নারীর সামাজিক ভূমিকা ও কর্মসংস্থান নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা এখন ক্রমবর্ধমান। নারীর স্বাধীনতা, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা শুধু ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্যই নয়, বরং জাতির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও অপরিহার্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীর কর্মসংস্থানকে নির্দিষ্ট নিয়ম ও সময়সীমার আওতায় আনার চেষ্টা দেখা যায়, যা প্রায়ই রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় চেতনায় প্রভাবিত। সম্প্রতি একজন ইসলামিক রাজনীতিক ঘোষণা করেছেন যে, তারা ক্ষমতায় এলে নারীদের কর্মদিবস সর্বোচ্চ ৫ ঘণ্টায় সীমিত করা হবে। এই ঘোষণা কেবল একটি রাজনৈতিক বক্তব্যই নয়, এটি মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
নারীর কর্মসময় সীমিত করার ঘোষণা একটি রাজনৈতিক কৌশলগত উদ্যোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে বক্তব্যটি ইতিবাচক এবং তা সমাজের ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর কাছে সাদরে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এমন প্রতিশ্রুতি নির্বাচনী প্রচারণায় সামাজিক সংবেদনশীলতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যেতে পারে। যদিও বাস্তবে এই নীতির বাস্তবায়ন কিছু প্রশাসনিক ও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে, তবু, এটি নারীর মর্যাদা, পারিবারিক ভারসাম্য ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে ইতিবাচক বার্তা বহন করে। এ ঘোষণা রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্ম ও সামাজিক মূল্যবোধের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর কর্মসময় সীমিত করা একটি জটিল এবং সংবেদনশীল বিষয়। নারীর স্বাধীনতা এবং সমান অধিকার মানবাধিকার সনদ, জাতিসঙ্ঘের নীতি এবং আন্তর্জাতিক সমাজের মূল্যবোধের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। নারীর কর্মঘণ্টা পাঁচ ঘণ্টায় সীমিত করা হলে তা কেবল অর্থনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষেত্রেই নয়, মানবিক ও সামাজিক দিক থেকেও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। আধুনিক সমাজে নারী শিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন হলে তার কর্মজীবন শুধু পরিবারের আয় বৃদ্ধির জন্য নয়, বরং তার যোগ্যতা, প্রতিভা এবং আত্মসম্মান সমুন্নত করার দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে মনে হতে পারে, কর্মের সময় সীমিত করা মানে নারীর স্ব-উন্নয়ন ও আত্মনির্ভরতার সুযোগ সীমিত করা। এর ফলে মানসিক চাপ, আত্মমর্যাদাহীনতা এবং হতাশা বাড়তে পারে।
নারীর কর্মসময় সীমিত হওয়ার কারণে পরিবারের আর্থিক এবং গৃহস্থালির ভারসাম্যও পাল্টে যেতে পারে। পাঁচ ঘণ্টার কর্মসময় নারীর আয় কমিয়ে দিতে পারে, পরিবারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দুর্বল হতে পারে। পাশাপাশি পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ওপর বাড়তি চাপ পড়তে পারে, যা পারিবারিক মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্য এবং সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
নারীর কাজের সীমাবদ্ধতা পুরুষের সাথে অসমান দায়িত্ব এবং সামাজিক বৈষম্য তৈরি করতে পারে। নারীর আত্মপরিচয়, সৃজনশীলতা এবং সামাজিক অংশগ্রহণ সীমাবদ্ধ করতে পারে। নারীর কাজের মাধ্যমে শুধু আর্থিক স্বাধীনতা আসে এমন নয়, সামাজিক সংযোগ, আত্মবিশ্বাস এবং জীবনের অর্থময়তাও বাড়ে। পাঁচ ঘণ্টার কর্মসীমায় এই সুযোগ সীমিত হতে পারে। এক কথায়, নারীর কর্মসময় সীমিত করার ঘোষণার ফলে নারীর স্বাধীনতা, আত্মসম্মান, মানসিক স্বাস্থ্য এবং পারিবারিক ভারসাম্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। মানবাধিকার ও সমতার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে, যা সমাজ এবং পরিবারের মধ্যে সমতা, ন্যায় এবং সমমর্যাদা রক্ষায় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
বাস্তবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও নারীর কর্মসময় সর্বাধিক পাঁচ ঘণ্টায় সীমিত করা সহজ নয়। আধুনিক সমাজে নারীর কর্মক্ষেত্র বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিভিন্ন খাতে তাদের কাজের চাহিদা ও সময়কাল আলাদা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা, প্রশাসন, কল-সেন্টার, উৎপাদন এবং গৃহস্থালি কাজ- প্রতিটি ক্ষেত্রেই পাঁচ ঘণ্টার কর্মসীমা বেঁধে দেয়া কঠিন। শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নারীর কাজের সময় সীমিত করলে সার্ভিসের মান, কার্যক্ষমতা এবং জনগণের প্রাপ্য সেবা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ব্যবসা ও শিল্প খাতে নারীর অংশগ্রহণও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের উৎপাদন শিল্প ও গার্মেন্টস খাতে নারীর বড় অংশগ্রহণ রয়েছে। এই খাতে কার্যক্রম প্রায়ই ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত। পাঁচ ঘণ্টার সীমাবদ্ধতা বাস্তবায়িত হলে উৎপাদনশীলতা কমবে, শ্রমিক সঙ্কট সৃষ্টি হবে এবং শিল্প খাতের অর্থনৈতিক বিকাশ নেতিবাচক হতে পারে। প্রশাসনিক ও আইনগত চ্যালেঞ্জও বড়। শুধু নারীর জন্য পাঁচ ঘণ্টার কর্মদিবস বাস্তবায়নের জন্য নতুন আইন, নীতি ও নিয়ম প্রণয়ন করতে হবে। নিয়োগ, বেতন কাঠামো এবং কর্মসংস্থান নীতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে, যা প্রশাসনিক জটিলতা বাড়াবে।
আধুনিক বিশ্বে নারী সাধারণত পূর্ণকালীন কর্মে নিয়োজিত। আন্তর্জাতিক খাতেও নারীর অংশগ্রহণ একই স্তরে। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর কর্মসময় সীমিত করা অত্যন্ত সংবেদনশীল। সমাজে নারীর ভূমিকা শুধু অর্থনৈতিক নয়, পারিবারিক ও সামাজিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কর্মঘণ্টার সীমাবদ্ধতা পরিবার, পুরুষ-নারী সম্পর্ক, সামাজিক মর্যাদা এবং সমাজের বৃহত্তর কাঠামোতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আধুনিক পরিবারে নারীর দায়িত্ব শুধু গৃহস্থালির কাজ নয়, পরিবারের আয়ের একটি অংশও। পাঁচ ঘণ্টার সীমাবদ্ধতা মানে নারীর আয় ও পরিবারের আর্থিক সক্ষমতা হ্রাস পাবে। নারীর কাজের ঘণ্টা সীমিত হলে সমাজে পুরুষপ্রধান পেশার ধারণা জোরদার হতে পারে। এটি কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে পুরুষদের জন্য বেশি সুযোগ থাকে এবং নারীর অবদান হ্রাস পায়। এ ছাড়া সমাজে নারী ও পুরুষের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে।
সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা যায়, নারী ও পুরুষের মধ্যে ভারসাম্যহীন কর্মবণ্টন পরিবার এবং সমাজে বৈষম্য বাড়ায়। নারীর পাঁচ ঘণ্টার সীমা সামাজিক নিয়ম ও সংস্কৃতিতে একটি ‘নির্ধারিত’ ভূমিকা স্থাপন করতে পারে, যা নারীর স্বাধীনতা ও অংশগ্রহণ কমায়। শিশু ও যুবসমাজের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে। তারা দেখবে, নারীর কাজের সময় ও সামাজিক ভূমিকা সীমিত, যা ভবিষ্যতে সমতার মূল্যবোধকে দুর্বল করতে পারে।
নারীর শ্রমক্ষেত্রে অবদান দেশের মোট উৎপাদনশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক অর্থনীতি নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণকে সমর্থন করে। পাঁচ ঘণ্টার সীমাবদ্ধতা শ্রমবাজার সঙ্কুচিত করতে পারে। নারী উদ্যোক্তা এবং স্বাধীন পেশাজীবীদের ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ইসলামে নারী এবং পুরুষ উভয়ের অধিকার ও দায়িত্ব স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে। কুরআনে নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবারিক ভূমিকার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যা কিছু তোমরা খরচ করো, সে মহিলার জন্যই খরচ করো এবং যারা কোনো কাজ করে, আল্লাহ তার কাজকে দেখে থাকেন’ (সূরা আন-নিসা : ৩২)। এই আয়াত স্পষ্ট করে যে নারীও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং তার পরিশ্রম আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য।
নবী মুহাম্মদ সা: নিজ জীবদ্দশায় বহু নারীর বাণিজ্যিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকার সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেমন : খাদিজা বিনতে খুয়েইলিদ ছিলেন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী এবং তিনি নিজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে, ইসলামে নারীর অর্থনৈতিক কর্মজীবনে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, বরং সামাজিক ও নৈতিক দিকগুলো ঠিক রাখার শর্তে তার অংশগ্রহণ স্বীকৃত। তবে নারীর জন্য কর্মসময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসলাম মূলত স্বাস্থ্য ও পারিবারিক ভারসাম্যকে প্রাধান্য দেয়। ইসলাম মনে করায় যে, পরিবারের দায়িত্ব, সন্তান লালন-পালন এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভারসাম্য রাখতে হবে।
এই উদাহরণ দেখায় যে ইসলামে নারীর কাজের সময়সীমা প্রায়ই তার দৈনন্দিন দায়িত্ব ও সামাজিক ভূমিকার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখা হয়েছে।
নবী-রাসূলদের যুগের নারীদের জীবনযাত্রা থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, নারীকে সীমিত কিন্তু অর্থপূর্ণ কর্মসময় দেয়া হয়েছে। এটি আজকের সময়ে পাঁচ ঘণ্টার কর্মসময়ের ধারণাকে বৈধতা প্রদান করে। কারণ এটি নারীর দায়িত্ব, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং পারিবারিক ভারসাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সব শেষে বলা যায়, নারীর কর্মসময় সর্বাধিক পাঁচ ঘণ্টায় সীমিত করার প্রস্তাব রাজনৈতিক, সামাজিক, মানবিক, অর্থনৈতিক ও ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, তবে নারীর শারীরিক-মানসিক সুস্থতা, পারিবারিক ভারসাম্য ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় এটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে এটি নারীর স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা মনে হলেও, সঠিক নীতিমালা ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে নারীর মর্যাদা ও সুরক্ষা আরো সুদৃঢ় হবে। অর্থনৈতিকভাবে এটি প্রাথমিকভাবে শ্রমবাজারে প্রভাব ফেলতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে নারীর দক্ষতা ও পারিবারিক অবদান বাড়িয়ে অর্থনীতিতে ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে। তবে একবারে তিন ঘণ্টা সময় কমিয়ে নয়, বরং ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন ও নারীর উপযোগী কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিই হবে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট



