ইব্রাহীম খলিল সবুজ
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং সবাই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। কিন্তু আমাদের এই ছোট্ট বদ্বীপের ভেতরেই পাহাড় ও সমতলে আইনের প্রয়োগে রয়েছে বিশাল ও বেদনাদায়ক ফারাক। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রচলিত ‘প্রথাগত আইন’ বা কাস্টমারি ল অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর এর সবচেয়ে বেশি বলি হচ্ছে নারী ও শিশুরা।
সমতলে যখন ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে, তখন পাহাড়ের চিত্র অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন। সেখানে হেডম্যান বা কারবারি শাসিত সামাজিক বিচারব্যবস্থায় এমন গুরুতর অপরাধকেও অনেক সময় ‘সামাজিক অপরাধ’ হিসেবে লঘু করে দেখা হয়। অভিযোগ রয়েছে, কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রথাগত বিচারে ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির মতো ঘটনার নিষ্পত্তি করা হয় অবিশ্বাস্য রকমের লঘু দণ্ডে। অপরাধীকে কেবল কিছু টাকা জরিমানা বা ভোজের আয়োজন এবং সামাজিক শুদ্ধাচারের নামে সামান্য কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে বলা হয়। সবচেয়ে আঁতকে ওঠার মতো বিষয় হলো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষণের মতো পৈশাচিক অপরাধের ‘শাস্তি’ হিসেবে একটি শূকর জরিমানা করা হয়।
প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী, সেই শূকর কেটে তার রক্ত দিয়ে ভুক্তভোগী নারীকে গোসল করিয়ে দেয়া হয়। একে বলা হয় শুদ্ধিকরণ। প্রশ্ন হলো, এই পদ্ধতিতে কার শুদ্ধি হচ্ছে? যে ধর্ষক, সে কি তার কৃতকর্মের যথাযথ শাস্তি পেল? আর যে নারীটি নির্যাতনের শিকার হলেন, পশুর রক্ত দিয়ে গোসল করালেই কি তার মানসিক ট্রমা বা শারীরিক লাঞ্ছনা ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়? এটি যেন একজন নারীর সম্মানের সাথে চূড়ান্ত উপহাস।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে যখন আমরা নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবাধিকারের কথা বলছি, তখন দেশেরই একপ্রান্তে এমন বিচারব্যবস্থা চালু থাকা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটি স্পষ্টত মানবাধিকারের লঙ্ঘন। যখন কোনো অপরাধী জানে যে, নারীকে নির্যাতন করে কেবল কিছু টাকা বা গবাদিপশু জরিমানা দিয়েই পার পাওয়া যাবে, তখন সে অপরাধ করতে দ্বিধা বোধ করে না। এতে করে অপরাধী সংশোধিত হওয়ার বদলে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ভুক্তভোগী নারী ও তার পরিবার সামাজিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং বিচারহীনতার গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ বা হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়ালের মাধ্যমে এই প্রথাগত আইনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল মূলত ছোটখাটো সামাজিক বিরোধ, ভূমি ও পারিবারিক সমস্যা মেটানোর জন্য। কিন্তু হত্যা, ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের মতো ফৌজদারি অপরাধ কখনোই এই প্রথাগত সালিসের আওতায় আসার কথা নয়। তবুও বাস্তবতা হলো, দুর্গম এলাকা, অসচেতনতা ও প্রভাবশালী মহলের চাপে অনেক ফৌজদারি অপরাধ পুলিশ বা আদালতের কাছে পৌঁছায় না। গ্রাম্য সালিসেই নামমাত্র দণ্ডে তা ধামাচাপা দেয়া হয়। একে আমরা আদিবাসী সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে বৈধতা দিতে পারি না। সংস্কৃতি মানুষের কল্যাণের জন্য, মানুষকে অবমাননা করার জন্য নয়। যে প্রথা মানুষের মৌলিক মানবাধিকার হরণ করে, নারীকে পণ্য বা ভোগের বস্তু মনে করে, তা কখনোই ‘ঐতিহ্য’ হতে পারে না; তা হলো কুপ্রথা।
রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হলো তার প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পাহাড়ে বসবাসরত নারীরাও বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিচার বাংলাদেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ীই হতে হবে। প্রথাগত আইনের দোহাই দিয়ে কোনো অপরাধীকে রাষ্ট্রীয় কঠোর শাস্তি থেকে বাঁচিয়ে দেয়া সংবিধানের লঙ্ঘন।
এই অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের এখনই সোচ্চার হতে হবে। সমাধানের পথ কঠিন নয়, প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা। প্রথমত, সরকারকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা জারি করতে হবে, ধর্ষণ, হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধগুলো কোনোভাবেই হেডম্যান বা কারবারিদের সালিসি ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না। এগুলো সরাসরি রাষ্ট্রীয় আদালতের এখতিয়ারে আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় প্রথাগত নেতাদের আধুনিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা নিজেরাই এসব অপরাধ পুলিশ বা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করেন। তৃতীয়ত, দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় আইনি সহায়তা বা লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম জোরদার করতে হবে, যাতে ভুক্তভোগীরা নির্ভয়ে বিচার চাইতে পারেন।
এক দেশে দুই রকম বিচারব্যবস্থা চলতে পারে না। সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখা জরুরি, কিন্তু তা যেন ন্যায়ের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। শূকরের রক্তে নারীর অপমান ধুয়ে যায় না; বরং তা বিচারব্যবস্থার গায়ে কলঙ্কের দাগ লেপন করে। এই দাগ মুছতে হলে রাষ্ট্রকে তার আইনি শাসন নিয়ে পাহাড়ে পৌঁছাতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়



