পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট বৈরিতা ও সঙ্ঘাত- এ দুই প্রতিবেশী দেশকে কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে তা নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ ও শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ার সময়েই কাতারে ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় যুদ্ধ তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। শান্তি আলোচনা বাস্তবে এই যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত বন্ধ করতে পারবে কি না এবং কেন কারা এই সঙ্ঘাতকে উসকে দিচ্ছে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ।
দোহা আলোচনায় শান্তি দু’দেশের মধ্যে আসবে কি না এই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর বলা যায়- শান্তি সম্ভব; কিন্তু কঠিন ও শর্তসঙ্কুল। কাতার-মধ্যস্থতায় হওয়া দোহা আলোচনায় এখনই যুদ্ধ বন্ধের তাৎক্ষণিক প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে; কিন্তু ওই বিরতি টেকাতে বা স্থায়ী শান্তিতে পরিণত করতে বেশ কয়েকটি কঠিন শর্ত পূরণ করতে হবে।
কী ঘটেছে
এ বছরে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত তীব্র সংঘর্ষে রূপ নেয়। পাক সেনাবাহিনী দাবি করে, আফগান ভূমি থেকে মেরোপে হামলা হয়েছে; আফগানপক্ষ বলছে, পাকিস্তান তাদের ভূখণ্ডে বোমা হামলা চালিয়েছে। এরপর পাকিস্তান একাধিক সীমান্ত চেকপোস্ট বন্ধ করে দিয়েছে যার মধ্যে তোরখাম ও চামান ছাড়াও খালরাচি, আংরু আডদা, ঘুলাম খান চেকপোস্ট রয়েছে। পরে কাতার ও অন্য মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় বসার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুসারে কাতার (সাথে তুরস্ক) মধ্যস্থতায় পাওয়া দোহা বৈঠকের পর পাকিস্তান ও আফগানিস্তান একটি তাৎক্ষণিক অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করেছে। পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্পষ্ট করেছেন, আফগান পক্ষ (তালেবান প্রশাসন) সীমান্ত থেকে সন্ত্রাসী দলগুলোর (টিটিপির) আক্রমণ রোধ করতে পারলেই এই স্থিতি টিকবে।
আল জাজিরাসহ বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার বিশ্লেষণ অনুসারে- এটি বাস্তবায়নযোগ্য তবে নাজুক বন্ধুত্ব; এর মূল সমস্যাগুলো ডুরান্ড লাইন-বিবাদ এবং টিটিপিসহ উপদলগুলোর নিয়ন্ত্রণ কিভাবে হবে এসব বিষয় অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। পরর্বর্তী তুরস্ক আলোচনায় এ বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য সামনে আসতে পারে। অক্টোবরের শুরুতে কাতারের রাজধানী দোহায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সীমান্ত সঙ্ঘাত বন্ধের লক্ষ্যে জরুরি শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। কাতার ও তুরস্ক যৌথভাবে এই প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করে। উভয় দেশই ‘তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা করে। তবে স্থায়ী শান্তি রক্ষায় বাস্তবায়ন ও আস্থা গঠনের কঠিন পরীক্ষা সামনে।
বাস্তবায়ন পরিকল্পনার পাঁচটি প্রধান ধাপ রয়েছে। এর প্রথম ধাপে রয়েছে- কাতার, পাকিস্তান, আফগান প্রতিনিধি নিয়ে যুদ্ধবিরতি যাচাই কমিটি গঠন। এর সাত দিন সময়সীমার মধ্যে সীমান্তে লঙ্ঘনের তাৎক্ষণিক তদন্ত করবে। দ্বিতীয় ধাপে টিটিপি ও অন্যান্য গোষ্ঠীর আশ্রয় যাচাই ও নিষ্ক্রিয়করণের মাধ্যমে আফগান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কাতারি পর্যবেক্ষক ৩০ দিন সময়সীমার মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করবে। ১০ দিনের মধ্যে ভুল তথ্য, আতঙ্ক ও গুলিবিনিময় প্রতিরোধে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ হটলাইন স্থাপন করা হবে। উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সমন্বয়ে ৬০ দিনের মধ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও অস্ত্র চলাচল নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে যৌথ টহল পরীক্ষামূলক চালু করা হবে। কাতার ও তুরস্ক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সমন্বয়ে কাতার-তুরস্ক মনিটরিং টাস্কফোর্স গঠন করে ৯০ দিনের মধ্যে চুক্তি অনুসরণ মূল্যায়ন ও রিপোর্ট জাতিসঙ্ঘে পাঠানো হবে।
মনিটরিং মেকানিজমের জন্য সাত দফা সুপারিশ করা হয়েছে। যাতে দ্রুত তথ্য যাচাই ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সীমান্তে ঘটা ঘটনার ১২ ঘণ্টার মধ্যে উভয় দেশকে তথ্য বিনিময় করতে হবে। নিরপেক্ষ তৃতীয়পক্ষ হিসেবে কাতার বা তুরস্কের প্রতিনিধি মাঠে পর্যবেক্ষণ করবে। কোনো বেসামরিক হতাহতের ঘটনায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দোহা মনিটরিং সেলে রিপোর্ট হবে। রাজনৈতিক যোগাযোগ চ্যানেল হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে মাসিক বৈঠক হবে যাতে সেনা সিদ্ধান্তের সাথে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা বজায় থাকে। ডুরান্ড লাইন নিয়ে যে মূল-বিবাদ তা নিরসনে টাস্কফোর্স করা হবে। দুই দেশের ইতিহাসবিদ ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ নিয়ে সীমান্ত চিহ্ন পুনর্মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হবে। সীমান্তবর্তী উপজাতিদের মধ্যে সঙ্ঘাত নিরসনে ঐতিহ্যবাহী জিরগা পদ্ধতি পুনরুজ্জীবিত করা হবে। আঞ্চলিক সমর্থন কাঠামোকে এর সাথে যুক্ত করা হবে যেখানে চীন, ইরান ও রাশিয়ার কূটনৈতিক সমর্থন যুক্ত করা হবে, যাতে আঞ্চলিক নিরাপত্তায় ফাঁক না থাকে।
আশা করা হয়েছে, ছয় মাসের মধ্যে এর সম্ভাব্য ফলাফল হিসেবে সীমান্ত স্থিতি আসতে পারে। ৬০ শতাংশ পর্যন্ত হিংসা হ্রাস পেতে পারে। তবে ঝুঁকি হলো- টিটিপি আক্রমণ অব্যাহত থাকলে পুনরায় যুদ্ধ হতে পারে। রাজনৈতিক আস্থা পুনরুদ্ধারে দ্বিপক্ষীয় সংলাপ শুরু করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাতার ও তুরস্কের ভূমিকা প্রশংসিত হতে পারে। তবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে, সেটি নিশ্চিত নয়।
পাকিস্তানের উদ্বেগ
পাকিস্তানি মিডিয়া ও বিশ্লেষকরা একাধিকবার জানিয়েছেন, পাকিস্তান আজ ‘আতঙ্কিত’ কারণ, তারা মনে করছে, আফগানিস্তান তাদের বিরুদ্ধে ‘হেভি হোস্টিং গ্রাউন্ড’ হতে পারে। গার্ডিয়ান লিখেছে- এক পাকিস্তানি কর্মকর্তা বলেছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের জন্য আফগান মাটির বিশ্বাসঘাতকতামূলক ব্যবহার আমরা সহ্য করব না।
আফগানিস্তান থেকে উদ্ভূত সন্ত্রাসবাদের হুমকি সম্পূর্ণরূপে নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র বিশ্রাম নেবে না। অর্থাৎ- পাকিস্তানি মিডিয়া সেভাবে দেখছে, সীমান্তে সামরিক দিক থেকে ‘নতুন ভারসাম্য’ তৈরি হচ্ছে। সীমান্ত চেকপোস্ট বন্ধের খবর পাক সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছে, কারণ এটি শুধু সেনা বিষয় নয়- বাণিজ্য ও মানুষের চলাচলে বড় প্রভাব ফেলে। রয়টার্সের রিপোর্টে বলা হয়েছে- ‘সঙ্ঘাতের পর তোরখাম এবং চামানের প্রধান ক্রসিং বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পাক মিডিয়াতে বলা হয়েছে, সীমান্ত বন্ধ হওয়ার কারণে পাকিস্তান-আফগান ব্যবসায়ী ও ট্রানজিট রুট বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
ভারতের ভূমিকাকে ঘিরে আলোচনা
বিশ্লেষকরা অনেকেই বলছেন, এই সীমান্ত উত্তেজনার পেছনে শুধু দু’টি দেশ নেই; বরং সেখানে ভারতের কূটনৈতিক উপস্থিতি ও ভূমিকা একরকম ব্যাকগ্রাউন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। লামন্ডের একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে- ‘পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত সম্প্রতি মারাত্মক সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তালেবান সরকারের প্রতি ভারতের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছে।’
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ও বিশ্লেষকরা ভারতকে ‘আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকারী’ হিসেবে দেখছে, যা নিজেদের কৌশলগত অবস্থানকে সঙ্কুচিত করতে পারে। একাধিক পাকিস্তানি বিশ্লেষক মনে করছেন, তারা আফগানিস্তানের সাথে যে ‘গভীর কৌশলগত সম্পর্ক’ ধরে রেখেছিলেন তা আজ আগের মতো নেই। এই পরিবর্তনের পেছনে ভারতের হাত ও আফগান সরকারের ভূমিকাও আছে। ওয়াশিংটন পোস্ট-জিআই জিকেডবিøউইউর রিপোর্টে বলা হয়- পাকিস্তান এবং আফগান তালেবানের মধ্যে সম্পর্কের তীব্র অবনতি হয়েছে, ইসলামাবাদ উদ্বিগ্ন, পাকিস্তান তালেবানকে চিরতরে হারাতে পারে।
তালেবান ২০২১ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই ভারত তাদের সাথে যোগাযোগে ছিল সতর্ক। পূর্ববর্তী আফগান সরকার- বিশেষ করে আশরাফ ঘানির সময়ে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ছিল। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর ভারতের দূতাবাস বন্ধ হয়ে যায় এবং দিল্লি মানবিক সহায়তার বাইরে কূটনৈতিক সংযোগ ছিন্ন রাখে। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি থেকে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা এবং মানবিক সঙ্কটের মুখে তালেবান নেতৃত্ব ভারতের সাথে নতুন করে যোগাযোগ শুরু করে। তারা দিল্লিকে আমন্ত্রণ জানায় আফগান পুনর্গঠনে অংশ নিতে এবং কিছু ভারতীয় প্রকৌশল প্রকল্প আবার চালুর প্রস্তাব দেয়। ভারতও কাবুলে আংশিক কূটনৈতিক মিশন ফের চালু করে।
ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানকে তার ‘পশ্চিম ফ্রন্ট’ হিসেবে ব্যবহার করেছে, যাতে ভারতীয় প্রভাব ওই অঞ্চলে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু এখন ভারতের ফিরে আসা পাকিস্তানের ঐতিহ্যগত নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ভারতের জন্য আফগানিস্তান কেবল ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক বন্ধন নয়; বরং একটি ভূরাজনৈতিক করিডোর। দিল্লি অনেক আগে থেকেই পাকিস্তানকে বাইপাস করে ইরান-আফগান রুটে মধ্য এশিয়ার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে চেয়েছে। চাবাহার বন্দর প্রকল্প ও ‘ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রানজিট করিডোর’ সেই পরিকল্পনার অংশ।
আফগানিস্তান এই পরিকল্পনার সাথে যুক্ত হলে ভারত একদিকে পাকিস্তানের ভূখণ্ড এড়িয়ে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশাধিকার পাবে, অন্যদিকে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) একটি প্রতিসাম্য তৈরি হবে। চীন অবশ্য এতে উদ্বিগ্ন। কারণ, আফগানিস্তান যদি ভারতীয় বিনিয়োগ গ্রহণ করে, তবে তা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একাংশকে দুর্বল করতে পারে। আফগানিস্তানে ভারতের অবকাঠামো/সাহায্য-প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত খেলার অংশ হয়ে উঠছে। এই দৃষ্টিতে পাকিস্তানি মিডিয়ায় লেখা হয়েছে- পাকিস্তান যেন ‘দ্বিখণ্ডিত’ হয়ে পড়ছে।
পাক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ও আফগান প্রভাব
এ বছরের আগস্টে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ইউএস-পাকিস্তান সন্ত্রাসবিরোধী সংলাপ এই অঞ্চলে নতুন কৌশলগত অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দুই দেশ এ উপলক্ষে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে, যেখানে উভয় পক্ষ সীমান্ত নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবিরোধী তথ্য ভাগাভাগি, আর্থিক লেনদেন ট্র্যাকিং এবং অপারেশনাল সহযোগিতায় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও একই সময়ে একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে, দেশটি সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে।
এই বোঝাপড়া আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ককে অনেক দিক থেকে প্রভাবিত করছে। প্রথমত, সন্ত্রাসবিরোধী অংশীদারি আফগান সীমান্তে পাকিস্তানের কৌশলগত অবস্থানকে কঠোর করেছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় পাকিস্তান আফগান মাটিতে সক্রিয় গোষ্ঠী টিটিপির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিক। এর ফলে ইসলামাবাদ আফগান প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে যেন তারা পাকিস্তানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় না দেয়। তবে আফগান প্রশাসন এই পদক্ষেপকে ‘বিদেশী প্রভাবের হস্তক্ষেপ’ হিসেবে দেখতে পারে, যা দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়াতে পারে। দ্বিতীয়ত, সীমান্ত নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত নজরদারি নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ড্রোন নজরদারি, তথ্য ভাগাভাগি ও সীমান্ত-নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাড়াচ্ছে। আফগান পক্ষ ইতোমধ্যেই কিছু পদক্ষেপকে ‘সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন’ হিসেবে দেখেছে। সীমান্তে এমন কার্যক্রম যদি অব্যাহত থাকে, সম্ভাব্য সংঘর্ষ বা উত্তেজনা বেড়ে যেতে পারে।
তৃতীয়ত, এই সম্পর্কের কারণে তালেবান প্রশাসনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়ছে। ২০২১-এর পর পাকিস্তান তালেবানকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন ঘনিষ্ঠতা ইসলামাবাদকে দ্ব›দ্বপূর্ণ অবস্থানে ফেলেছে- তাদের শর্ত মেনে কাজ করলে তালেবানকে বিশ্বাসঘাতক মনে হতে পারে, আর না করলে যুক্তরাষ্ট্রের আস্থা হারাবে। চতুর্থত, আফগান সরকার ও জনগণের দৃষ্টিতে এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা- ‘যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি না থাকলেও ইসলামাবাদের মাধ্যমে আঞ্চলিক প্রভাব রক্ষা করছে।’ এটি আফগান নেতাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব তীব্র করতে পারে। পঞ্চমত, আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও রাশিয়া এই নতুন ঘনিষ্ঠতাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। তারা মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের মাধ্যমে আফগানিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা প্রভাবের ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে। ফলে পাকিস্তান এখন বহু শক্তির মধ্যে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার চাপে রয়েছে।
পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র নতুন কৌশলগত সম্পর্ক আফগান সীমান্তে পাকিস্তানের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করছে, তবে আফগানিস্তানের সাথে দ্বিমুখী সম্পর্ককে জটিল ও অনিশ্চিত করছে। সীমান্ত নিরাপত্তা, গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি এবং সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে পাকিস্তান সুবিধা পেতে পারে। কিন্তু বাস্তবায়ন নির্ভর করছে উভয় দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপের উপর, আফগান সীমান্তে সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে সফলতার উপর এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়ার উপর। এক্ষেত্রে পাকিস্তানকে দ্বিমুখী ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব ধরে রাখতে হবে, অন্যদিকে আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব সংবেদনশীল অবস্থান সম্মান করতে হবে। এই ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারলে, আফগান সীমান্ত আবারো দক্ষিণ এশিয়ার নতুন উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে।
তিনটি ভবিষ্যৎ পরিণতি-দৃশ্য
কাতার-মধ্যস্থতায় পাক-আফগান শান্তি আলোচনা যুদ্ধ তাৎক্ষণিকভাবে থামাতে সক্ষম হলেও স্থায়ী শান্তি নির্ভর করছে আফগান ভূখণ্ডে সন্ত্রাসী আশ্রয় দমনে তালেবানের কার্যকর পদক্ষেপের উপর, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ ও যাচাইপ্রক্রিয়ার সাফল্যের উপর এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐকমত্যের উপর। যদি এই তিনটি স্তম্ভে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া যায়, তবে ২০ বছরের সীমান্ত-সঙ্ঘাত নতুন শান্তির পথে মোড় নিতে পারে।
সর্বোত্তম (২৫-৩৫ শতাংশ) দৃশ্যপট : এ চিত্র অনুসারে স্থায়ী নিরস্ত্রীকরণ ও প্রাথমিক শান্তি আসতে পারে। এটি হতে পারে যদি তালেবান টিটিপির উপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করে (বা টিটিপি আত্মসমর্পণ/বিচ্ছিন্ন হয়), মনিটরিং মেকানিজম কাজ করে এবং সীমান্ত-সঙ্ঘাত কমে। শর্তগুলো বাস্তবায়িত হলে সীমান্তে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও কাতারের মধ্যস্থতায় একটি পুনরায় সংলাপ রোডম্যাপ সম্ভব হবে। কাতার সরকার এটি প্রত্যাশা করে।
অধিক সম্ভাব্য (৪০ থেকে ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা) দৃশ্যপট : এই চিত্র অনুসারে অস্থায়ী স্থিতি বা ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি হবে। বড় আক্রমণ বন্ধ থাকবে; কিন্তু ছোটখাটো গুলিবিনিময়-ঘটনা চলতে থাকবে; তালেবানের ক্ষমতা সীমিত এবং কিছু প্রাদেশিক যোদ্ধাগোষ্ঠী পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে থাকায় তাৎক্ষণিক দমনে ধীর অগ্রগতি হবে। আল জাজিরা ও অন্য একটি বিশ্লেষণে এই সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে।
নিম্নতম সম্ভাব্য (বাজে ক্ষেত্রে- ১৫ থেকে ২০ শতাংশ) দৃশ্যপট : রয়টার্সের মতে, শর্ত ভঙ্গ হলে বা কোনো বড় তৎপরতা হলে স্বল্প-সময়েই হিংসা ফেরত আসতে পারে; বিশেষত যদি কোনো সাইডে বড় আক্রমণ/সুইসাইড হামলা ঘটে। পাকিস্তান ইতোমধ্যে বলেছে, যদি আফগান মাঠ থেকে আক্রমণ চলে তবে তা তারা সহ্য করবে না; তাই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হলে ফের সঙ্ঘাতের উত্থান ঘটতে পারে।
মূল ঝুঁকি সৃষ্টিকারক টিটিপি ও স্থানীয় মিত্রগোষ্ঠী যদি সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ চালায়, শান্তি সহজে ফিরে আসবে না। ডুরান্ড লাইন-বিবাদ ও সার্বভৌমত্ব-ইস্যু মৌলিক রাজনৈতিক বিতর্ক থাকলে মিলিটারাইজড সমাধান কার্যকর হবে না। তবে আফগান পরিস্থিতির সাথে আন্তর্জাতিক শক্তির যোগসূত্র সবচেয়ে জটিল চিত্র তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে কাতার-তুরস্কের উদ্যোগ ইতিবাচক সম্ভাবনা যেমন তৈরি করেছে, তেমনিভাবে এখানে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা অনেক জটিল সমীকরণও তৈরি করতে পারে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত