বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ইতিহাসে মুসলিম নবজাগরণ এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ১৮৬৩ সালে নওয়াব আবদুল লতিফ যখন কলকাতায় মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সমাজকে বৌদ্ধিক পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্ত করা, আধুনিক শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে মুসলিম চেতনার নবজাগরণ ঘটানো। এই ধারার উত্তরাধিকার বাংলার ভূমি ও ভাষাকে অবিলম্বে আলিঙ্গন করে। তৈরি হয় নতুন সুর ও সার। একে বহন করে জাগ্রত বহু চারুকণ্ঠের মধ্যে কবি গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪) ছিলেন অনন্য। বাংলায় মুসলিম সমাজের এক পরিণত ও প্রজ্ঞাবান কবি তিনি। রবীন্দ্র-নজরুলীয় প্রভাবকে স্বীকার করেও তিনি স্বাতন্ত্র্য তৈরি করেন। ইসলামী মানবতাবোধকে উচ্চকিত করেন এবং কাব্যধর্মকে এক নতুন সাংস্কৃতিক মাত্রায় উন্নীত করেন। তার কবিতায় ছন্দের কারুকাজ অবিস্মরণীয়, আরবি-ফারসি ধ্বনিসৌন্দর্য ও ইসলামী প্রতীক চিন্তার মেলবন্ধন অনন্য।
গোলাম মোস্তফার সাহিত্যধারার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা নতুন এক ধর্মীয় নন্দনচেতনা ও মানবিক দার্শনিকতার আশ্রয় পায়। তিনি ছিলেন সেই নবজাগরণী কণ্ঠ, যিনি বাংলার মুসলিম সমাজে রূপ, নৈতিকতা ও চেতনার নবজাগরণকে একসূত্রে বেঁধেছিলেন।
১৮৯৭ সালে যশোর জেলার শৈলকুপা থানার মনোহরপুর গ্রামে জন্ম নেন গোলাম মোস্তফা। তার পিতা কাজী গোলাম রাব্বানী ও পিতামহ কাজী গোলাম সরওয়ার ছিলেন ফারসি ও আরবি ভাষায় পণ্ডিত, লোককবি ও স্বাধীনতা-সংগ্রামী। এই পারিবারিক পরিবেশেই তার সাহিত্যিক চেতনার বীজ রোপিত হয়। শৈলকুপা হাইস্কুল থেকে ১৯১৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন, দৌলতপুর কলেজ থেকে ১৯১৬ সালে আইএ এবং রিপন কলেজ থেকে ১৯১৮ সালে বিএ পাস করেন। পরবর্তীতে ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি ডিগ্রিও অর্জন করেন।
শিক্ষাজীবনের সূচনালগ্নেই তার সাহিত্যপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে, দশম শ্রেণীর ছাত্র অবস্থায়, তার কবিতা আদ্রিয়ানোপল উদ্ধার প্রকাশিত হয় মোহাম্মদি পত্রিকায়, তাতে ছিল মুসলিম জাগরণের ভাবধারায় তার প্রথম পদক্ষেপ।
১৯২০ সালে ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং দীর্ঘ ৩০ বছরের কর্মজীবনে কলকাতা হেয়ার স্কুল, কলকাতা মাদরাসা ও ফরিদপুর জেলা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতা ছিল তার নেশা; কিন্তু সাহিত্য তার আত্মার ভাষা। শিক্ষকতা ও সাহিত্যচর্চার এই যুগল জীবন তাকে একাধারে চিন্তাশীল সমাজনির্মাতা ও সৃষ্টিশীল কবিতে রূপায়িত করে। ১৯৪৯ সালে গঠিত পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা সংস্কার কমিটির সচিব হিসেবে তিনি কাজ করেন এবং একই সালে তিনি ফরিদপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর ঢাকার শান্তিনগরে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। শিল্প-সাহিত্য, চিন্তা ও সৃষ্টিমুখরতার মধ্যে সময় যাপন করেন। পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন তিনি নতুনদের। তার বাড়ি ‘মোস্তফা মঞ্জিল’ সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়।
১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন। বিখ্যাত পাপেট নির্মাতা ও চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার তার ছেলে এবং অস্কারজয়ী বাংলাদেশী নাফিস বিন জাফর তার নাতি। গোলাম মোস্তফার সাহিত্যজীবনের প্রারম্ভে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব তাকেও আচ্ছন্ন করেছিল। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কুমুদরঞ্জন মল্লিক বা কালিদাস রায়ের মতো রবীন্দ্রবলয়ের কবি দলে তিনিও ছিলেন। কিন্তু তার মৌলিকতা এখানেই যে, তিনি রবীন্দ্র-নন্দনের প্রভাবের মধ্যে থেকেও ইসলামী নবজাগরণের চেতনাকে ধারণ করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, মুসলিম সমাজের নিজস্ব আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য, নৈতিক চেতনা ও ইতিহাসকে নতুন ভাষায় পুনর্জাগ্রত করা প্রয়োজন। এই উপলব্ধিই তাকে ধীরে ধীরে মুসলিম পুনর্জাগরণের দিকে দিশাদান করে।
তার গদ্যগ্রন্থ ‘বিশ্বনবী’ এই আদর্শেরই সাহিত্যিক প্রতিফলন। এতে তিনি হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও কাব্যিক আবেগে একত্রিত করে ব্যাখ্যা করেন। মিরাজকে ঘিরে আকরাম খাঁর সংশয়ী মন্তব্যের জবাবে তিনি জোরালো ভাষা বয়ন করেন। বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও ইসলামী দর্শনের মাধ্যমে নবীজির অলৌকিক অভিজ্ঞতার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। এই গ্রন্থ বাংলা ভাষায় নবীজির জীবনীধারার শীর্ষস্থানীয় কীর্তি হিসেবে গণ্য।
গোলাম মোস্তফার সাহিত্যকর্ম বহুস্তরীয়। এর মধ্যে আছে-
ক. কাব্যসাহিত্য : গোলাম মোস্তফা ছিলেন মূলত কবি। ধর্মীয় চেতনা, নৈতিক বোধ, মানবিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের মিলিত তরঙ্গ উচ্ছ¡সিত হয়েছে তার ছন্দপুষ্পিত উচ্চারণে। সহজ, হৃদয়গ্রাহী ও শিল্পসম্মত প্রকাশভঙ্গিই তার কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
খ. অনুবাদকর্ম : গোলাম মোস্তফা বাংলা সাহিত্যে ইসলামী দর্শন ও কাব্যরসের একত্র সমাহার ঘটান। এই ধারার সাহিত্যসম্পদে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন অনুবাদের মাধ্যমেও। ইখওয়ানুস সাফা, মুসাদ্দাস-ই-হালি (১৯৪১), কালামে ইকবাল (১৯৫৭), শিকওয়া ও জওয়াব-ই-শিকওয়া (১৯৬০), আল-কুরআন (১৯৫৮) তার প্রধান অনুবাদ গ্রন্থ। বাংলা ভাষায় মার্জিত সাহিত্যরীতিতে তার অনুবাদ তাকে স্থায়ী বিশিষ্টতা দিয়েছে। বাংলা ভাষায় তিনি প্রভাবশালী অনুবাদকদের অন্যতম।
গ. গদ্যরচনা ও প্রবন্ধসাহিত্য : তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক ও সমাজচিন্তক। তার গদ্যে যেমন ছিল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, তেমনি আধুনিক রাষ্ট্রবোধ ও সমাজচেতনার সমন্বয়। নিজের গদ্যকে তিনি মনন, মস্তিষ্ক ও আবেগের সমবেত মোহনায় পরিণত করেন। তার সমকালে কবি জসীমউদ্দীন, আরেক অনন্য গদ্যশিল্পী; তিনি কবুল করেছিলেন গোলাম মোস্তফার মতো এমন কবিত্বপূর্ণ ললিতগতিসম্পন্ন গদ্যলেখক আমাদের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে একজনও নেই।
ঘ. গীতিকার ও সুরকার : গোলাম মোস্তফা ছিলেন একজন প্রশিক্ষিত গায়ক ও গীতিকার। উস্তাদ জমিরুদ্দীন খাঁর শিষ্য ছিলেন তিনি। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তার রচিত বহু ইসলামী ও দেশাত্মবোধক গান জনমনে সাড়া তোলে। তিনি নিজেই অনেক গানে সুর দিয়েছিলেন। বিশিষ্ট শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের সাথে তার গাওয়া কিছু গানের রেকর্ডও সংরক্ষিত আছে।
ঙ. শিক্ষা-সাহিত্য : তিনি কয়েকটি পাঠ্যপুস্তকও রচনা করেন, যা অবিভক্ত বাংলার স্কুলগুলোতে পাঠ্য ছিল। তার সহজ ভাষা, নৈতিক ভাবধারা ও কাব্যগুণের কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে এই রচনাগুলো বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। আলোক মালা, আলোক মঞ্জুরী, মনি মুকুর , মনি মঞ্জুষা তার প্রণীত অন্যতম শিশুপাঠ্য।
চ. উপন্যাস : তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো- ‘রূপের নেশা’, ‘ভাঙ্গাবুক’ এবং ‘একমন একপ্রাণ’। তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ছিল ‘রূপের নেশা’ যা ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয়।
ছ. শিশুতোষ : বাংলা সাহিত্যে শিশুসাহিত্যিকদের মধ্যে গোলাম মোস্তফার রয়েছে স্বতন্ত্র উচ্চতা। শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত তার কালজয়ী গ্রন্থ-কিশোর। তিনি শিশুদের ভাষায় বলেছেন, শিশু হতে পেরেছেন এবং তাদের জন্য স্বপ্ন ও পথ গঠন করেছেন। তার শিশুতোষ উচ্চারণ শুধু শ্রবণ ও উচ্চারণসুখে বরেণ্য নয়, অর্থ ও মর্মমহিমায়ও বিশেষায়িত। যেমন- আমরা নতুন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল বন-নন্দনে, ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা, জীবন জাগে স্পন্দনে। লক্ষ আশা অন্তরে, ঘুমিয়ে আছে মন্তরে, ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাপড়ি-পাতার বন্ধনে। ( কিশোর)
শিশুদের একজন হয়েই তিনি বলেছেন, নদী যেমন দুই কূলে তার/বিলিয়ে চলে জল/ফুটিয়ে তোলে সবার তরে/শস্য, ফুল ও ফল। তেমনি করে মোরাও সবে/পরের ভালো করব ভবে/মোদের সেবায় উঠবে হেসে/এই ধরণীতল। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন প্রাণস্পর্শী গদ্যও। তার মরু দুলাল কিশোরদের জন্য রচিত সিরাত গ্রন্থ, যা হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনী নিয়ে রচিত। কিশোরদের মনকে শিহরিত, পুলকিত ও বিকশিত করার আয়োজন আছে বইটিতে। এই কাব্যিক গদ্যের বইটি বাংলা সিরাত সাহিত্যে এই ধারার শ্রেষ্ঠ কাজ।
বিশ্বনবী বাংলা সাহিত্যের এক ঐতিহাসিক সৃষ্টিকর্ম। এটি কেবল নবীজির জীবনী নয়; বরং মুসলমান জাতির আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধারের এক সাংস্কৃতিক দলিল। বইটির প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় তিনি লিখেন- ‘মহাপুরুষদের জীবন শুধু ঘটনার ফিরিস্তি নহে; শুধু যুক্তি-তর্কের কণ্টক শয্যাও নহে; সে একটা ভক্তি, শ্রদ্ধা, বিস্ময় ও অনুভবের বস্তু, তাহাকে বুঝিতে হইলে একদিকে চাই সত্যের আলোক ও বিজ্ঞানের বিচার বুদ্ধি, অপরদিকে ঠিক তেমন চাই ভক্তের দরদ, কবির সৌন্দর্যানুভূতি, দার্শনিকের অন্তর্দৃষ্টি আর চাই প্রেমিকের প্রেম। আশেকে রাসূল না হইলে সত্যিকার রাসূলকে দেখা যায় না।’
রবীন্দ্রনাথের রূপমাধুর্য ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দের সমন্বয় ঘটিয়েও তিনি কখনো নিছক সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য লিখেননি; তার শিল্পচেতনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ধর্মীয় সৌন্দর্য যেখানে সৌন্দর্য ও নৈতিকতা পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। এখানে সৌন্দর্য কোনো ইন্দ্রিয়সুখ নয়; বরং ঐশ্বরিক সমস্বরের অভিজ্ঞতা। এই শিল্পচেতনা ইসলামী কসমোলজির সৌন্দর্য ধারণারই কাব্যরূপ যেখানে সৌন্দর্য ঈমানের একটি শাখা।
তিনি বিশ্বাস করতেন, সাহিত্য মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিবর্তনের মাধ্যম। তাই তার কবিতায় মানুষ ও সৃষ্টির সম্পর্ক ইবাদত ও দায়িত্ববোধে আবদ্ধ। যেমন- বনি আদম কাব্যে মানবতার তত্ত¡ ইসলামের মর্মকথায় বিকশিত। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি, তাই সে যেমন সৌন্দর্য সৃষ্টি করবে, তেমনি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে। এই দ্বৈত দায়িত্বই তার নান্দনিক তত্তে¡র ভিত্তি। একদিকে ঈমানের রস (ংঢ়রৎরঃঁধষ ংবহংরনরষরঃু), অন্যদিকে জিহাদের বোধ (বঃযরপধষ ৎবংরংঃধহপব) তার কাব্যে। এই দুইয়ের সমন্বয় থেকে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের ‘নৈতিক নন্দন’ যা বাংলা সাহিত্যে বিরল। তিনি চেয়েছিলেন মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য নির্মাণ করতে যেখানে ভাষা ও পরিবেশ হবে বাংলা, আত্মা হবে ইসলামী। এই শিল্পদৃষ্টি ছিল এক ধরনের সংস্কৃতি সংশোধনমূলক অভিযান। তিনি মুসলিম সমাজের সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতাকে ঘৃণা করেছেন। তিনি তার লক্ষ্য পূরণের জন্য সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যে ইসলামী স্বর সংযোজনের মেহনতে অবতীর্ণ হন।
তার নন্দনতত্তে¡ তিনটি স্তর পরিলক্ষিত হয় : ১. ধর্মীয় স্তর : সৌন্দর্য আল্লাহর এক নিদর্শন; ২. নৈতিক স্তর : সৌন্দর্য ও নৈতিকতা অবিচ্ছেদ্য; ৩. মানবিক স্তর : সৌন্দর্যের চূড়ান্ত লক্ষ্য মানবিক পূর্ণতা। এই তিন স্তর মিলিয়ে তার নন্দনতত্ত¡ এক ধরনের রূপানুভূতিশীল বাস্তববাদ যেখানে সৌন্দর্য বাস্তবের মধ্যেই খোদাবিশ্বাসে উদ্ভাসিত। তিনি পশ্চিমা রোমান্টিকতাকে অতিক্রম করে এক তাওহিদি নন্দনবোধ গড়ে তোলেন।
গোলাম মোস্তফাকে বুঝবার জন্য তার চিন্তা ও তত্ত¡কে আবিষ্কার করতে হবে। কারণ এখানেও তিনি প্রবল, প্রখর। তার সাহিত্য কেবল আবেগনির্ভর নয়; এতে রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক ও তত্ত¡গত গভীরতা। তিনি ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত, আধুনিক মননের প্রতি উন্মুক্ত। তার কবিতায় আত্মমর্যাদা, নৈতিকতা, স্বাধীনতা ও মানবসমতার ধারণা একত্রে প্রতিফলিত।
গোলাম মোস্তফা শুধু কবি নন, একজন সামাজিক দার্শনিকও ছিলেন। তিনি এমন সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে ইসলামী মূল্যবোধ, ন্যায়, দয়া ও মানবতার শিক্ষা নিশ্চিত হবে। তিনি যুক্তি দিয়ে দেখান ইসলাম এ দুনিয়ায় যে মানবতা প্রচার করেছে, তা প্রতিষ্ঠিত হলে জাতিতে জাতিতে এই হানাহানি থাকত না। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি ভাষা আন্দোলন বিষয়ে তৎকালীন নেতাদের সাথে মতানৈক্যে জড়ান। পরবর্তীতে তিনি নিজের অবস্থান সংশোধন করেন। এটিও তার নৈতিক সততা ও আত্মসমালোচনার দৃষ্টান্ত।
গোলাম মোস্তফার সাহিত্য ও চিন্তার সরাসরি উত্তরাধিকার পরবর্তীদের মধ্যে প্রকটিত হয়েছে। এই ধারায় ইসলামী মানবতাবোধ, সাংস্কৃতিক মর্যাদা ও আধুনিক রূপকল্প বাংলা কবিতায় পরিণত রূপ লাভ করে। গোলাম মোস্তফা ছিলেন বাংলা মুসলিম সমাজের এক নবদূত, যিনি সাহিত্যকে ধর্মীয় অনুরাগের মিনার বানিয়েছেন এবং একে মানবতার মহামঞ্চে স্থাপন করেছিলেন। তার কবিতায় রয়েছে সৌন্দর্যের ছন্দ, প্রার্থনার আত্মা এবং জাগরণের ডাক। জ্যোতির্ময়তা তার কাব্য ও চিন্তার প্রধান প্রবণতা।
গোলাম মোস্তফা ছিলেন বাংলায় মুসলিম নবজাগরণের অন্যতম সাংস্কৃতিক স্থপতি। তার সৃষ্টিকর্ম ও ভাবনায় নিহিত ছিল সমাজসংস্কার ও চেতনা পুনর্গঠনের একটি আন্দোলন। তিনি বাংলা সাহিত্যকে যে ভাষা, আত্মা ও নৈতিকতার স্পর্শ দিয়েছেন, তা কেবল মুসলিম সাহিত্যধারায় নয়, পুরো বাংলা সংস্কৃতিতেই এক স্থায়ী চিহ্ন রেখে গেছে। তিনি সাহিত্যকে ভক্তি ও জ্ঞানের সংযোগস্থলে দাঁড় করিয়েছেন। তার কাব্যরূপের মধ্যে যেভাবে কথা বলে আলো, তেমনি প্রকাশিত হয় সামাজিক দায়িত্ব; যেভাবে উচ্চারিত হয় সঙ্গীত, তেমনি নিবেদিত হয় প্রার্থনা।
গোলাম মোস্তফা বাংলার মুসলিম নবজাগরণকে কেবল ইতিহাসে দেখেননি, দেখেছেন আধ্যাত্মিক ও নন্দনতাত্তি¡ক অভিজ্ঞতায়। তার কবিতায় তাই জ্যোতি, ন্যায়, সৌন্দর্য ও বিশ্বাস শিখায়িত হয়েছে, সব মিলেই গড়ে উঠেছে নবজাগরণের আত্মা।
লেখক : কবি, গবেষক



