স্বৈরাচারী বয়ানে ঐক্যের বাড়া ভাতে ছাই

এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বাস্তবতা যে, জুলাই সনদ ঘোষণার পর ৪০টি প্রস্তাবনার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়নি। শেষমেশ বলটা যখন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে ঠেলে দেন, তখনও তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসতেও পারেননি। যারা স্বৈরাচারের দোসর, তাদের মধ্যে তো কোনো বিভেদ-অবনিবনা নেই! তা হলে বিপ্লবের সমর্থক এবং সুবিধাভোগীরা এক হতে পারছে না কেন? তারা কি এই অনৈক্যের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন নন! বিপ্লবের সব অর্জন, দুই হাজার তাজা প্রাণের শাহাদৎ এবং ৪০ হাজার তরুণের পঙ্গুত্ববরণ কি ব্যর্থ হয়ে যাবে

ড. মুহাম্মদ ইউনূস পেরেছেন। বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন বৈশ্বিক উচ্চতায়। আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যুদ্ধবিশারদ না হয়েও তিনি বাংলাদেশের নেপোলিয়ন। তার যুদ্ধ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, কার্বনের বিরুদ্ধে, বেকারত্বের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধে তিনি যথাযোগ্য সিপাহসালার। একদল ক্ষমতাহারা এবং এক দল ক্ষমতাভিলাষী অধৈর্য লোভী মানুষ ছাড়া ডান-মধ্য-বাম, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ, পাহাড়ি-সমতলবাসী সবার কাছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি বরণীয় মানুষ। ইতিহাস তাকে পৌঁছে দিয়েছে রাষ্ট্রনায়কের উচ্চাসনে, যার প্রতি মোহ বা প্রত্যাশা কখনোই তার ছিল না। ১/১১-র সময়ও তার সুযোগ এসেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার। তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

২০২৪-এর গণজাগরণের পর দেশ গুছানোর মহা কর্মযজ্ঞ ও দেশকে ফ্যাসিবাদ এবং ভারতের গোলামির কবর রচনার ঐতিহাসিক ভ‚মিকায় আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্যই হয়তো নিয়তি তাকে সাব্যস্ত করে রেখেছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো দেশের প্রায় সব মানুষের আস্থা এবং তাবৎ বিশ্বের ভক্তি ও ভালোবাসা, যা ইতিহাসে বিরল। তিনি ভারতের আগ্রাসনের বিরোধী। তাই ভারতের ক্রীতদাস ও সেবাদাসেরা তার বিরুদ্ধে। এই অবস্থান তার শক্তির দ্বিতীয় পাওয়ার হাউজ।

১৯৯১ সালে ভারতের সেবাদাসেরা খোয়াব দেখেছিল তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে তারাই বিজয়ী হবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট ভোটে জিতে সরকার গঠনের পর থেকেই চক্রান্ত শুরু হলো জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির মধ্যে ফাটল ধরানোর। তারা সফল হলো ভাঙন ধরাতে। তাই ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে স্বৈরাচার জয়ী হলো। শুরু হয়ে গেল বাকশালের চেয়েও নিষ্ঠুর স্বৈরতন্ত্র।

সবাই মিলেমিশে বিপদকালীন ত্রাণকর্তা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণকারী নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশকে বিপ্লব-পরবর্তী দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই ছিল গণআকাক্সক্ষা। অথচ পতিত খুনি স্বৈরাচারী অপশাসকদের বয়ান নতুন করে রপ্ত করে সেই জাতীয়তাবাদী শক্তিই জাতীয় ঐক্যের বাড়া ভাতে ছাই ঢালছে। এতে যে পুরোটাই লাভবান হচ্ছে পতিত স্বৈরাচার এবং তাদের আশ্রয়দাতা বাংলাদেশের শত্রæরাষ্ট্র ভারত, এই কথাটা বিএনপির তৃণমূলে নেতাকর্মীরা বুঝতে পারলেও স্বৈরাচার ও ভারতের দ্বিতীয় লাইনের দোসররা বুঝতে পারছে না। ওই দলের এবং বিতর্কিত খাসলতের নগরকেন্দ্রিক এই শেষোক্ত পক্ষের কারণেই এক সময়ের জনপ্রিয় দল বিএনপিকে এখন লোকে চান্দাবাজ, টেম্পোস্ট্যান্ড দখলদার ও আওয়ামী-ভারতীয় দোসরদের বিকল্প দল বলে মনে করে। ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই তাদের মধ্যে অন্তঃকলহ, খুনোখুনি, সাংবাদিক পেটানো, নমিনেশন-বাণিজ্য, দখলদারি, লুটপাটতন্ত্র, ভারতপ্রীতি চরমে পৌঁছেছে।

বিপ্লবের তরুণ শক্তিকে মদদ দেয়ার পরিবর্তে তারা আওয়ামী-জাতীয় পার্টি, বাম অপশক্তির সাথে সর্বনাশা গাঁটছড়া বাঁধছে। তাদের এই নীতি বড় ধরনের আদর্শিক মোড় বদলেরই পরিণতি। তারই প্রতিফলন দেশের প্রধান প্রধান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তাদের শোচনীয় বিপর্যয়। এই লজ্জাজনক পরিণতি এবং অস্তিত্ব সঙ্কটের ঝুঁকি নিয়েই এগিয়ে চলেছে ‘হাইব্রিড’ বিএনপি। তারা এখন জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্যের পরিবর্তে অনৈকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলো ২০২৪-এর বর্ষা-বিপ্লবের আইনগত ভিত্তি। কিন্তু এই অকাট্য সত্যটা জানার পরও এই ঐতিহাসিক সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এত মতান্তর, মতদ্বৈধতা এবং মতবিরোধ কেন, এটাই সমগ্র জাতিকে উদ্বেগে ফেলেছে। মতান্তর শুরু হয়েছে মৌলিক বন্দোবস্তের আইনগত ভিত্তি গণভোট আয়োজন নিয়ে। অথচ ১৯৭৫ সালের আগস্ট বিপ্লবের পর রাষ্ট্রপতি জিয়া তার শাসন শুরুই করেছিলেন হ্যাঁ-না ভোট বা গণভোট দিয়ে। তার সৃষ্ট বিএনপির আজকের নেতৃত্ব গণভোট প্রশ্নে না সূচক অবস্থান (Note of Dissent) দিয়ে বসে আছে। যে বর্ষা বিপ্লবের অজেয় দেশপ্রেমিক তারুণ্য আজ বিএনপির নবজন্ম দিলো সেই বর্ষা বিপ্লবের ছাত্র-জনতাকেই বিএনপি এখন প্রধান প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। দেশের বিবেকবান প্রবীণ মানুষেরা বিএনপি দলের এভাবে পিঠ ফেরানো অর্থাৎ আওয়ামী সুরারোপণে হতাশ এবং উদ্বিগ্ন। জিয়াউর রহমান ও আপসহীন জননেত্রী বেগম খালেদার বিএনপি কাকে খুশি করতে এমন উঠেপড়ে লেগেছে? জুলাই-আগস্ট গণবিপ্লবের প্রত্যক্ষ এবং সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী পক্ষ তো এই বিএনপিই। কিন্তু কথায়-কাজে-কৌশলে বা অভিসন্ধিতে সেই বিপ্লবের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিলো দলটি! এতে যে তাদের সাধারণ অনুগামী ও সমর্থকরা মনের দিক থেকে বিমুখ হয়ে পড়ছে সেটা কী আমলেই নিচ্ছে না দলটি?

এই বিএনপিই দেশে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির পরিবর্তে সংসদীয় শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল (যদিও বিএনপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে সংসদীয় ব্যবস্থার কোনো ওয়াদা আদৌ ছিল না)। সংসদীয় ব্যবস্থা ছিল আওয়ামী লীগ এবং একই মতের অন্য দলগুলোর অবস্থান। সেই বিএনপি এখন সংস্কারও চায় না। জুলাই সনদেও আগ্রহী নয়। গণভোটেও তাদের আপত্তি। আবার বলছে গণভোট যদি আদৌ করতে হয় তবে তা করতে হবে সংসদ নির্বাচনের একই দিনে। যদিও এটা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মতো হবে। কেননা জুলাই সনদ ছাড়া ২০২৪-এর বর্ষা-বিপ্লবের আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা পাবে কীভাবে? তাদের এখন একটাই দাবি : নির্বাচন এবং সে নির্বাচন চলমান সংবিধান মোতাবেকই হতে হবে। বিপ্লব ও পরিবর্তনের পর সংবিধানের নৈতিক ভিত্তি থাকে কিভাবে? সমস্যা তো এই বাকশালী সংবিধানেই। আগে তো সংবিধান বদলাতে হবে।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যেমন এলএফও (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অধ্যাদেশ) নির্বাহী ক্ষমতাবলে জারি করে পাকিস্তানের নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য গণপরিষদের ব্যবস্থা করেছিলেন, ঠিক একইভাবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও নির্বাহী ক্ষমতায় ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা করে দেশের নতুন শাসনব্যবস্থা অনুমোদনের জন্য হ্যাঁ-না (বা গণভোটের) ব্যবস্থা করতে পারতেন পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই। তবে তা হয়নি। সরকার নির্বাচনের দিনই গণভোট করতে যাচ্ছে। কিন্তু কোন বড় দলের একগুঁয়েমির কাছে গোটা জাতিকে পণবন্দী থাকতে হবে, এটা কোনো যুক্তির কথা হতে পারে না।

বাঙালির ‘আখলাক’ সম্পর্কে যে কথা পর্যটক ইবনে বতুতা এবং হিউ-এন-সাং বলে গেছেন (বাঙালি জাতি বড়ই কলহপ্রিয়), সেই বিশেষণটি জুলাই জাতীয় সনদের ব্যাপারেও ঘটছে। পরিহাস এবং পরিতাপের বিষয় হলো, এই বর্ষা-বিপ্লবের যারাই সবচেয়ে বড় এবং বেশি সুবিধাভোগী তারাই জুলাই সনদকে আইনি রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে বেশি কলহ বাধাচ্ছে। মাঝখান থেকে সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ সনদটাই পড়ছে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে। কেউ বলছেন, সংবিধানে গণভোটের বিধান নেই। আরে নেই বলেই তো সেই স্বৈরাচারী বাকশালী এবং ভারতের আজ্ঞাবহ সংবিধান বদলানো অতি প্রয়োজন। সংবিধান বদলানোর জন্যই তো সবার আগে দরকার জুলাই সনদের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য এবং সংবিধান বদলানোর জন্যই চাই গণভোটের মাধ্যমে মানুষের সম্মতি বা ম্যানডেট গ্রহণ করা।

এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বাস্তবতা যে, জুলাই সনদ ঘোষণার পর ৪০টি প্রস্তাবনার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়নি। শেষমেশ বলটা যখন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে ঠেলে দেন, তখনও তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসতেও পারেননি। যারা স্বৈরাচারের দোসর, তাদের মধ্যে তো কোনো বিভেদ-অবনিবনা নেই! তা হলে বিপ্লবের সমর্থক এবং সুবিধাভোগীরা এক হতে পারছে না কেন? তারা কি এই অনৈক্যের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন নন! বিপ্লবের সব অর্জন, দুই হাজার তাজা প্রাণের শাহাদৎ এবং ৪০ হাজার তরুণের পঙ্গুত্ববরণ কি ব্যর্থ হয়ে যাবে?

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক