ইসরাইলি দৈনিক Yedioth Ahronoth জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা শান্তিচুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ শর্তারোপ করলেও শেষ পর্যন্ত হামাসের কাছে কার্যত আত্মসমর্পণ করেছেন এবং সত্য গোপন করেছেন। পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহুর ঘোষিত তিনটি মূল শর্ত- হামাসকে নিরস্ত্র করা, গাজাকে সামরিকভাবে নিষ্ক্রিয় করা এবং অঞ্চলটি সন্ত্রাসমুক্ত করা, কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি।
এক গোয়েন্দা সূত্র পত্রিকাটিকে বলেছেন, ‘চুক্তিটি বাহ্যিকভাবে সফল মনে হলেও এর মধ্যে গভীর ছাড় রয়েছে।’ তিনি আরো মন্তব্য করেন, সরকার ও নেতানিয়াহুর প্রচার দল জনগণের কাছে সৎব্যাখ্যা দিতে পারছে না, কেন এই মৌলিক শর্তগুলো ত্যাগ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন যুদ্ধবিরতির পর গাজা থেকে হাজার হাজার মানুষ উত্তর দিকে ফিরছে এবং আন্তর্জাতিক মহল এই শান্তিচুক্তিকে ‘ভঙ্গুর আশার প্রতীক’ হিসেবে দেখছে।
নতুন ভূ-রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের লড়াই
গাজা উপত্যকায় দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসানের পর মধ্যপ্রাচ্য এখন এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। যুদ্ধোত্তর শান্তিচুক্তির মাধ্যমে একদিকে যেমন ইসরাইল সামরিকভাবে ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার দাবি করেছে, অন্যদিকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে প্রশাসনিক পুনর্গঠন, মানবিক পুনর্বাসন ও আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এই প্রতিযোগিতা শুধু গাজার নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং এটি গোটা মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্য পুনর্নির্ধারণের সূচনা।
যুদ্ধবিরতির পর গাজায় যে ‘অন্তর্বর্তী প্রশাসন’ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা মূলত যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের যৌথ প্রস্তাবের ওপর দাঁড়িয়ে। এতে হামাসকে সরাসরি বাদ না দিলেও প্রশাসনিক ক্ষমতা একটি ‘প্রযুক্তিনির্ভর নিরপেক্ষ দল’-এর হাতে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পশ্চিমতীরে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ দল এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেও গাজায় তা কার্যকর করা কঠিন হচ্ছে, কারণ হামাস এখনো স্থানীয় প্রশাসন, নিরাপত্তা ও সামাজিক সংগঠনগুলোর ওপর গভীর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।
এ অবস্থায় ফিলিস্তিনি ঐক্য সরকারের পুনর্গঠন আবার আলোচনায় এসেছে; কিন্তু অভ্যন্তরীণ অবিশ্বাস, ইসরাইলি শর্ত এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পূর্বশর্ত এ প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।
হামাস : প্রশাসক নাকি প্রতিরোধের প্রতীক
হামাস এখন গাজার রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত বাস্তবতা। সা¤প্রতিক যুদ্ধবিরতির পর তারা দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় প্রশাসনিক এবং নিরাপত্তা কার্যক্রমে ফিরেছে। স্থানীয় পুলিশবাহিনী পুনর্গঠন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, লুটপাট ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তাদের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। তবে ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিতে এটি ‘অস্থায়ী অনুমতি’, যেখানে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ ও সামরিক কাঠামো বিলুপ্ত করার প্রতিশ্রুতি এখনো কার্যকর হয়নি।
একজন ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা স¤প্রতি মন্তব্য করেন, ‘গাজার রাজনৈতিক ভারসাম্য এখনো হামাসের উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল।’ অর্থাৎ তারা এখনো জনসমর্থনের একটি অংশ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, বিশেষত প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে।
গাজার পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি অন্তর্বর্তী বা স্থানান্তর প্রশাসনের মডেল প্রস্তাব করা হয়েছে। একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গাজায় ১০-১৫ সদস্যের একটি টেকনোক্র্যাট প্রশাসন গঠন করা হবে, যাদের রাজনৈতিক সংযোগ থাকবে না, বরং তারা আন্তর্জাতিক সহায়তায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য ও অবকাঠামো পুনর্গঠনে কাজ করবে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের নেতৃত্বে একটি গাজা ইন্টারন্যাশনাল ট্রানজিশনাল অথরিটি গঠনের আলোচনা চলছে, যা জাতিসঙ্ঘের অধীনে কাজ করবে এবং ইসরাইলি নিরাপত্তা নজরদারিতে থাকবে।
তবে এই পরিকল্পনাগুলো সমালোচনার মুখে পড়েছে স্থানীয় প্রতিনিধিত্বহীন প্রশাসনকে অনেক ফিলিস্তিনি ‘বাইরের চাপ’ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, এমন প্রশাসন জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পরিপন্থী।
ঐক্য সরকার : ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে নতুন সুযোগ
গাজার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে একটি মূল প্রশ্ন হলো, ফিলিস্তিনি ঐক্য সরকারের ভবিষ্যৎ। ২০২৪ সালের ‘বেইজিং ঘোষণা’র মাধ্যমে হামাস, ফাতাহ এবং আরো ১২টি ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী একটি জাতীয় ঐক্য সরকারের রূপরেখা দিয়েছিল। লক্ষ্য ছিল পশ্চিমতীর ও গাজার জন্য একক প্রশাসন এবং নির্বাচন আয়োজন।
যুদ্ধ-পরবর্তী এই সময়ে সেই আলোচনা ত্বরান্বিত হয়েছে। হামাসও শর্তসাপেক্ষে ঐক্য সরকারের অংশ হতে আগ্রহী বলেছে, যদি তা ইসরাইল বা পশ্চিমা চাপমুক্ত থাকে।
তবে বাস্তবে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হলো, এখন পর্যন্ত হামাস ও ফাতাহর মধ্যে আস্থাহীনতা গভীর; নিরাপত্তা কাঠামোর একীভূতকরণ অনিষ্পন্ন; আন্তর্জাতিক মহল ফাতাহ নেতৃত্বাধীন প্রশাসনকে বেশি সমর্থন দিচ্ছে, যা হামাসের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি করছে।
শান্তির আশ্বাস নাকি নিয়ন্ত্রণের নতুন কৌশল
গাজার রাজনৈতিক পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান এখন কেন্দ্রীয় উপাদান। জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মিসর, কাতার ও তুরস্ক সক্রিয়ভাবে গাজার প্রশাসনিক ভবিষ্যৎ নিয়ে কাজ করছে। একটি সম্ভাব্য পরিকল্পনা হলো, ‘বোর্ড অব পিস’ নামের একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা, যা অন্তর্বর্তী প্রশাসনের কাজ তত্ত্বাবধান করবে।
তবে এর সীমাবদ্ধতাও আছে, কারণ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সিদ্ধান্ত প্রায়ই মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নযোগ্য নয়; ইসরাইল নিরাপত্তা বিষয়ে চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে রাজি নয়; ফিলিস্তিনি জনগণ বিদেশী তত্ত্বাবধানকে অনেক সময় ‘নতুন ঔপনিবেশিক কাঠামো’ হিসেবে দেখে। এ কারণে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান শান্তির পূর্বশর্ত নয়; বরং জনগণের অংশগ্রহণই স্থায়িত্বের মূল চাবিকাঠি।
যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতা : চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ
গাজায় একদিকে রয়েছে অবকাঠামোয় ধ্বংস, অর্থনৈতিক পতন ও মানবিক বিপর্যয়; অন্যদিকে রয়েছে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও চুক্তি বাস্তবায়নের প্রশ্ন। আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুসারে, গাজার দীর্ঘ যুদ্ধ ও ভারতীয় বিমান এবং মিসাইল হামলার ফলে আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পানি ও স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ সিস্টেম ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে। অনেক এলাকার বাসিন্দাদের বাড়ি উড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ইউএন বিশেষজ্ঞ মনে করেছেন, উত্তর গাজার ধ্বংসাবশেষে ফিরে যাওয়া মানুষের সামনে ‘কোনো শেকড়ই অবশিষ্ট নেই।’ গার্ডিয়ান বলেছে, ইউনিসেফ ও অন্যান্য সংস্থা অনুমান করেছে, ৫৬ হাজারেরও বেশি ছয় বছরের কম বয়সী শিশু মারাত্মক উপেক্ষার শিকার- যার পেছনে রয়েছে মূলত খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির অভাব।
তাই পুনর্গঠন কাজ একটি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ। শুধু বাড়ি গড়াই নয়- জীবিকার সংস্থান, জনসেবা, সড়ক, পানিব্যবস্থা, হাসপাতাল, স্কুল-সংস্কার- সব কাজই একসাথে এগিয়ে নিতে হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অর্থায়ন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘ ও ইউরোপীয়, আমেরিকান, আরব দেশের তহবিল ও দান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে।
এক্ষেত্রে বাধা ও ঝুঁকি রয়েছে। সেখানে রয়েছে যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা। ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকায় সরঞ্জাম, কংক্রিট, যন্ত্রপাতি আনার ক্ষেত্রে সীমান্ত পারাপার ও কাস্টমসের বাধা মূল প্রতিবন্ধক। উল্লেখযোগ্য তহবিল ঘাটতি রয়েছে এবং দাতারা রাজনৈতিক শর্তারোপ করতে পারে।
নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। পুনর্গঠন কাজ নিরাপদ পরিবেশ ছাড়া হবে না; অব্যাহত সংঘর্ষে কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এছাড়া ধ্বংস হওয়া প্রযুক্তি ও কর্মশক্তি পুনরুদ্ধার করা কঠিন; চলতি যুদ্ধ চলাকালীন অনেক দক্ষ জনশক্তি বহুদূর পালিয়ে গেছে।
নতুন গাজার যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপ ইতোমধ্যেই অনুমোদিত হয়েছে: দুই পক্ষ থেকে বন্দিবিনিময়, সীমিত সেনা প্রত্যাহার ও মানবিক গমনযোগ্যতার সুবিধা প্রসার। প্রথম দিনে ১৭৩টি ত্রাণ ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে, যাতে খাদ্য, গ্যাস ও জ্বালানির সরবরাহ করা হয়েছে।
একটি সরকারি নথি ও মিডিয়ার ঘোষণা মতে, গাজার সীমান্ত (রাফাহ, কারেম শালম) ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ব্যবস্থাপনায় কৌশলগত অংশীদারিত্ব থাকতে পারে ইসরাইলের নিরাপত্তা অধিকার বজায় রেখেই। কিছু প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গাজার নতুন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে একটি নিরপেক্ষ ট্রাস্ট বা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মডেল থাকতে হবে।
বিধি ও বাস্তবায়ন পার্থক্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শান্তিচুক্তিতে অনেক শর্ত আছে, তবে মাঠপর্যায়ে সেসব শর্ত বাস্তবায়ন করা কঠিন। এছাড়া রয়েছে চুক্তি লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ। অতীতে এ ধরনের চুক্তি দ্রুত ভঙ্গ হয়েছে, বিশেষ করে সীমান্ত গমনযোগ্যতা ও যুদ্ধবিরতির দিক থেকে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলের সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতা সন্দেহযুক্ত- স্থানীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। সুইচব্যাক অপশন ও রিভাইভাল একটি আশঙ্কা। কোন ভুল বা বিরোধে জোরপূর্বক শান্তিচুক্তি বাতিলের উপাদান থাকবে- সুতরাং যুদ্ধ পুনরায় শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গাজার রাজনীতির ভবিষ্যৎ কোথায়
গাজার রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন এক ‘নতুন ভারসাম্য অনুসন্ধান’-এর পর্যায়ে। হামাসের অস্তিত্ব, অন্তর্বর্তী প্রশাসনের বৈধতা, ঐক্য সরকারের প্রাতিষ্ঠানিকতা এবং আন্তর্জাতিক শক্তির উপস্থিতি- সব কিছু মিলে তৈরি হচ্ছে এক নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ।
এ সমীকরণে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো : গাজার জনগণের নিজস্ব সিদ্ধান্ত কোথায়? যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, তবে গাজা পুনর্জন্ম নিতে পারে। অন্যথায়, এটি থেকে যাবে বহুমাত্রিক প্রতিযোগিতার এক ‘নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডণ্ড’ যেখানে শান্তির চেয়ে স্থিতিশীলতা হবে বড় অর্জন।
গাজা যুদ্ধোত্তর কূটনীতিতে তিনটি প্রধান শক্তি এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যারা একটি ‘আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানাধীন ফিলিস্তিনি প্রশাসন’ গঠনের মাধ্যমে ইসরাইলের নিরাপত্তা স্বার্থ অক্ষুণœ রাখতে চায়; আরব শক্তি মিসর, কাতার ও জর্দান, যারা গাজায় আরব লিগ-সমর্থিত শান্তিরক্ষী কাঠামো চায়; রাশিয়া ও ইরান, যারা এই প্রক্রিয়াকে ‘পশ্চিমা আধিপত্যবাদী পুনর্গঠন’ বলে চিহ্নিত করে হামাস ও ইরানঘনিষ্ঠ প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সাথে সমন্বয় বজায় রাখছে।
এই ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু এখন গাজার প্রশাসন নয়; বরং ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের কাঠামো, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও জেরুসালেমের রাজনৈতিক অবস্থান।
ইসরাইল যুদ্ধোত্তর সময়ে দু’টি কৌশল অনুসরণ করছে; প্রথমত, গাজার উত্তর অংশে ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ ধরে রাখা; দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং আরব অংশীদারদের মাধ্যমে করিয়ে নেয়া। এভাবে তারা গাজায় সরাসরি শাসন না করেও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। এ অবস্থান আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়লেও যুক্তরাষ্ট্রের নীরব সমর্থনে তা কার্যকর রয়ে গেছে।
যুদ্ধোত্তর গাজা নিয়ে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো, বিশেষত বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক ও মালয়েশিয়া, একটি ‘ন্যায়ভিত্তিক শান্তি কাঠামো’র দাবি তুলেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠন তহবিল’-এ অংশ নেয়ার ঘোষণা এবং জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রস্বীকৃতির পক্ষে অবস্থান আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ অবস্থান একদিকে বাংলাদেশের নৈতিক কূটনীতির প্রতিফলন, অন্যদিকে গ্লোবাল সাউথের ঐক্যের প্রতীক।
ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র পুনর্গঠনের পথ
যুদ্ধোত্তর গাজা এখন শুধু পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জে নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ধারণার পুনর্জন্মের প্রান্তে দাঁড়িয়ে। হামাস-ফাতাহ বিরোধ মিটিয়ে যদি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশাসন গঠন সম্ভব হয়, তবে আন্তর্জাতিক সহায়তা ও আঞ্চলিক সংহতির মাধ্যমে নতুন এক ফিলিস্তিনের রূপরেখা তৈরি হতে পারে। অন্যথায় গাজা থেকে শুরু হবে আরেকটি ‘প্রক্সি রাজনীতি’ যেখানে শান্তি থাকবে কাগজে, বাস্তবে থাকবে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা।
যুদ্ধ শেষ হলেও গাজার শান্তি এখনো যুদ্ধের মধ্যেই বন্দী। এটি কেবল একটি ভূখণ্ড নয়; বরং বৈশ্বিক শক্তির নীতিগত পরীক্ষাগার। যে বিশ্ব একদিন গাজার শিশুদের রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিল, সেই বিশ্ব কি এখন তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও মানবতার পথচিত্র।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত