চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ব্লক

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পররাষ্ট্রনীতি, চীনের গভীর কৌশল ও পাকিস্তানের প্রাসঙ্গিকতার সন্ধান এমনভাবে একত্রিত হচ্ছে যা ভারতের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়।

দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট একটি গভীর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা পাকিস্তান, চীন ও বাংলাদেশের সাথে জড়িত একটি সম্ভাব্য নতুন ব্লকের উত্থানের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়েছে। এ ত্রিপক্ষীয় জোট, যদিও এখনো একটি আনুষ্ঠানিক জোট নয়, আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিকাশ এবং এর প্রধান কুশীলবদের কৌশলগত উচ্চাকাক্সক্ষার মাধ্যমে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে গভীর করার মাধ্যমে দ্রুত কিছু অর্জন করছে। জুন ২০২৫ সালে কুনমিংয়ে উদ্বোধনী চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলন, উচ্চপর্যায়ের বিনিময়, অবকাঠামোগত উদ্যোগ ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার একটি ধারাবাহিক আলোচনার সাথে দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যগত প্রান্তিককরণের পুনর্বিবেচনার ইঙ্গিত দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে বক্ষ্যমান ব্লকের প্রেরণা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলির একটি বিশ্লেষণ। এটি প্রতিটি দেশের কৌশলগত স্বার্থ, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) ভূমিকা, পতিত শেখ হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পররাষ্ট্রনীতি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির উপর প্রভাব ফেলেছে।

সার্কের পতন এবং বিকল্প গোষ্ঠীর উত্থান

সার্ককে গতিশীল করতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুরু থেকে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, ভারতের অনীহা এবং বিমেসটেককে গতিশীল করার আয়োজন সার্ক অধ্যায় সুবিধা করতে পারেনি। সার্কের পতন এবং বিকল্প গোষ্ঠীগুলোর উত্থান দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক, যা একসময় আঞ্চলিক সংহতকরণের প্রধান প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ধরা হয়েছিল, বিবিধ কারণে কার্যকরভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনটি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তী প্রচেষ্টা দ্বিপক্ষীয় বিরোধে লাইনচ্যুত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপট চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সাথে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগকে একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক ব্লকে সম্প্রসারণের প্রস্তাব দিয়েছে- কার্যকরভাবে ভারত ছাড়া একটি ‘সার্ক ২.০’ এমনটি ধরা হচ্ছে। সার্কের পক্ষাঘাতকে এড়িয়ে বাণিজ্য, যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নমনীয়, ইস্যুভিত্তিক পক্ষ তৈরি করা এর লক্ষ্য। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানকে হয়তো আমন্ত্রণ জানানো হবে, তবে, নয়াদিল্লির সাথে জোটবদ্ধ হওয়ায় ভুটানের যোগ দেয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ঐতিহাসিক সম্পৃক্ততা

দক্ষিণ এশিয়ার সাথে চীনের সম্পর্ক সতর্ক কূটনীতি থেকে দৃঢ় কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার দিকে বিকশিত হতে শুরু করেছে। ঐতিহাসিকভাবে, পাকিস্তানের সাথে চীনের জোট ভারতের পাল্টা শক্তি হিসেবে কাজ করছে, বিশেষত ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পরে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান এবং ভারতের সাথে প্রাথমিক জোটবদ্ধতা ঢাকায় চীনের প্রভাব সীমিত করে। তবে পরবর্তীতে ঢাকার সাথে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ করে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বিআরআইতে যোগ দেয়। এ ছাড়া মূল খাতে চীনা বিনিয়োগকে স্বাগত জানানোর সাথে সাথে সম্পর্কটি ‘কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বে’ উন্নীত হয়।

চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম আনুষ্ঠানিক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক ১৯ জুন-২০২৫, কুনমিংয়ে চীন-দক্ষিণ এশিয়া প্রদর্শনীর সাইডলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে তিন দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন এবং বাণিজ্য, অবকাঠামো, সামুদ্রিক বিষয়, জলবায়ু পরিবর্তন ও জনগণের মধ্যে বিনিময়ে সহযোগিতা বৃদ্ধির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছিল। শিল্প, কৃষি, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং পরিবেশবান্ধব পরিকাঠামো ক্ষেত্রে যৌথ প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিকাশ এবং জীবন-জীবিকার মানোন্নয়নে চুক্তি ছিল মূল বিষয়। বাস্তবায়ন অনুসরণ করতে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের প্রতিশ্রুতি, যদিও বাংলাদেশ একটি আনুষ্ঠানিক যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপে যোগ দিতে অস্বীকার করেছে, যা তার সতর্কতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।

পাকিস্তান-বাংলাদেশ : কৌশলগত গভীরতা এবং অর্থনৈতিক সুবিধা

পাকিস্তানের জন্য, ত্রিপক্ষীয় ব্লক বেশ কয়েকটি সুবিধা রয়েছে। ভারতের আধিপত্য ঠেকাতে পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে আগে কৌশলগত গভীর সম্পর্ক চেয়ে আসছে। বাংলাদেশের সাথে নতুন সম্পর্ক স্থাপন করে, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা ক্ষেত্র ইসলামাবাদকে বঙ্গোপসাগর ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুবিধা দেয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। অর্থনীতি চাপের মধ্যে থাকায় পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে বর্ধিত বাণিজ্য ও যোগাযোগকে নতুন বাজারে প্রবেশ, বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ঐতিহ্যগত অংশীদারদের উপর নির্ভরতা কমানোর উপায় হিসেবে দেখে অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণের চেষ্টা করছে। নতুন ব্লক ইসলামাবাদকে আঞ্চলিক প্রভাবশালী হিসেবে নিজেকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে এবং দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতার অ্যাজেন্ডা রূপ দেয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে। সরাসরি শিপিং লিংক পুনরায় চালু, সরাসরি ফ্লাইট চলাচলের পরিকল্পনা এবং যৌথ বিজনেস কাউন্সিল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে উন্নত যোগাযোগের ভিত্তি স্থাপন করছে। আঞ্চলিক সরবরাহ চেইন আরো গতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য ঐতিহাসিকভাবে সীমিত, রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং লজিস্টিকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ২০২৪ সাল থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২৭ শতাংশ বেড়েছে।

পাকিস্তান-বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আলোচনা হয় ২০২৫ সালের এপ্রিলে। ১৫ বছরের মধ্যে প্রথম এই জাতীয় আলোচনায়-১৯৭১ সাল থেকে অমীমাংসিত বিষয়গুলো, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। পাকিস্তানের ‘আমান-২০২৫’ নৌ-মহড়ায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ, যৌথ মহড়া এবং অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়ে আলোচনা, বিশেষত জেএফ-১৭ থান্ডার, সামরিক অগ্রগতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে চিহ্নিত করে। কয়েক দশক পর বাংলাদেশী অফিসারদের জন্য পাকিস্তানে সামরিক প্রশিক্ষণ পুনরায় শুরু হয়েছে। চীনের বেইডো স্যাটালাইট প্রযুক্তি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয়ে রিয়েল টাইম সুবিধাভোগ করবে ব্লকের সক্রিয় সদস্য হিসেবে।

চীন-বাংলাদেশ : কৌশলগত গভীরতা ও অর্থনৈতিক সুবিধা

সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক ঘটনাবলি বাংলাদেশে আরো সূ² আকার ধারণ করেছে যেমন- ভারতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা হ্রাস। সীমান্ত সংঘর্ষ, পুশইন, ভিসা বন্ধ, রফতানিতে কঠোরতা, গণমাধ্যম যুদ্ধ, পানি বণ্টন ও সংখ্যালঘু অধিকার ইত্যাদি নানা ইস্যু নিয়ে হাসিনা-উত্তর ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঢাকাকে বিকল্প অংশীদার খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করেছে। অবকাঠামো, উৎপাদন ও জ্বালানি খাতে চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশকে প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রফতানি সম্প্রসারণের সুযোগ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিপথ টেকসই করতে চীনের বাজার ও প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার অত্যাবশ্যকীয় বলে মনে করা হচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বেইজিং সফর, মার্চ ২০২৫- মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণে ৪০০ মিলিয়ন ডলার এবং চট্টগ্রামের চীন শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ৩৫০ মিলিয়ন ডলারসহ চীনা বিনিয়োগ, ঋণ এবং অনুদানে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার অর্জন করেছে। পরিকাঠামো, স্বাস্থ্য পরিষেবা, উৎপাদন এবং পানিব্যবস্থাপনা নিয়ে ৯টি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীন ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ রফতানিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বাড়িয়েছে। ঋণের সুদের হার কমানোর বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। চীন বাংলাদেশের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গভীর করেছে, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সরবরাহ করছে।

বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০২৩-২৪ সালে ২৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে চীনের বিআরআই বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে বিস্তৃত অবকাঠামো প্রকল্প, পদ্মা সেতু ও রেল সংযোগ, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মিত এসব প্রকল্প বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে রাজধানী সংযুক্ত হয়েছে, বাণিজ্য ও গতিশীলতা বেড়েছে। মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণে চীন বন্দরের সক্ষমতা সম্প্রসারণে ৪০০ মিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অতিরিক্ত ঋণের সাথে মোট চীনা তহবিল সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি নিয়ে এসেছে। এ প্রকল্পের লক্ষ্য নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে আঞ্চলিক বাণিজ্য সহজতর করা। কয়লা, সৌর ও এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশের গ্রিডে হাজার হাজার মেগাওয়াট যুক্ত করেছে, যা শিল্প প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করছে। ফাইভ-জি, ক্লাউড কম্পিউটিং ও স্মার্ট গভর্নেন্সে বাংলাদেশের উচ্চাকাক্সক্ষাকে সমর্থন করছে চীনা টেক জায়ান্টরা।

ব্লকের কিছু চ্যালেঞ্জ

চীনের কাছে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ, পরিচালনাযোগ্য হলেও দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক নির্ভরতা ও ‘ঋণের ফাঁদের’ ঝুঁকি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে, যেমনটি শ্রীলঙ্কায় দেখা গেছে। রাজনৈতিক মেরুকরণ, জনসংশয় ও অমীমাংসিত ঐতিহাসিক অভিযোগ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা, বিশেষ করে বাংলাদেশে, গভীর কৌশলগত প্রান্তিককরণের সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে। প্রক্সি যুদ্ধ, বিদ্রোহ ও আন্তঃসীমান্ত অস্থিতিশীলতার শঙ্কা নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে, বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরে। জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন ও জনস্বাস্থ্যের মতো অভিন্ন চ্যালেঞ্জগুলোতে সম্মিলিত পদক্ষেপকে দুর্বল করতে পারে, যা যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। পশ্চিমা শক্তি, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক এবং প্রতিক্রিয়া হিসেবে সহায়তা, বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সামঞ্জস্য করতে বদ্ধপরিকর। ব্লকের সদস্যদের বিষয়টি সব সময় যত্ন সহকারে পরিকল্পনায় স্থান দিতে হবে।

চীন-পাকিস্তান ফ্ল্যাগশিপ সিপিইসি দ্বিতীয় পর্যায়ের করিডোরটি অবকাঠামো ও জ্বালানি থেকে কৃষি, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং সামুদ্রিক বাণিজ্যসহ বৃহত্তর অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের দিকে মনোনিবেশ করেছে। পাকিস্তান ২৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ পেয়েছে, গোয়াদার বন্দর আঞ্চলিক সংযোগে একটি মূল গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আবিভর্ূত হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, চীন-পাকিস্তান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং সিপিইসি অর্থনৈতিক সংহতকরণকে আরো গভীর করেছে।

ভারতের প্রতিক্রিয়া ও কৌশলগত আচরণ

পাকিস্তান-চীন-বাংলাদেশ জোটকে ভারত ঘোরতরভাবে সন্দেহের চোখে দেখে, এটিকে নয়াদিল্লি নিজের প্রতিবেশী অঞ্চল ঘিরে ফেলার এবং প্রান্তিক করার প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাখ্যা করে। চীনের পৃষ্ঠপোষকতায় তার পশ্চিমা ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীদের একত্রীকরণকে ভারতের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও আঞ্চলিক নেতৃত্বে সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। শিলিগুড়ি করিডোর যা ‘চিকেন নেক’ নামে সর্বাধিক পরিচিত- একটি কৌশলগত দুর্বলতা, যা ভারতের মূল ভূখণ্ডকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে সংযুক্ত করেছে। অরুনাচলে চীনের সামরিক সমাবেশ ও লালমনিরহাটে অব্যবহৃত বিমানবন্দরকে যুদ্ধবিমান ও সাধারণ বিমান চলাচলের উপযোগী করায় ভারত উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের সাথে নৌ-সহযোগিতার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিকে ভারত মহাসাগরে ভারতের আধিপত্য দুর্বল করার এবং সমুদ্র যোগাযোগের লাইনকে হুমকিতে ফেলার বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছে দিল্লি। ড্রোন কার্যকলাপ বৃদ্ধি, সীমান্ত সংঘর্ষ ও উন্নত নজরদারি প্রযুক্তি মোতায়েনের প্রতিবেদনগুলো পরিস্থিতির অস্থিরতা তুলে ধরেছে।

সম্প্রতি আসামের ধুবড়ি অঞ্চলে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে ভারতের নতুন সেনানিবাস স্থাপন কেবল একটি সামরিক পদক্ষেপ নয়; বরং এর মাধ্যমে ভারত সুনির্দিষ্ট কিছু কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক বার্তা দিতে চাচ্ছে। দেড় হাজার বিশেষ কমান্ডো বাহিনীর এ সেনানিবাসের মাধ্যমে ভারত তার ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার বা পূর্ব সীমান্তে ‘র‌্যাপিড রেসপন্স ক্যাপেবিলিটি’ বা দ্রুত সাড়া দেয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধির সিগন্যাল দিচ্ছে।

শিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তা : ধুবড়ি অঞ্চলটি ভারতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডোর থেকে মাত্র ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। করিডোরটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর যোগাযোগের একমাত্র পথ। এ সেনানিবাস স্থাপনের মাধ্যমে ভারত সেখানে একটি ভূ-কৌশলগত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে চাচ্ছে; যাতে গুরুত্বপূর্ণ করিডোরটি সুরক্ষিত থাকে।

বাংলাদেশ থেকে ‘নন-স্টেট ইনফিল্ট্রেশন’ বা অ-রাষ্ট্রীয় অনুপ্রবেশ এবং আন্তঃসীমান্ত অস্থিরতার আশঙ্কা মোকাবেলা এবং বর্ডার ইনসার্জেন্সিরোধে এ সেনানিবাস কাজ করবে। সেনানিবাস স্থাপনের মাধ্যমে ‘কনস্ট্যান্ট সারভলেন্স এনভেলপ’ বা নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। ভারত এখন ড্রোন বা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, বিশেষ করে লালমনিরহাট বিমানবন্দরের আশেপাশের সামরিক ও বেসামরিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং ঢাকার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উন্নত করার প্রচেষ্টার বিপরীতে ভারত আধিপত্যবাদী মনোভাবের সামরিক বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

পরিশেষ

পাকিস্তান-চীন-বাংলাদেশ জোট দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ল্যান্ডস্কেপে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসবে। ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, কৌশলগত উচ্চাকাক্সক্ষা এবং বাস্তববাদী বিবেচনার সংমিশ্রণ দ্বারা চালিত এই মেরুকরণ আঞ্চলিক শক্তির গতিশীলতা, অর্থনৈতিক সংহতি ও নিরাপত্তা কাঠামোকে নতুন রূপ দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও ব্লকটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সংযোগ ও কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনে যথেষ্ট সুযোগ সরবরাহ করে, এটি ঋণ স্থায়িত্ব, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আঞ্চলিক বিভাজনের সাথে সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জও তৈরি করে।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পররাষ্ট্রনীতি, চীনের গভীর কৌশল ও পাকিস্তানের প্রাসঙ্গিকতার সন্ধান এমনভাবে একত্রিত হচ্ছে যা ভারতের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়। সেই সাথে সব কুশীলবকে আরো বহুমুখী ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য করে। এ ব্লকের ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ভর করবে সদস্যদের প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখার সক্ষমতার উপর, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও টেকসই সহযোগিতা অনুসরণ করার ক্ষমতার উপর।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার