পৃথিবীর সব ধর্মেরই মূল প্রতিপাদ্য মানুষ; মানুষের কল্যাণ। অন্যায়, অবিচার, দুঃশাসন অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করে সুশাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তিময় সমাজ সৃষ্টি। আর এ জন্যই আল্লাহপাক মানুষকে সৃষ্টি করছেন তার প্রতিনিধি হিসেবে। মহান আল্লাহপাক কর্তৃক নির্দেশিত পথে চলার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন, পথ বাতলেছেন। মানুষের জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সৃষ্টি করেছেন পরম মমতায়। তার এই মমতা এবং দয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বলা হয়েছে, ‘আর রাহমানির রাহিম’ (সূরা ফাতিহা-০২) ‘তিনি পরম দয়ালু, সদা দয়াবান।’ সনাতন ধর্মে উচ্চারিত হয়েছে একই ঘোষণা, ‘ঈশ্বর পরমদাতা ও মহা দয়ালু’। (ঋগবেদ মণ্ডল-৩, সুক্ত-৩৬, শ্লোক-১) মহান স্রষ্টার কাছে মানুষের আকুল আবেদন, ‘ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম’ ‘আমাদেরকে সহজ ও সরল পথ প্রদর্শন করুন।’ (সূরা ফাতিহা-৫) যজুর্বেদে একই প্রার্থনার প্রতিধ্বনি ‘আমাদের কল্যাণের জন্য- আমাদেরকে সরল পথে পরিচালতি করুন।’ (যজুর্বেদ, সুক্ত-৪০, শ্লোক-১৬)!
বাংলাদেশ প্রতিটি মানুষের কল্যাণ কামনায় প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসের আলোয় হাজার বছরের ইতিহাসে সম্প্রীতির এই ঐতিহ্যে পথ চলছে। জীবনকে আলোকিত করেছে এভাবেই। বাংলাদেশ হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক মিলন মেলার দেশ। এ দেশের ঐতিহ্যে রয়েছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের হাত ধরাধরি করে পথ চলার ইতিহাস। এ দেশের প্রতিটি জনপদে রয়েছে এই ঐতিহ্যের পরিচয়। প্রতিটি পালা পার্বণে, অনুষ্ঠানে এর পরিচয় মেলে। প্রতিদিন ভোরে মানুষের ঘুম ভাঙে মুয়াজ্জিনের আজানের আওয়াজে। একই সাথে ভোরের মঙ্গলশাঁখের শব্দও প্রতিধ্বনিত হয় নিয়তই। এভাবেই সবার সম্মিলিতভাবে জীবনের পথ চলে এ দেশে। একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশী হয়ে বহমান জীবন ধারার ঐতিহ্যে লালিত এই দেশ ও জনপদের মানুষ।
হিন্দু ধর্মের ভাইবোনদের জন্য তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দক্ষণ নিয়ে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। এ উপলক্ষে তাদের সবাইকেই অভিনন্দন জানাই। একই সাথে বিনীতভাবে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, ধর্মপুরাণের বাণী। পৃথিবীর অন্যায় অবিচার আর অত্যাচারের মূল কারণ অসুরকে বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার শিক্ষার কথা। এর সাথে এবার যোগ হয়েছে জুলাই বিপ্লবের চেতনা, যা ছিল মূলত বছরের পর বছর ধরে চলে আসা অন্যায়-অবিচার আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে দ্রোহের প্রকাশ। পরিণতিতে অত্যাচারী শক্তির পতন। এই দ্রোহে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই সব ভেদাভেদ ভুলে হাত ধরাধরি করে মাঠে নেমে এসেছিলেন। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। পূজা উপলক্ষে সনাতনধর্মী ভাইবোনদের আহ্বান জানাই, একই চেতনায় ভেদাভেদ ভুলে সবাই যেন একসাথে জেগে উঠি। দেশ প্রেমে বলীয়ান হয়ে দেশ রক্ষা ও গড়ার জন্য। তাদের এবারের পূজার শিক্ষা হোক দেশপ্রেমের আলোকে দেশ গড়ার। একই সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন, হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক ঐক্যের প্রতীক বাংলাদেশ যেন এবারও প্রমাণ করে এখানে সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির কোনো স্থান নেই।
এ দেশের শান্তিকামী মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদে মুখর হয়েছে দেশ রক্ষার, দেশ গড়ার প্রত্যয়ে। সবাই হাত ধরাধরি করে বিভেদ বিসম্বাদ ভুলে সামনে এগিয়েছে সব ধরনের বিপত্তিকে পেছনে ফেলে। এবারও হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসবে আবারো প্রমাণিত করার সুযোগ এসেছে- আমরা সবাই ভাই ভাই, এ দেশের সাম্প্রদায়িকতার কোনো ঠাঁই নেই। কেউ যদি কোথাও অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়- আসুন, আমরা সবাই একসাথে রুখে দাঁড়াই। প্রমাণ করি- হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবার সমান অধিকার এ দেশে। এ দেশ সবার।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ