ভোটে ব্যর্থ হওয়ার পর ওলি নেপালি কংগ্রেসের সাথে মিলে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। শের বাহাদুর দেউবার সাথে পালাক্রমে ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তির অধীনে তিনি সরকার পরিচালনা শুরু করেন। তবে তার সরকারের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সেই সাথে তা দ্রুত দুর্নীতিবিরোধী জেন-জি আন্দোলনে রূপ নেয়। দেশব্যাপী বিক্ষোভ, সহিংসতা ও আন্তর্জাতিক চাপে ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সালে ওলি পদত্যাগ করেন।
নেপালের কিছু তরুণ-তরুণীর একটি ভাইবার গ্রুপ থেকে জেন-জি আন্দোলনের সূত্রপাত। প্রথমে কবিতা ও সৃজনশীল প্রতিবাদের মাধ্যমে এ আন্দোলনের পরিকল্পনা করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর সরকার ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউবসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা দিলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ভাইবার গ্রুপের সদস্যসংখ্যা ১৫-২০ থেকে বেড়ে ৩০০ অতিক্রম করে।
৮ সেপ্টেম্বর হাজারো মানুষ কাঠমান্ডুর মৈতিঘর মন্ডলা থেকে সংসদ ভবনের উদ্দেশে মিছিল শুরু করেন। কিন্তু শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অদৃশ্য শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটে, যাদের মধ্যে কেউ অসন্তুষ্ট রাজনৈতিক কর্মী, জীবিকার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল তরুণ বা ডানপন্থী রাজতন্ত্রী বা হিন্দুত্ববাদী। দিন শেষে ৭২ জন নিহত হন। আহত হন শত শত। পরদিন কারফিউ অমান্য করে মানুষ আবার রাস্তায় নামেন। স্লোগান ওঠে ‘ওলি চোর, দেশ ছাড়’। মুহূর্তে আগুন জ্বলে ওঠে সংসদ ভবনে, সুপ্রিম কোর্টে, আইন-সভা ভবনে এবং এমপিদের ঘর-বাড়িতে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করে আত্মগোপনে চলে যান। কংগ্রেস নেতা শের বাহাদুর দেউবা ও তার স্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অর্জু দেউবাকে টেনে বের করার ভিডিও ভাইরাল হয়।
প্রধানমন্ত্রী ওলির পদত্যাগের পর ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ নেপালের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। একই দিনে সংসদ ভেঙে দিয়ে আগামী মার্চে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন।
নেপালের নতুন নেতৃত্বকে অভিনন্দন জানাতে দেরি করেননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন- নেপালের ভাই-বোনদের শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে বিশ্লেষকদের অভিমত, ভারতের এই কূটনৈতিক উদ্যোগ অবশ্যই বড় ভাই হিসেবে হস্তক্ষেপমূলক মনে না হওয়ার মতো হতে হবে। কারণ, অতীতে ভারতের এমন আচরণে নেপাল ও বাংলাদেশকে চীনের ঘনিষ্ঠ করেছে।
গত এপিলে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের পহেলগামে এক হামলায় ২৬ ভারতীয় নিহত হন। এ ঘটনার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে দেশটিতে বিমান হামলা চালায়। তাছাড়া বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারত চলে যাওয়ার পর দিল্লির সাথে ঢাকার সম্পর্কেও টানাপড়েন শুরু হয়েছে। এর মধ্যে গত মার্চে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের পর বাংলাদেশের সাথে বেইজিংয়ের সম্পর্ক আরো গভীরতর হয়। ওই সফরে উভয় দেশ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ চীন থেকে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি লাভ করে।
গত এপ্রিল বেশ কিছু ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে, চীন ভারতের পূর্ব-সীমান্তের কাছাকাছি বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলায় একটি বিমানঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনায় রয়েছে, যা ভারতের চিকেনস নেক নামের শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে অবস্থিত।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এটি প্রথমে ছাত্রদের নেতৃত্বে সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেও পুলিশি দমন-পীড়নে বিপুলসংখ্যক ছাত্রসহ সাধারণ মানুষ নিহত হলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের কঠোর ও মনগড়া শাসনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নেয়।
প্রথম দিকে আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল ঢিলেঢালা। ছাত্রনেতারা আলটিমেটাম ও দাবি পেশ করছিলেন। বিরোধী দলগুলো তাদের সহায়তা করছিল। হাসিনা সরকারের দমননীতি, ছাত্রদের ওপর নিষ্ঠুর হামলা থেকে শুরু করে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটানো পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত করে তোলে। অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতে পালিয়ে যান।
শ্রীলঙ্কার আন্দোলনের জন্ম হয় বাংলাদেশের আন্দোলনের দুই বছর আগে দেশটির অর্থনৈতিক পতন থেকে। ২০২২ সালের মার্চে দেশটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। দৈনন্দিন জীবন হয়ে ওঠে দুঃসহ। ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং, জ্বালানি ও গ্যাসের দীর্ঘ লাইন আর মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
তরুণরা শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের সামনে তৈরি করেন বিক্ষোভ কেন্দ্র। এটি ছিল প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকশের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ। জায়গাটি হয়ে ওঠে সমাবেশ, শিল্পকর্ম আর বক্তৃতার কেন্দ্রস্থল। এর আগে গোতাবায়া পরিবার ১৫ বছর দেশ শাসন করে। ২০২২ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি রাজাপাকশে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে বিক্ষোভকারীরা তার সরকারি বাসভবন দখল করে নেন।
নেপালি তরুণরা শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের আন্দোলন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এই জেন-জি আন্দোলন আলাদা কিছু নয়; বরং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি গভীর হতাশা থেকে এর জন্ম। এই তিন দেশের আন্দোলনের মূল কারণ বৈষম্য আর দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণী। এ শ্রেণী তরুণ প্রজন্মের বাস্তব চাওয়া-পাওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এই তিন দেশে জেন-জিরা জীবনে দু’বার বৈশ্বিক মন্দার মুখোমুখি হয়েছিলেন। প্রথমটি ছিল ২০০৮-৯ সালে। অপরটি কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে। মহামারীর দুই বছর তারা কাটিয়েছেন বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। বাহ্যিকভাবে বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে থাকলেও সে সময় তারা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বাড়িয়ে দেন অভাবনীয় মাত্রায়। আর তখন এ প্রজন্মকে শাসন করছিলেন অনেক বেশি বয়সী নেতারা। যেমন- শ্রীলঙ্কার রাজাপাকশে ছিলেন ৭৪ বছর বয়সী, বাংলাদেশের হাসিনা ৭৬ আর নেপালের ওলি ৭৩।
এ তিন দেশে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বয়স ২৮ বছরের নিচে। মাথাপিছু আয় বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অনেক কম হলেও সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশের বেশি। আন্দোলনগুলো জাতিগত বা বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো দাবি ছিল না বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে গড়ে ওঠায় দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছে।
এসব দেশে বাইরে থেকে শুধু ক্ষোভের ছবি দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে ভেতরে আছে গণতন্ত্রের প্রতি আকাক্সক্ষা, রাজনীতিতে অংশ নেয়ার ইচ্ছা, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের দাবি আর নির্বাচিত নেতাদের জবাবদিহি করানোর প্রত্যাশা।
নেপালের বিক্ষোভকারীরা রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানদের বিলাসীজীবন এবং বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ মেনে নিতে পারেননি। বিক্ষোভকারীদের অভিমত, এ সুযোগ তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় ছিলেন। সেনানিরাপত্তায় ৯ দিন কাটানোর পর তিনি কাঠমান্ডু থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ভক্তপুর জেলার গোন্ডু এলাকার একটি ব্যক্তিগত বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওলি দাবি করেন, পুলিশকে কখনো তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেননি। হত্যায় ব্যবহৃত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র পুলিশের কাছে ছিল না বলে তার দাবি। আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আয়োজকরা নিজেরা স্বীকার করেছেন, আন্দোলনে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা সহিংসতা সৃষ্টি করেছে। তদন্তে বেরিয়ে আসুক কারা সেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করেছে।’
৯ সেপ্টেম্বরের অগ্নিকাণ্ডে নেপালের সাবেক মাওবাদী প্রধানমন্ত্রী প্রচন্দের বাড়িও পুড়ে যায়। যিনি একসময় রাজতন্ত্র ভেঙে সমাজতান্ত্রিক নেপালের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। বিপ্লব পরবর্তী পুরনো শাসনব্যবস্থার প্রতিনিধিত্বকারী আটটি প্রধান রাজনৈতিক দল নেপালের জনগণের দাবি করা সংস্কারের পক্ষে কোনো মতামত প্রদান করেনি। উল্টো তারা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সুশীলা কার্কির নিয়োগকে অসাংবিধানিক বলে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এ থেকে বুঝা যায়, পুরনো দলগুলো এখনো সময়ের পরিবর্তন ও বিপ্লব পরবর্তী অবস্থা বুঝতে ব্যর্থ কিংবা পরিবর্তন মেনে নেয়নি।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক



