অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের রায় চূড়ান্ত

২০২৫ সালের ৪ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল আলোচিত একটি সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জের নিষ্পত্তি করেন।

২০২৫ সালের ৪ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল আলোচিত একটি সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জের নিষ্পত্তি করেন। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট আদালতের দেয়া অন্যতম আলোচিত এ পরামর্শমূলক মতামতটি অবৈধ ঘোষণা করার জন্য বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ মহসীন রশিদ আদালতের কাছে আবেদন করেছিলেন। এই ঐতিহাসিক মতামতের মাধ্যমে আদালত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারকে বৈধ ও সাংবিধানিক ঘোষণা করেছিলেন।

জনাব রশিদের অভিযোগটি ছিল অত্যন্ত গুরুতর। তিনি দাবি করেন, উল্লিখিত মতামতটি ছল-চাতুরির মাধ্যমে আদালতের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছিল। তার মতে, এ ক্ষেত্রে যথাযথ নোটিশ দেয়া হয়নি; সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের পরামর্শমূলক এখতিয়ার প্রক্রিয়াগতভাবে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়নি; সেই সাথে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো- বিচারকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে মতামতে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। মহসীন রশিদের এ আবেদন জনগণের আস্থায় সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। সেই সাথে চলমান সাংবিধানিক উত্তরণকে অস্থিতিশীল করার আশঙ্কা তৈরি করছিল। তবে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এর যথার্থ জবাব দেয়। এ ছাড়া হাইকোর্ট বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ উভয় বিষয়কে যথাযথ গুরুত্বের সাথে আমলে নেন। একই সাথে চূড়ান্তভাবে জনাব রশিদের আবেদন খারিজ করে দেন। এ প্রবন্ধে, আমরা মহসীন রশিদের অভিযোগ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের ওই রায়গুলো বিশ্লেষণ করব।

২০২৪ সালের ৯ আগস্ট সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, আপিল বিভাগ ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট সংবিধানের ১০৬ নং অনুচ্ছেদের অধীনে একটি পরামর্শমূলক মতামত দেন, যার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আপিল বিভাগের এ বিশেষ পরামর্শমূলক ক্ষমতা, উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় মাত্র তৃতীয়বার প্রয়োগ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এ ক্ষমতা কেবল তখন প্রয়োগ করা হয়, যখন রাষ্ট্রপতি জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ কোনো আইনি প্রশ্নে আদালতের মতামত চান। এক পৃষ্ঠার একটি নথি অনলাইনে প্রচারিত হয়, যা কথিত মতামতের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়।

পরবর্তী সময়ে, ২০২৪ সালের ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ মহসীন রশিদ হাইকোর্ট বিভাগে সশরীরে উপস্থিত হয়ে একটি রিট আবেদন দাখিল করেন, যেখানে তিনি ওই মতামতের সত্যতা চ্যালেঞ্জ করেন। তার আবেদনে দু’টি ঘোষণা চাওয়া হয় প্রথমত, তিনি দাবি করেন, মতামতটি অবৈধভাবে আদায় করা হয়েছে; যথাযথ নোটিশ দেয়া হয়নি। এ ছাড়া বিচারকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন, ১৯৭২ সালের সংবিধান কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে; তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে অবিলম্বে একটি প্রভিশনাল ইন্টেরিম কনস্টিটিউশন প্রণয়ন করতে হবে।

মোহাম্মদ মহসীন রশিদ তার আবেদনে অ্যাটর্নি জেনারেলের নিয়োগ সম্পর্কেও একটি পৃথক যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রপতি ২০২৪ সালের ৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ না নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ দেন, যা সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের বিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা সম্পর্কিত ১০৬ নং অনুচ্ছেদের অধীনে অনুষ্ঠিত শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের অংশগ্রহণের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ ছাড়া জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তবে মহসীন রশিদ স্পষ্ট করেন, তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ বা নিয়োগকে চ্যালেঞ্জ করছেন না; তার আপত্তি সীমিত ছিল আপিল বিভাগের প্রদত্ত মতামতের বৈধতা নিয়ে। হাইকোর্ট বিভাগে জনাব রশিদ আরো যুক্তি দেন, তিনি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি আইনি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। সেই নোটিশে জানতে চেয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে কথিত মতামত দেয়ার আগে আপিল বিভাগ সত্যিই কোনো শুনানি করেছিলেন কি না, তার প্রমাণ চাওয়া হয়। একই নোটিশে আরো জিজ্ঞাসা করেন, উপদেশমূলক মতামত জারির জন্য সঠিক নিয়মগুলো অনুসরণ করা হয়েছিল কি না এবং বিচারকদের ওপর কোনো চাপ বা জবরদস্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল কি না। জনাব রশিদের মতে, রেজিস্ট্রার জেনারেল কখনো এই প্রশ্নগুলোর সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেননি। তিনি এই নীরবতার ওপর নির্ভর করে ইঙ্গিত দেন, কোনো বেআইনি বা অন্তত পক্ষে ব্যাখ্যাতীত কিছু ঘটেছিল।

হাইকোর্ট বিভাগ ২০২৫ সালের ১২ জানুয়ারি মহসীন রশিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র এক দিনের ব্যবধানে, অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারি তা খারিজ করে দেন। এমন দ্রæত ও সারসংক্ষেপ খারিজের ঘটনা তখনই ঘটে, যখন আদালত মনে করেন, আবেদনে কোনো যুক্তিসঙ্গত আইনি ভিত্তি নেই। অর্থাৎ বিচারকমণ্ডলীর দৃষ্টিতে তার মামলা ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ডও স্পর্শ করেনি। মূল সঙ্কট ছিল তার যুক্তির অন্তর্নিহিত বৈপরিত্যে। এক দিকে তিনি ঘোষণা করলেন, সংবিধান ‘ধসে পড়েছে’। অন্য দিকে সেই ধসে পড়া সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে আদালতের দ্বারস্থ হলেন তিনি। আদালত তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন তোলেন, যদি সংবিধান সত্যিই অকার্যকর হয়ে থাকে, তবে তার বিধান ব্যবহার করে প্রতিকার চাওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়?

হাইকোর্ট বিভাগ আরো স্পষ্ট করে জানান, আপিল বিভাগ পরামর্শমূলক মতামত দেয়ায় সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন। সংবিধান অনুযায়ী এমন মতামতের জন্য দীর্ঘ, আনুষ্ঠানিক শুনানির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই; বরং পরামর্শমূলক এখতিয়ার প্রয়োগের সময় কতটুকু শুনানি প্রয়োজন, তা নির্ধারণের ক্ষমতা আপিল বিভাগের নিজের। আদালত যদি মনে করেন, শুধু অ্যাটর্নি জেনারেলকে শোনা যথেষ্ট, তবে অন্য কোনো আইনজীবী বা পক্ষকে ডাকার বাধ্যবাধকতা নেই। হাইকোর্ট বিভাগ আরো স্পষ্ট করে দেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা ওই কথিত ১০৬, এর মতামতের ওপর নির্ভরশীল ছিল না; বরং ২০২৪ সালের ঘটনাবলির পর জনগণের ইচ্ছা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক বৈধতা এসেছে। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক বৈধতার প্রশ্নটি সম্পূর্ণভাবে ওই বিতর্কিত মতামত থেকে আলাদা হয়ে যায়।

হাইকোর্ট বিভাগে মামলায় হেরে যাওয়ার পর, মহসীন রশিদ তার লড়াই আপিল বিভাগে নিয়ে যান। এখানে তিনি দাবি করেন, আপিল বিভাগ কখনো কোনো উপদেশমূলক মতামত জারি করেননি। তিনি আরো উল্লেখ করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত এক পৃষ্ঠার নথিটির কোনো আইনি অস্তিত্ব নেই, কারণ আদালতের সরকারি নথিপত্রে এ ধরনের কোনো মতামত খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটি নিশ্চিত করতে তিনি আপিল বিভাগকে নিজেদের নথিপত্র যাচাইয়ের অনুরোধ করেন। এরপর তিনি আরো গুরুতর অভিযোগ তোলেন- ব্যক্তিগত জ্ঞানের ভিত্তিতে দাবি করেন, একজন বিচারপতি নাকি চাপের মুখেও মতামতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এ অভিযোগ শুধু প্রক্রিয়াগত অসঙ্গতি নয়; এটি বিচারিক স্বাধীনতার মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং সর্বোচ্চ আদালতের অভ্যন্তরে সম্ভাব্য প্রাতিষ্ঠানিক ভয়ভীতি বা সম্ভাব্য হস্তক্ষেপেরও ইঙ্গিত দেয়।

আপিল বিভাগ মহসীন রশিদের সব যুক্তি খারিজ করে দিয়ে ২০২৫ সালের ৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি, তবে আদালত একটি বিষয় স্পষ্ট করেছেন, তারা হাইকোর্টের যুক্তির সাথে একমত। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো আইনি চ্যালেঞ্জের পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়; বরং এই আপিল মামলাটি অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান আরো শক্তিশালী করেছে। একই সাথে আইনের দৃষ্টিতে তার বৈধতা আরো দৃঢ় করেছে।

মামলা খারিজ হওয়া সত্তে¡ও মহসীন রশিদ এমন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যা পরামর্শমূলক মতামতের সাথে সংশ্লিষ্টদের জন্য ভবিষ্যতে অস্বস্তির কারণ হতে পারে। হাইকোর্ট বিভাগ বা আপিল বিভাগ, কোনোটিই মূল নথিপত্র পরীক্ষা করে দেখেননি যে, সংবিধানের ১০৬ নং অনুচ্ছেদের অধীনে কোনো মতামত বাস্তবিকই বিদ্যমান কি না। কোনো প্রত্যয়িত অনুলিপিও উপস্থাপিত হয়নি। মতামতের অস্তিত্বের প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে আদালত আইনি বিরোধ নিষ্পত্তি করলেও একটি অব্যাখ্যাত ফাঁক রয়ে গেছে। এই অমীমাংসিত দিক ভবিষ্যতে বিতর্কের উৎস হতে পারে- বিশেষত অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা পুনরায় যদি রাজনৈতিক বা আইনি চ্যালেঞ্জে পড়ে।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি