জাতীয় নিরাপত্তায় সামরিক বাহিনী

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেবল একটি সশস্ত্রবাহিনী নয়, এটি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় গৌরবের অতন্দ্র প্রহরী।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেবল একটি সশস্ত্রবাহিনী নয়, এটি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় গৌরবের অতন্দ্র প্রহরী। দেশ যখনই অভ্যন্তরীণ বা বহিঃশত্রুর হুমকির মুখে পড়ে, তখন সেনাবাহিনী সর্বাগ্রে দাঁড়ায় জাতির ঢাল হয়ে।

দেশের ভূখণ্ডের অখণ্ডতা ও সীমান্তে শান্তি বজায় রাখতে সেনাবাহিনী সদা প্রস্তুত থাকে। সম্ভাব্য যেকোনো বৈদেশিক হুমকির বিরুদ্ধে রণপ্রস্তুতি বজায় রাখে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বা জাতীয় সঙ্কটে জরুরি অবস্থায় সহায়তা করে। গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো যেমন, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, পারমাণু স্থাপনা ইত্যাদি নিরাপদ রাখে।

বিশ্বাস ও আস্থার উৎস

সেনাবাহিনী সংবিধান ও রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখে। জনগণের পাশে থাকার অঙ্গীকার রক্ষা করে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের ভরসার আরেক নাম। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, ভূমিধস বা অন্যান্য বিপর্যয়ে যখন সাধারণ মানুষ চরম দুশ্চিন্তায় থাকে, তখন সেনাবাহিনীর পোশাকে ভরসার আলো খুঁজে পায় গোটা জাতি।

সেনাবাহিনীর দুর্যোগকালীন কর্মকাণ্ড

দুর্গত এলাকায় জরুরি খাদ্য, পানি ও ওষুধ সরবরাহ করে ও উদ্ধার অভিযান চালায়। ডুবে যাওয়া ঘরবাড়ি থেকে শিশু, নারী, বৃদ্ধদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। মেডিক্যাল টিম মোতায়েন করে আহত ও অসুস্থদের তাৎক্ষণিক সেবা প্রদান করে। গৃহহীন মানুষের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা নেয়। দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্গঠনে সহযোগিতা করে, যেমন ব্রিজ, রাস্তা, সেতু মেরামত করে দেয়।

দুর্যোগে যখন কেউ পাশে থাকে না, তখন সেনাবাহিনী নীরব নায়ক হয়ে দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছুটে যায়, অন্ধকারে আলোর দিশা নিয়ে। সেনাবাহিনীর অটুট ভিত্তি শুধু অস্ত্রধারী বাহিনী নয়; বরং শৃঙ্খলা, সততা, দায়িত্ববোধ ও পেশাগত উৎকর্ষের এক উজ্জ্বল প্রতীক।

কঠোর প্রশিক্ষণ ও অভ্যাসের ফল সেনাবাহিনীর সদস্যদের জীবনযাপনে শৃঙ্খলা গেঁথে যায়। সময়ানুবর্তিতা, আদেশ পালন ও সুনির্দিষ্ট দায়িত্ববোধ তাদের প্রতিটি কার্যক্রমে প্রতিফলিত হয়। সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য কঠোর নিয়ম, আচরণবিধি ও দায়িত্বপালনের মাধ্যমে পেশাদার মানদণ্ড বজায় রাখেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিশনে কাজ করার সময় তারা যে শৃঙ্খলা ও দক্ষতার পরিচয় দেন, তা বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি করে।

জনগণের আস্থা কেন?

কারণ সেনাবাহিনী কখনো স্বার্থপর রাজনীতিতে লিপ্ত হয় না, তারা কাজ করে জাতির জন্য। কিছু ক্ষেত্রে হাসিনার আমলে ব্যতিক্রম হয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে যে, দায়িত্ব, সেবাব্রত ও সততা কেবল কথার বিষয় নয়, কর্মের মধ্যেই তা প্রকাশ পায়। তারা ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে থেকে দেশের জন্য কাজ করে, যা জাতিকে একত্রিত রাখে। এটি একটি জাতির সংহতির প্রতীক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল বা রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে কেবল একটি পরিচয় ধারণ করে- ‘বাংলাদেশ’।

সেনাবাহিনীতে দেশের প্রতিটি অঞ্চল, সম্প্রদায় ও শ্রেণিপেশার মানুষ যুক্ত। সেনাবাহিনী কোনো দল বা মতের পক্ষে নয়; বরং রাষ্ট্র ও জনগণের পক্ষে অবস্থান করে। যখন রাজনৈতিক বিভাজন সমাজে বিভ্রান্তি আনে, তখন সেনাবাহিনীর ভূমিকা হয় স্থিতিশীলতা ও আস্থার প্রাচীর। সেনাবাহিনীর ইউনিফর্মে লেখা থাকে না কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বা ধর্মীয় প্রতীক, তাদের পরিচয় শুধু একটাই ‘বাংলাদেশী’। এই পেশাদার মনোভাবই সাধারণ মানুষের মনে ভরসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান সৃষ্টি করে, ‘সেনাবাহিনী জাতির সব বিভেদ ভুলিয়ে এক পতাকার নিচে এনে দাঁড় করায়।

ইউনিফর্মের তাৎপর্য

এক টুকরো কাপড়ে গাঁথা জাতির আস্থা ও আত্মত্যাগের ইতিহাস : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম কেবল পোশাক নয়, এটি একটি জাতির সম্মান, সাহস, আত্মত্যাগ এবং আদর্শের বহিঃপ্রকাশ। এই পোশাকের প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে থাকে ঘাম, রক্ত, কঠিন প্রশিক্ষণ এবং নিঃস্বার্থ সেবার প্রতিশ্রুতি। ইউনিফর্ম পরা মানে শুধু চাকরি করা নয়, এটি জাতির জন্য জীবন দেয়ার শপথ। এটি স্মরণ করিয়ে দেয়- একজন সেনাসদস্য নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের কল্যাণে কাজ করেন।

এই পোশাক পরে প্রতিদিন শত শত সৈনিক পাহাড়, সীমান্ত, সমুদ্র কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন। তারা কখনো আলোচিত হন না; কিন্তু প্রতিটি সঙ্কটে নীরব আত্মত্যাগের ইতিহাস তৈরি করেন। ইউনিফর্ম দেখলেই মানুষ বিশ্বাস করে, ‘আমি নিরাপদ, কারণ সেনাবাহিনী এখানে আছে।’এটি যেন একটি চলমান প্রতিশ্রুতি, যে প্রতিকূলতার মধ্যেও সেনাবাহিনী জাতির সাথে আছে, প্রস্তুত আছে। ‘সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম এটি শুধু কাপড় নয়, এটি একটি জাতির আত্মার রঙে রঞ্জিত শ্রদ্ধার চিহ্ন।’

জনগণের প্রত্যাশা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ জনগণের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি আস্থার প্রতীক। তবে এই আস্থা টিকে থাকে একটি মূল ভিত্তির ওপর, নিরপেক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও সংবিধান-নিষ্ঠতা।

দেশের জনগণ চায়, এই সম্মানিত ইউনিফর্ম কখনো দলীয় রাজনীতির হাতিয়ার না হোক। সেনাবাহিনী যেন সর্বদা রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে, কোনো দল বা গোষ্ঠীর জন্য নয়। জনগণ আশা করে সেনাবাহিনী সংবিধানের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য বজায় রাখবে।

আইনের শাসন এবং মানবাধিকার রক্ষা সেনাবাহিনীর অবস্থানের অন্যতম মূল স্তম্ভ হিসেবে দৃঢ় থাকবে। জনগণের চোখে একজন সেনাসদস্য মানে দায়িত্বশীল, ন্যায়পরায়ণ ও নিরপেক্ষ একজন রক্ষক। সেনাবাহিনী যেন সবসময় জনগণের পাশে থাকে, নির্বিশেষে ধর্ম, বর্ণ বা রাজনৈতিক পরিচয়ের। ‘সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের ভালোবাসা তখনই অটুট থাকে, যখন তারা দলীয় রাজনীতি নয়, রাষ্ট্র ও সংবিধানের পক্ষে অবস্থান নেয়।’

সমুদ্রসীমা রক্ষা ও প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি

‘নদী এবং সমুদ্রে বাংলার অতন্দ্র প্রহরী, গর্বের প্রতীক বাংলাদেশ নৌবাহিনী।’ বাংলাদেশ নৌবাহিনী কেবল একটি সামরিক বাহিনী নয়, এটি একটি সমুদ্রসীমা রক্ষাকারী জাতীয় গর্ব। বাংলার উপকূল, নদ-নদী এবং সমুদ্রপথে তারা দাঁড়িয়ে আছে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক হুমকি মোকাবেলায় সর্বদা প্রস্তুত প্রহরী হিসেবে।

বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার বর্গকিমি বিস্তীর্ণ সামুদ্রিক অঞ্চল এবং এর বিশাল সম্পদ রক্ষায় নৌবাহিনী সর্বদা তৎপর। আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার বাস্তবায়নে দৃঢ় ভূমিকা পালন করছে।

অভ্যন্তরীণ নদীপথে নজরদারি

দেশের অসংখ্য নদীপথে অবৈধ পাচার, জলদস্যুতা ও চোরাচালান রোধে নিয়মিত টহল ও অভিযান পরিচালনা করে তারা। বন্যার সময় বা নদীবন্দর এলাকায় ত্রাণ ও উদ্ধারকাজেও অংশ নেয়। আধুনিক যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, হেলিকপ্টার ও প্রশিক্ষিত নাবিক বাহিনী গড়ে তুলে নৌবাহিনী আজ আন্তর্জাতিক মানের একটি শক্তিশালী ফোর্স। জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী মিশনে অংশগ্রহণ করে বিশ্বদরবারেও বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি করছে।

স্লোগানরূপে বলা যায় : ‘নদী আর সমুদ্রের ঢেউ পেরিয়ে যারা দেশকে আগলে রাখে, তারা আমাদের নৌবাহিনী, আমাদের গর্ব।’ ‘নৌ-পথে শান্তি, সার্বভৌমত্বে আস্থা, নৌবাহিনী সর্বদা প্রস্তুত।’

আকাশ রক্ষা

বাংলার আকাশ রাখিব শত্রুমুক্ত এই স্লোগানে সার্বভৌমত্বের অন্যতম গর্বের প্রতীক ‘বাংলাদেশ বিমানবাহিনী’। ‘বাংলার আকাশ রাখিব শত্রুমুক্ত’- এই স্লোগান কেবল একটি বাক্য নয়, এটি স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিরক্ষা সক্ষমতার এক বলিষ্ঠ অঙ্গীকার এবং তার সাথেই এই প্রতিশ্রুতি শুধু কথায় নয়, প্রতিটি অভিযান ও প্রস্তুতিতে প্রতিফলিত হয়।

দেশের আকাশে যেকোনো অনুপ্রবেশ ও হুমকির বিরুদ্ধে সর্বদা সতর্ক ও প্রস্তুত। আধুনিক যুদ্ধবিমান, রাডার এবং আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিয়ে নিরাপত্তার ঢাল রচনা করে তারা। দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও কৌশলগত মোতায়েনে সক্ষম। যেকোনো জরুরি মুহূর্তে দ্রুত মোতায়েনযোগ্য, হোক তা সামরিক হুমকি, দুর্যোগে সহায়তা, কিংবা মানবিক মিশনে।

প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক বাহিনী

মিগ, এফ-৭, সুপার মাশাক থেকে শুরু করে উন্নত রাডার সিস্টেম ও টঅঠ ব্যবস্থায় সজ্জিত একটি বিকাশমান প্রযুক্তিগত বাহিনী। দেশের প্রতিরক্ষাশিল্পে বিমানবাহিনী একটি দিকনির্দেশক শক্তি। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিমানবাহিনী বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে বিশ্বদরবারে।

স্লোগান ও বার্তা হিসেবে ব্যবহারযোগ্য : ‘বাংলার আকাশ রাখিব শত্রুমুক্ত’- এই আকাশেই উড়ছে আমাদের আত্মবিশ্বাস, আমাদের স্বাধীনতা।’

উচ্চশিক্ষা, উচ্চ প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণে বিকশিত বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী : বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী (অৎসু, ঘধাু, অরৎ ঋড়ৎপব) আজ আর শুধু সামরিক শক্তি নয়; বরং একটি উন্নত শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণসমৃদ্ধ পেশাদার বাহিনী হিসেবে বিকশিত হয়েছে।

উচ্চশিক্ষা ও অ্যাকাডেমিক উৎকর্ষ

বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (ইগঅ), নেভাল একাডেমি এবং এয়ার ফোর্স একাডেমি বিশ্বমানের সামরিক শিক্ষা প্রদান করে। ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ (উঝঈঝঈ), ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ (ঘউঈ), এসব প্রতিষ্ঠানে দেশী-বিদেশী কর্মকর্তারা অধ্যয়ন করেন। অফিসারদের অনেকে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে আন্তর্জাতিক মানে সমৃদ্ধ হন।

উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহারে সক্ষমতা

আধুনিক অস্ত্র, রাডার, ড্রোন, সাবমেরিন, কমব্যাট বিমান, স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন ইত্যাদির মাধ্যমে সশস্ত্রবাহিনী এখন প্রযুক্তিনির্ভর। সাইবার নিরাপত্তা, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ও ডিজিটাল যুদ্ধব্যবস্থা নিয়েও কাজ করছে প্রতিটি শাখা।

প্রশিক্ষণে পেশাদারিত্বের ছাপ

সেনাবাহিনীতে কমান্ডো, প্যারা, স্নাইপার, জঙ্গল ও মাউন্টেন ওয়ারফেয়ারসহ আন্তর্জাতিক মানের স্পেশাল ট্রেনিং হয়। নৌবাহিনীতে সাবমেরিন ও আন্ডারওয়াটার ট্রেনিং এবং বিমানবাহিনীতে অ্যাডভান্সড ফ্লাইট সিমুলেশন ও টেকনিক্যাল ট্রেনিং হয়।

সশস্ত্রবাহিনী যেহেতু রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাই তারা অবশ্যই জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহী রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাকে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার রাখেন। ‘আধুনিক জ্ঞান, প্রযুক্তি ও পেশাদারিত্ব, এই তিন ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী।’ ‘‘যুদ্ধে সাহস, শান্তিতে শিক্ষা, এটাই আধুনিক বাংলাদেশ ‘সশস্ত্রবাহিনী’ পরিচয়।”

লেখক : সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি, নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি