রেমিট্যান্স প্রবাহ গতিশীল রাখতে হবে

খেয়াল রাখা দরকার প্রবাসীদের কষ্টের অর্থ যেন শুধু সঞ্চয় না হয়ে দেশের অর্থনীতির শক্তি বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে। এ জন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত, টেকসই ও বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক নীতি ও সংস্কার।

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়নের এ যুগে বিকাশমান প্রতিটি অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজির জোগান দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এটি আসে রফতানি আয় কিংবা বিদেশী বিনিয়োগ থেকে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস রফতানি ও প্রবাসী আয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, বৈদেশিক অর্থপ্রদানের ভারসাম্য রক্ষা ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দারিদ্র্যবিমোচন, স্থানীয় ব্যবসা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং গ্রামীণ ও সামগ্রিকভাবে জনগণের জীবনমান উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রায় এক কোটি ৫৫ লাখ অভিবাসী বাংলাদেশী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন এবং কর্মরত রয়েছেন। বিদেশে এদের কর্মসংস্থান না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ভয়াবহ বেকারত্ব সমস্যায় বিপর্যস্ত হতো তাতে সন্দেহ নেই।

কৃষি খাতের পর দেশের শ্রমশক্তির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে বিদেশে অভিবাসন। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এবং বেকার ও স্বল্প শিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় নিজেদের একান্ত প্রয়োজনে ও বেকারত্ব নিরসনে বাংলাদেশের জনশক্তির একটি অংশ বিদেশে পাড়ি জমায়। এদের অধিকাংশই অদক্ষ, অনভিজ্ঞ অবস্থায় প্রবাসে পাড়ি জমালেও এরাই দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে। বেশির ভাগ প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বসবাস ও কাজকর্ম করছেন। ২০২৪ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৫৫ থেকে ৬০ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মরত। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রায় ৮০-৯০ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী বসবাস করছেন এবং প্রায় সব দেশেই তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ১৮ শতাংশ বর্তমানে বিদেশে কর্মরত রয়েছেন। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এই প্রবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি : প্রবাসী আয় বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি করে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করে, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট (ইধষধহপব ড়ভ চধুসবহঃং) স্থিতিশীল রাখে। এটি দেশের বৈদেশিক অর্থপ্রদানের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ : বৈদেশিক মুদ্রার প্রাচুর্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেমিট্যান্সের প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের গ্রামগুলোতে দেখা যায়, অনেক পরিবারের যুবকরা বিদেশে থাকে। মা বাবা ভাই বোন তাদের দৈনন্দিন জীবনের ভরণপোষণ, লেখাপড়া সবকিছুই চলে প্রবাসী ভাইদের আয়ে।

জিডিপিতে অবদান : মোট দেশজ উৎপাদনে (এউচ) রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। জিডিপিতে রেমিট্যান্সের একটি ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে, কারণ এটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায়, দারিদ্র্য বিমোচন করে, জীবনযাত্রার মান উন্নত করে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। এটি দেশের মুদ্রানীতি ও রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতেও সাহায্য করে।

দারিদ্র্যবিমোচন ও জীবনমান উন্নয়ন : রেমিট্যান্স সরাসরি দারিদ্র্য হ্রাস এবং পরিবারগুলোর জীবনযাত্রারমান উন্নয়নে সহায়তা করে। স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ স্থানীয় পর্যায়ে খরচ হয়, যা ক্ষুদ্র ব্যবসা, পণ্য সংগ্রহ এবং সেবার চাহিদা বাড়িয়ে স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি : স্থানীয় দোকানদার এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা রেমিট্যান্স ব্যবহার করে নতুন সেবা ও ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন, যা নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ: প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ অনেক পরিবার শিক্ষা, আধুনিক স্বাস্থ্য সুবিধা গ্রহণ এবং পুষ্টিমান বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে পারে।

সামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়ন : প্রবাসীদের পাঠানো এ অর্থ দেশের আর্থসামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা নিয়ে আলোচনাটা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। যদিও দেশীয় শ্রমবাজারে শ্রমশক্তির চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়হীনতার কারণে প্রবাসের শ্রমবাজার আমাদের শ্রমশক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স সামষ্টিক অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করছে, তাদের পাঠানো অর্থ দারিদ্র্যবিমোচন, খাদ্যনিরাপত্তা, শিশুর পুষ্টি ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

রেমিট্যান্স প্রবাহ ও অর্থনীতির গতি : স্বৈরাচারী সরকারের পতনের আগে ও তার পরবর্তী নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অর্থনীতির সূচক যখন নিম্নমুখী তখন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিয়েছে। ২০২৫ সালের জুন মাসে একক মাসেই প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন রেকর্ড ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি শুধু একটি সংখ্যামাত্র নয়; বরং সঙ্কটে ন্যুব্জ অর্থনীতির বুকে আশার পুনর্জাগরণ।

একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার (তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। গত ১১ মাসে রিজার্ভ বেড়েছে ১১ বিলিয়নের বেশি। এই প্রবাহ অর্থনীতির চাকা শুধু সচল নয় গতিশীল করতে ভূমিকা রাখছে। অথচ প্রায় দেড় বছর আগে রিজার্ভ যখন নেমে গিয়েছিল ২০ বিলিয়নের নিচে- তখন বাজারে ছড়িয়ে পড়েছিল চরম অনিশ্চয়তা। ডলার-সঙ্কট, আমদানিজট, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতায় দেশের অর্থনীতির ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। মূল্যস্ফীতি দুই ডিজিটে ঘোরাঘুরি করছিল। পণ্য আমদানি বন্ধের মুখে বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিদেশী ঋণ পরিশোধ ও খাদ্যশস্য আমদানিতেও সরকার হিমশিম খাচ্ছিল। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনের ম্যারিয়ট মারকুইসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সই জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি একেবারে তলানিতে নেমে গিয়েছিল। রেমিট্যান্সই সেটিকে বাঁচিয়েছে।

প্রবাসীদের পাঠানো অর্থই আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার পেছনে কাজ করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এখন যখন রিজার্ভ বাড়ছে, রেমিট্যান্সে রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে, তখন এ রিজার্ভকে সঠিক পথে কাজে লাগাতে হবে। রিজার্ভের অর্থ কাজে লাগাতে হবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- রেমিট্যান্স বাড়লেও ব্যাংক খাতে গৃহীত ঋণের অনাদায়ী প্রবণতা, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও দুর্বল শাসনব্যবস্থা এখনো বড় বাধা হয়ে রয়েছে। বিনিয়োগে আস্থা ফেরেনি, নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না এবং বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি স্থবির। দেশে সর্বশেষ জুন মাসের শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় চার ভাগের এক ভাগের বেশিই এরই মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এখন প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার। ব্যাংক খাতকে দায়বদ্ধ করা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা এবং কর ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ করা ছাড়া এই অর্জন স্থায়ী হবে না।

অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে রেমিট্যান্স প্রবাহও গতিশীল রাখতে হবে। ব্যাংক ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) চ্যানেলের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংক শাখা ও রেমিট্যান্স অফিস সম্প্রসারণ এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সুযোগ বাড়িয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে সহজ ও দ্রুত রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে । ‘ওয়েজ আর্নার্স এমএফএস অ্যাকাউন্ট’ চালু করে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি ও প্রবাসীদের জন্য নিরাপদ অর্থ লেনদেন নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

হুন্ডি বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

মানিলন্ডারিং ও অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও শাস্তির ব্যবস্থা রেমিট্যান্সের প্রবাহকে বৃদ্ধি করেছে। এ ক্ষেত্রে মূল হুন্ডি চক্রের সদস্যদের শনাক্তকরণ ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা ছাড়া বিদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বেতন সময়মতো প্রদানের ওপর কড়া নজরদারি, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করা উচিত।

খেয়াল রাখা দরকার প্রবাসীদের কষ্টের অর্থ যেন শুধু সঞ্চয় না হয়ে দেশের অর্থনীতির শক্তি বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে। এ জন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত, টেকসই ও বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক নীতি ও সংস্কার।

লেখক : ব্যাংকার