আমাদের বর্তমান বিচারব্যবস্থায় দেওয়ানি মামলার বিচার পরিচালনায় সহকারী জজের আদালত সর্বনিম্ন আদালত। সহকারী জজ অধস্তন বিচার বিভাগের প্রারম্ভিক পদ। বর্তমানে সহকারী জজ সিভিল জজ নামে অভিহিত। একজন সহকারী জজ পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে সিনিয়র সহকারী জজ, যুগ্ম জেলা ও সহকারী দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ পদে উত্তীর্ণ হন। দায়রা জজ নামে স্বতন্ত্র কোনো পদ নেই। একজন জেলা জজ যখন দায়রা মামলার বিচারকার্য পরিচালনা করেন তখন তিনি দায়রা জজ নামে অভিহিত হন। যুগ্ম জেলা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজ অনুরূপভাবে দায়রা মামলা বিচার করাকালীন সহকারী দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজ নামে অভিহিত হন। দায়রা জজের অনুরূপ ম্যাজিস্ট্রেট নামক স্বতন্ত্র কোনো পদ নেই। সহকারী জজদের ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতার্পণ করা হলে তারা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন। অনুরূপ একজন যুগ্ম জেলা জজ ও অতিরিক্ত জেলা জজকে যথাক্রমে অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট বা অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট এবং মুখ্য বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট বা মুখ্য মহানগর ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় ম্যাজিস্ট্রিয়াল ক্ষমতার্পণ করা হলে তারা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন। ১ নভেম্বর, ২০০৭ বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব অধস্তন বিচার বিভাগের সহকারী জজ ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের ওপর অর্পণ পূর্ববর্তী প্রশাসন ক্যাডারের সহকারী কমিশনার ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করতেন।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগ উচ্চ ও অধস্তন এই দুই ধরনের আদালত সমন্বয়ে গঠিত। উচ্চাদালত বলতে সুপ্রিম কোর্টকে বোঝায় এবং উচ্চাদালত আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ সমন্বয়ে গঠিত।
আধুনিক বিশ্বের সব দেশে বিচার বিভাগকে জনগণের শেষ ভরসাস্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জনগণের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে, তারা অপর সব কর্তৃপক্ষ থেকে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হলেও বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হলে সেই বঞ্চনার অবসান হবে।
সহকারী জজ পদে নিয়োগ পেতে ন্যূনতম যোগ্যতা হলো একজন প্রার্থীকে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকসহ এলএলবি অথবা এলএলবি (সম্মান) পর্যন্ত সব পরীক্ষায় ন্যূনতম দ্বিতীয় শ্রেণীর ডিগ্রিধারী হতে হবে। অতঃপর জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন আয়োজিত ১২ শ’ নম্বরের লিখিত ও ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় ন্যূনতম ৫০ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হতে হবে। তবে কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, চাকরি প্রার্থীর তুলনায় পদের সংখ্যা সীমিত হওয়ায় প্রতিবার নিয়োগে লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষায় গড়ে ৫৫ শতাংশের নিচে নম্বর প্রাপ্ত হলে নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হতে থাকে। ১৯৯৮ সাল পূর্ববর্তী সহকারী জজরা সরকারি কর্ম কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন। তখনো নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণে শিক্ষাগত যোগ্যতা বর্তমানের অনুরূপ ছিল। যদিও সামরিক ফরমানে নিয়োগবিধি শিথিল করে ১৯৮৩-৮৫ সাল পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয় আয়োজিত মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রায় ৪৫০ সহকারী জজ নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্টে অন্যূন ১০ বছর অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করে থাকলে অথবা বিচার বিভাগীয় কোনো পদে ১০ বছর কাজ করে থাকলে এবং এর অতিরিক্ত সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য নির্ধারিত যোগ্যতা থেকে থাকলে একজন ব্যক্তি উচ্চাদালতের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্যতা অর্জন করেন।
সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের বিধানাবলি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, উচ্চাদালতের বিচারক নিয়োগে যোগ্যতা সাপেক্ষে দু’টি শ্রেণীকে যোগ্য করায় সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের চেতনার আলোকে যেকোনো নিয়োগে উভয় শ্রেণী থেকে ৫০ শতাংশ হারে নিয়োগ দেয়া আবশ্যক; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রতিটি নিয়োগে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের কোনো ধরনের বাস্তব কারণ ছাড়া তাদের প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
উচ্চাদালতে বিচারক নিয়োগে ২০২৫ সালে প্রণীত অধ্যাদেশ জারির আগে আইনের দ্বারা যোগ্যতা নিরূপিত না হয়ে থাকলেও অনুমিত হয়; অধস্তন বিচার বিভাগের প্রারম্ভিক পদ অর্থাৎ সহকারী জজ পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যে ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, এর চেয়ে নিম্নের যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির উচ্চাদালতে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো- সহকারী জজের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যে নিম্নতম যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, এর চেয়ে নিম্নতম যোগ্যতাসম্পন্ন একাধিক বিচারক উচ্চাদালতে কর্মরত রয়েছেন। আরো উল্লেখ্য, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী, উচ্চাদালতের হাইকোর্ট বিভাগকে অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। স্বভাবত প্রশ্ন দেখা দেয়, কর্তৃপক্ষ তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করবেন সে কর্তৃপক্ষের সব বিচারকের শিক্ষাগত যোগ্যতার মান যাদের ওপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করা হবে; তাদের চেয়ে উৎকৃষ্টতর হতে হবে। একজন সহকারী জজ নিয়োগ লাভ-পরবর্তী যদি দেখতে পান তার চেয়ে নিম্ন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে তার ওপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সে ক্ষেত্রে ওই সহকারী জজ উৎকৃষ্টতর যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়া সত্তে¡ও সংবিধান ও আইনের কোন বিধানাবলির আলোকে কেন তার চেয়ে নিম্নতম যোগ্যতাসম্পন্ন দ্বারা তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন এর বিচার তিনি কার কাছে চাইবেন?
নিকট অতীতে সুনামগঞ্জে কর্মরত এক বছর চাকরিকাল পূর্ণ হয়েছে মহিউদ্দীন নামে একজন সহকারী জজ কুমিল্লা শহরের শ্বশুরালয়ে বেড়াতে গিয়ে পুলিশের হাতে নির্মমভাবে প্রহৃত হন। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ওই সহকারী জজ তার শ্বশুরালয়ে অভিযানে অংশগ্রহণকারী পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের তার বিচারিক পরিচয় অবহিত করলেও তাতে তারা কর্ণপাত করেননি। প্রহার থেকেও রেহাই পাননি। তবে তাকে ভাগ্যবান বলতে হবে, হয়তো বিচারিক পরিচয়ে তাকে তার শ্বশুরের মতো গ্রেফতার হতে হয়নি। মহিউদ্দীনের ঘটনা পুরো দেশবাসীর বিবেককে নাড়া দিলেও দুঃখজনকভাবে বলতে হয়- এই ঘটনার পর বাংলাদেশের কোনো জজশিপ থেকে প্রহারের বিপক্ষে পুলিশের অনৈতিক ও বেআইনি অবস্থান বিষয়ে কোনো রেজুলেশন গৃহীত হয়নি। উপরোক্ত ঘটনাটির আগে ঘটিত অপর এক ঘটনায় দেখা গেছে, নরসিংদী জেলা জজ আদালতে কর্মরত যুগ্ম জেলা জজ ও সহকারী দায়রা জজ ইমান আলী নিজের কার্যালয়ে যাওয়ার সময় আদালত অভ্যন্তরস্থ সড়কে পুলিশ সদস্যদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হন। তিনি তার পরিচয় দেয়ার পরও লাঞ্ছনা থেকে রেহাই পাননি। এই ঘটনাও অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে অন্তরায় বিবেচিত হলেও দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এখানে প্রাসঙ্গিক যে, ২০০৫ সালে উগ্রবাদীদের দ্বারা বোমা হামলায় ঝালকাঠিতে দু’জন সহকারী জজ নিহত হলে তৎকালীন সরকার দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরপূর্বক আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। তা ছাড়া নিহত দুই সহকারী জজের স্ত্রীদের যোগ্যতানুযায়ী চাকরি দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। সে সময় তৎকালীন প্রধান বিচারপতির তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপে পুলিশের আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ত্বরিত ব্যবস্থা নেন। সেই সাথে শোকসন্তপ্ত পরিবারদ্বয়কে সান্ত্বনা দিতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ঝালকাঠি গিয়ে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে। সে সময় বাংলাদেশের সব জজশিপ থেকে ঘটনার নিন্দা জানিয়ে রেজুলেশন নেয়া হয়েছিল। জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও রেজুলেশন গ্রহণপূর্বক কার্যকর ও যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ঘটনাটির আগে উচ্চাদালতের বিচারক ও জেলা জজরা চলাফেরার সময় সার্বক্ষণিক দেহরক্ষীর নিরাপত্তা পেতেন না। ঘটনাপরবর্তী প্রথমত : সরকার উচ্চাদালতের বিচারকদের নিরাপত্তায় গানম্যান দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে জেলা জজদের নিরাপত্তায় গানম্যান দেয়া হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সহকারী জজদের রক্তের বিনিময়ে উচ্চাদালতের বিচারক ও জেলা জজরা গানম্যানের নিরাপত্তা পাচ্ছেন; সেখানে নিরাপত্তার অভাবে আজ যখন একজন সহকারী জজ প্রহৃত ও লাঞ্ছিত হন এবং তার জীবন বিপন্ন হওয়ার পথে তখন সুবিধাভোগীরা নিশ্চুপ কেন? অন্তত ২০০৫ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, অনুরূপ পদক্ষেপ কি কাম্য ছিল না? এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, নরসিংদীর ঘটনাপরবর্তী ২০০৫ সালের মতো যথাযথ ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হলে নিকট অতীতে সংঘটিত কুমিল্লার ঘটনাটি ঘটত না।
অধস্তন বিচার বিভাগের প্রারম্ভিক বিচারকদের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস কোন পর্যায়ে ছিল তা খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, পাকিস্তান শাসনামলের শেষভাগে ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহ জজশিপে কর্মরত সিনিয়র মুন্সেফ মো: বদরুজ্জামানের আদালতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মুনায়েম খানের ছোট ভাই খোরশেদ খানের একটি দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন ছিল। মামলার রায় প্রদানপূর্ববর্তী প্রতিদিন অফিসে যাওয়া ও অফিস থেকে ফেরার সময় বদরুজ্জামান সাহেব খোরশেদ খানের বাণিজ্যিক কার্যালয়ের সম্মুখ দিয়ে যাতায়াত করতেন। প্রতিদিন বদরুজ্জামান সাহেবকে খোরশেদ খান সালাম দিতে উদগ্রীব থাকতেন; কিন্তু মামলার রায় প্রদান-পরবর্তী দেখা গেল রায় বিপক্ষে যাওয়ায় খোরশেদ খান ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রীর ভ্রাতা হওয়া সত্তে¡ও সালাম প্রদান থেকে বারিত হওয়া ছাড়া এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি, যা তার ভাই গভর্নর সাহেবের জন্য এবং বিচার বিভাগের জন্য বিব্রতকর হয়। উল্লেখ্য, বদরুজ্জামান সাহেব সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করেন।
জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত অন্য এক সংবাদ থেকে জানা যায়, ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনরত জনৈক সহকারী জজ কয়েক শ’ বোতল ফেনসিডিলসহ মাইক্রোবাসে পরিভ্রমণকালে ঢাকা কলেজের সামনে থেকে পুলিশের হাতে আটক হন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই ম্যাজিস্ট্রেট বিচারিক দায়িত্ব পালনকালে জব্দ করা আলামত ফেনসিডিল ধ্বংসের আদেশ দিয়ে একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় আসল ফেনসিডিল অপসারণপূর্বক পানিভর্তি ফেনসিডিলের বোতল দিয়ে প্রতিস্থাপনের বেআইনি ও জঘন্য কার্যে লিপ্ত ছিলেন। আরো আশ্চর্য হতে হয়, যখন শোনা যায়- ওই ম্যাজিস্ট্রেট মন্ত্রণালয়ের সৎ, দক্ষ, জ্যেষ্ঠ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের অবমূল্যায়নে বিশেষ উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন দুর্নীতিগ্রস্ত প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তার আশীর্বাদপুষ্ট। বিচারক পরিচয় দেয়ার পরও পুলিশ সদস্য ওই বিচারকের প্রতি কোনোরূপ অনুকম্পা না দেখিয়ে আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- পুলিশ কি নিজেদের ক্ষেত্রে তা নিশ্চিত করতে পারছে?
পারছেন না বলেই দেখা গেল, ২০১৩ সালের এপ্রিলে গোয়েন্দা পুলিশের জনৈক উপপুলিশ কমিশনারের নির্দেশে ঢাকার গুলশানে জনৈক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এক কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি তখনকার ক্ষমতাসীন দলের একজন সংসদ সদস্য এবং সাংবাদিকদের সাহসী পদক্ষেপে বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে পরে দেখা গেল, অভিযানে অংশগ্রহণকারী নিম্নপদস্থ সাব-ইন্সপেক্টর ও কনস্টেবল পর্যায়ের দু’তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে গোয়েন্দা উপপুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া দূরের কথা বিভাগীয় কার্যক্রম পর্যন্ত নেয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে অপরাধীর পদমর্যাদার চেয়ে অপরাধের গুরুত্ব অনুধাবন করে অপরাধসংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে বিভাগীয় শৃঙ্খলা অটুট থাকত। এই একটি ঘটনা যে বাজে নজির হিসেবে পুলিশ বাহিনীর ভাবমর্যাদার ওপর কালিমা লেপন করেছে; তা ভেবে পুলিশের সৎ, দক্ষ, মেধাবী ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা শঙ্কিত।
বিচারকরা একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে প্রতিকার প্রদানের মাধ্যমে সমাজে তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রাখেন। এ ক্ষেত্রে অধস্তন আদালতের প্রারম্ভিক পদের বিচারক থেকে উচ্চাদালতের সব ন্যায়নিষ্ঠ এবং নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচল বিচারকের ভূমিকা অনন্য। এ অনন্য অবদান রাখতে গিয়ে একজন বিচারক তার পদমর্যাদা যা-ই হোক না কেন, যদি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন তবে রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে অপরাধী যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন তাদের বিচারের আওতায় এনে বিচারকদের নিরাপত্তাহীনতা ও হয়রানি থেকে রক্ষা করতে হবে। তাই বিচারকদের সরকারের কাছে বিচার চাওয়ার মতো অবস্থা না থাকলেও আজ এ কথা ভেবে আশ্বস্ত হতে হয় যে, ন্যায়বিচার করে যেতে পারলে শুধু ইহজগৎ নয় পরজগতেও পুরস্কার পাওয়া যাবে। এ বিশ্বাসে তারা মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে বিচার চাইবেন, যিনি কখনো মজলুমদের (নিপীড়িত) বিমুখ করেন না। তারা নিশ্চিত তিনি (মহান রাব্বুল আলামিন) তাদের পরীক্ষার জন্য সাময়িক বিপদ দিতে পারেন। তবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে তাদের উভয় জীবন যে সার্থক- এই বিশ্বাস আজ তাদের প্রতি বঞ্চনা ও অন্যায়ের প্রতিবিধানে আত্মসন্তুষ্টির পরিচায়ক।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক



