শিক্ষাঙ্গনে শান্তি নেমে আসুক

লাঠিয়াল বাহিনী, হেলমেট বাহিনী, কমনরুম কালচারে ডুবে যাওয়া ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে এ ধরনের পরিবর্তন আশা জাগাচ্ছে। কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা না ঘটায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন।

ইদানীং পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন টকশো ও রাজনৈতিক বক্তৃতা বিবৃতি শুনলে-দেখলে মনে হবে, দেশে কোনো সমস্যাই নেই। অর্থনীতির অবস্থা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পতিত ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানের হুমকি কোনো সমস্যাই নয়। সমস্যা নয় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লোপাট, গুম সংস্কৃতি আয়নাঘরের সাথে সম্পৃক্তদের বিচার না হওয়া। ফ্যাসিবাদের দোসরদের সগৌরবে স্বস্থানে অনেক ক্ষেত্রে আরো ক্ষমতাবান হয়ে বিরাজমান থাকা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন আইনশৃঙ্খলার সংস্কার- এসব বাত কি বাত। দেশে এখন একটিই সমস্যা। তা হচ্ছে- ছাত্রশিবিরের উত্থান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা শিবিরকে নির্বাচিত করেছে, এটিই দেশের প্রধানতম সমস্যা। টেলিভিশনের টকশোতে তথাকথিত সুশীলদের আর্তচিৎকার- সব গেল, সব গেল। অথচ তারাই আবার গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ বিবেচনায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজ পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে, তাতে কথিত এসব গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালাদের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে তারা দিশেহারা হয়ে গেছেন। এর মাধ্যমে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ভোটাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, তা-ও ভুলে গেছেন। জুলাই ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জেন-জি প্রজন্মের মধ্যে যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল, যে আকাঙ্ক্ষা ডানা মেলেছিল তা অনুধাবনের ব্যর্থতাই এহেন মনোভাবের প্রকাশ।

জেন-জিরা এখন অতীতের ন্যারেটিভ বা রাজনৈতিক ট্যাগে নিজেদের পরিচিত করতে চায় না। তারা সামনে এগোনোর স্বপ্ন দেখে, সামনে এগোনোর বার্তা শুনতে চায়। তারা আকাশটাকে স্পর্শ করার স্বপ্নে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চায়। এই কর্মযোগ বা পরিকল্পনা তারা শুনতে চায় রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে। এখানেই প্রচলিত রাজনীতির সাথে জেন-জিদের পার্থক্য। তারা চাকরিজীবী বা রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার চিন্তা করে না। তাদের চিন্তার পরিধি আত্মবলে বলীয়ান হয়ে পরিচ্ছন্ন জাতিসত্তার বোধে উজ্জীবিত। এর প্রকাশ ঘটেছে ডাকসু ও জাকসুর নির্বাচনে। প্রকাশ ঘটেছে নেপালের কায়েমি স্বার্থবাদী সরকার পতনের মধ্যেও। মূলত যে সব নেতা জেন-জির অন্তর্নিহিত মর্মবাণী বুঝতে পারবেন, তারা টিকে যাবেন। যারা নিজেদেরকে তাদের চিন্তা-চেতনায় সম্পৃক্ত করতে পারবেন না, তারা ভবিষ্যতের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

ডাকসু অথবা জাকসু নির্বাচনে যারা জয়ী হয়েছেন তারা ধারাবাহিক ছাত্ররাজনীতির মধ্যে একটি পরিবর্তন আনতে পেরেছেন। তারা শুধু তাদের কর্মী-সমর্থকদের ভোটে জিতেননি। তারা দলীয় গণ্ডির বাইরের ছাত্রদের আকর্ষণ করতে পেরেছেন। তারা জুলাই গণবিপ্লবের ঐতিহ্য এবং চেতনাকে লালন করেছেন, ধারণ করেছেন, বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। সবার সহযোগিতার কথা বলেছেন, সহযোগিতা চেয়েছেন। নির্বাচন পরবর্তী বিজয় র‌্যালি, র‌্যাগিংয়ের মতো বিব্রতকর কাজ থেকে বিরত থেকেছেন। বিরোধী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের উপর কোনো ধরনের উগ্র আচরণের প্রকাশ কিংবা হামলে পড়ার ঘটনাও দেখা যায়নি। এটি তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে নিঃসন্দেহে। পক্ষান্তরে নির্বাচনের সময় বিভিন্ন ট্যাগিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার কৌশলে যারা হেঁটেছেন তারা পরাজিত হয়েছেন। ‘ডাকসু নির্বাচন শেখ হাসিনার নির্বাচনকেও হার মানিয়েছে; ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানের এ বক্তব্য এবং ঢাবি ছাত্রদল সভাপতির ভিসির সাথে আচরণ পরিত্যক্ত ছাত্রলীগের রাজনীতির অসহিষ্ণু মনোভাবের প্রকাশ। নির্বাচনে হার-জিত আছেই। এটি মেনে নিয়েই নির্বাচনী রাজনীতি করতে হয়। এটিই গণতন্ত্রের শিক্ষা। ‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার’-এই বিশ্বাস ও চেতনায় গণতন্ত্র পথ চলতে পারে না, হোঁচট খায়। পরাজিত দল ও প্রার্থীরা যত দ্রুত এ বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারবেন, ততই মঙ্গল।

নির্বাচন চলাকালীন সময়ে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা যে নৈতিক পরাজয় তা নিশ্চয়ই ছাত্র নেতারা এবং তাদের উপরস্থিত নেতারা ভালো করেই বোঝেন। এতে মর্যাদা বাড়ে না, ক্ষুণ্ণ হয়। লড়াকু মনোভাব গণতান্ত্রিক পরিবেশের অলঙ্কার। ‘ফলাফল যাই হোক মাঠে থাকব শেষ পর্যন্ত’ এই মনোভাবের কারণে অলিম্পিক দৌড় প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া প্রতিযোগীও কিন্তু ট্র্যাক ছেড়ে যায় না। দৌড় শেষ করেই আসে। অপরদিকে, ফলাফলের তোয়াক্কা না করেই শিক্ষার্থীদের নির্বাচনে শিক্ষকদের প্রকাশ্য পক্ষাবলম্বন খুবই দৃষ্টিকটু। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কাউকে ছোট না করার অভিপ্রায়ে এ কথাটি বলতেই হয়- এতে শিক্ষার্থীরা নৈতিকভাবে মনোবল হারিয়ে ফেলে।

লাঠিয়াল বাহিনী, হেলমেট বাহিনী, কমনরুম কালচারে ডুবে যাওয়া ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে এ ধরনের পরিবর্তন আশা জাগাচ্ছে। কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা না ঘটায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ