বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত দেশের আর্থিক কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অথচ সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত অংশ। এই খাতের ওপর নির্ভর করে দেশের উৎপাদন, বিনিয়োগ, বাণিজ্য, কৃষি ও রফতানি কার্যক্রম। কেবল টাকা ধার দেয়া বা গ্রহণের প্রতিষ্ঠান নয়; ব্যাংক হলো অর্থনীতির রক্তসঞ্চালন ব্যবস্থা।
বর্তমানে ব্যাংকিং খাত জটিল ভারসাম্যহীনতার মধ্যে রয়েছে। দেশে ৬২টি ব্যাংক কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি। জনসংখ্যা ও অর্থনীতির আকার বিবেচনায় এই সংখ্যাটি বাস্তব চাহিদার তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ। ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ায়নি; বরং বাজারে অস্থিতিশীল প্রতিযোগিতা, অদক্ষতা ও ঋণ খেলাপির সংস্কৃতি বাড়িয়ে তুলেছে।
ব্যাংকিং খাতকে বলা হয় ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমের হৃৎপিণ্ড, যা স্থিতিশীলতা হারালে গোটা অর্থনীতি অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সেই অসুস্থতার লক্ষণ স্পষ্ট। দেশে ব্যাংকের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও নীতিগত অস্পষ্টতা। নতুন ব্যাংক অনুমোদনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক যুক্তির চেয়ে প্রায়ই রাজনৈতিক বিবেচনা মুখ্য হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নতুন ব্যাংক স্থাপনের পেছনে আর্থিক প্রয়োজন নয়; বরং স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর চাপই মুখ্য ছিল। ফলে ব্যাংকের সংখ্যা বাড়লেও ব্যাংকিং খাতের সার্বিক স্বাস্থ্য ও কর্মদক্ষতা বাড়েনি; বরং এ খাতে অদক্ষতা, অনৈতিকতা ও বিকৃত প্রতিযোগিতা বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশে কয়টি ব্যাংক থাকা যথাযথ তা নির্ভর করে মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর- জিডিপি, জনসংখ্যা ও আর্থিক বাজারের গভীরতা। বাংলাদেশের জিডিপি বর্তমানে ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এই আকারের একটি অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৫টি ব্যাংক যথেষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশে রয়েছে ৬২টি, যার অনেকগুলোই মূলধন ঘাটতির শিকার এবং সীমিত পরিসরে কার্যকর। প্রতিটি ব্যাংকেরই অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও গ্রাহকসেবার পরিধি দুর্বল। ‘GDP per bank’ সূচক অনুসারে প্রতিটি ব্যাংক গড়ে মাত্র সাত বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি পরিচালনা করছে, যেখানে ভারতের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৩১ বিলিয়ন ডলার, মালয়েশিয়ায় ২৮ বিলিয়ন ডলার, আর থাইল্যান্ডে প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ- বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত অতিবিক্ষিপ্ত ও কাঠামোগতভাবে দুর্বল।
এ অবস্থাকে অর্থনীতিবিদরা over-banking বা অতি-ব্যাংকিং বলে অভিহিত করেন। এর ফলে প্রতিযোগিতা ইতিবাচক না হয়ে ধ্বংসাত্মক রূপ নেয়। ছোট ব্যাংকগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে অনিরাপদ ঋণ প্রদান শুরু করে, অনেক ব্যাংক মুনাফার আশায় উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করে এবং কিছু ব্যাংক রাজনৈতিক প্রভাবে খেলাপি ঋণ মওকুফের মতো অনৈতিক চর্চায় জড়িয়ে পড়ে। এর প্রক্রিয়ায় গোটা ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা দুর্বল হয়ে যায়।
বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর কার্যকারিতার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো অপ্রদর্শিত ঋণ সমস্যা। তথ্য মতে, ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ দশমিক ৩০ লাখ কোটি টাকা এবং যা ব্যাংকিং সেক্টরের মোট ঋণের ২৭ শতাংশ। ধারণা করা হয়, খেলাপি ঋণের পরিমাণ যা দেখানো হয় বাস্তবে তা অনেক বেশি। কারণ রিস্ট্রাকচারিং ও রাইট-অফ পদ্ধতিতে অনেক ক্ষতকে গোপন বা আংশিক ঢেকে রাখা হয়। পর্যাপ্ত মূলধন বা দক্ষতার অভাব আছে এমন অনেক ব্যাংক নির্দিষ্ট বাজারে সীমিত কার্যক্রম চালায়। ডিজিটাল ব্যাংকিং এবং প্রযুক্তিনির্ভর সেবা সীমিত হওয়ায় গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ব্যাংক একীভ‚তকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে, যা কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সহায়ক, তবে পুরো দেশের ব্যাংক খাতের কার্যকর পুনর্বিন্যাসে যথেষ্ট নয়।
এ ছাড়া, ব্যাংকিং খাতের আরেকটি বড় সমস্যা হলো দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি। দক্ষ ব্যাংকার তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ফলে বড় ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন স্বল্পঅভিজ্ঞ ব্যবস্থাপকরা, যা প্রায়ই অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়ায়। ব্যাংকগুলোতে আর্থিক প্রযুক্তির ব্যবহারও তুলনামূলক কম। মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও ব্লকচেইনভিত্তিক লেনদেনের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হয়নি। একদিকে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে, অন্যদিকে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা বাড়ছে না, দ্বৈত বাস্তবতাই বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের দুরবস্থা প্রকট করেছে।
অতিরিক্ত ব্যাংকিং কেবল অর্থনৈতিক অদক্ষতা নয়, এটি আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য সরাসরি হুমকি। প্রতিটি নতুন ব্যাংক গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক মূলধন, পরিচালন ব্যয় ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে হয়। এই অতিরিক্ত ব্যয় শেষ পর্যন্ত গ্রাহকের ওপর প্রভাব ফেলে। ছোট ব্যাংকগুলোর পক্ষে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে এবং অনেকে তারল্য সঙ্কটে পড়ে। একাধিক ব্যাংকের সময়মতো আমানত পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার উদাহরণও রয়েছে, যা আর্থিক খাতের ওপর আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে।
এখন প্রশ্ন হলো- সমাধান কোথায়? বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত টেকসই ও শক্তিশালী করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার। দুর্বল ও ছোট ব্যাংকগুলোর একীভ‚তকরণ এখন সময়ের দাবি। দু’টি বা তিনটি ছোট ব্যাংক একীভূত করে একটি বৃহৎ, মূলধন-সমৃদ্ধ ব্যাংকে রূপান্তর করলে পরিচালন দক্ষতা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উভয়ই উন্নত হবে। একই সাথে ব্যাংকিং খাতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও স্বশাসিতভাবে ব্যাংক অনুমোদন, পরিচালনা ও পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা দিতে হবে।
তা ছাড়া, ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রসার বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ব্যাংকিং সুবিধা থেকে বঞ্চিত। মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং ও ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো গেলে ব্যাংকের ওপর চাপ কমবে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়বে। ফিনটেক বা আর্থিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাংকগুলোর আধুনিকায়ন করতে পারলে ব্যাংক না বাড়িয়েও সেবা সম্প্রসারণ সম্ভব।
বিশেষায়িত ব্যাংকের ধারণাও বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক। কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই), সবুজ শিল্প ও রফতানি খাতভিত্তিক ব্যাংকগুলো নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক অর্থায়নের মাধ্যমে অর্থনীতির উৎপাদনশীল খাতগুলোকে সহায়তা করতে পারে। তবে এ ধরনের ব্যাংকও দক্ষতা ও জবাবদিহির কাঠামোর আওতায় থাকতে হবে, যাতে তারা আরেকটি রাজনৈতিক প্রকল্পে পরিণত না হয়।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এখন সংখ্যা নয়, গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন। উত্তরণের উপায় হলো ছোট ও অদক্ষ ব্যাংকগুলোর সংযুক্তিকরণ, ডিজিটাল ব্যাংকিং স¤প্রসারণ, প্রযুক্তিনির্ভর সেবা বৃদ্ধি এবং বিশেষায়িত ব্যাংক স্থাপন। এ ছাড়া কার্যকারিতার নিয়মিত মূল্যায়ন, মূলধনের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মান উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে আরো কার্যকর, স্থিতিশীল ও জনসংখ্যার চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা সম্ভব।
সারসংক্ষেপে, বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা এবং কার্যকারিতার মধ্যে বিদ্যমান অমিল সমাধান করলে ব্যাংকিং খাত দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগ ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি সুসংগঠিত ব্যাংকিং খাত গড়ে তোলা বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। উল্লেখ্য, একটি ছোট কিন্তু সক্ষম ব্যাংক খাতই অর্থনীতির প্রকৃত ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে। যতক্ষণ না পর্যন্ত ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ব্যবস্থায় পরিচালিত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত দেশের আর্থিক কাঠামো প্রকৃত অর্থে স্থিতিশীল হতে পারবে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি নির্ভর করছে সেই সাহসী সংস্কারের ওপর, যেখানে ব্যাংক সংখ্যা কমবে; কিন্তু আর্থিক শক্তি বহুগুণ বাড়বে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট



