ফেনী শহরের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফেনীতে ছিলাম। তখন শহীদ সেলিনা পারভীনের প্রতিবেশী ছিলাম।

(দ্বিতীয় কিস্তি)

আমাদের ছোটবেলায় ফেনী শহরকে বাজার বলা হতো। আমাদের বাসার কাছে ছিলেন হালিমার বাপ খলিল মিয়া। তিনি মুদি ব্যবসা করতেন। বলতেন ফেনী বাজারে গিয়েছিলেন। ফেনীর গুরুত্ব তখন ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া (জমাদ্দার হাট), দাগনভূঞা, জায়লস্কর, সিলোনিয়া, পরশুরাম, লেমুয়া প্রভৃতি বাজারের চেয়ে বেশি ছিল না। অথচ ফেনী মাদরাসায় আলিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই ১৯২৩ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন মওলানা ওবায়দুল ইসলামাবাদী। তিনি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার অধিবাসী ছিলেন। ১৯২৩-১৯৭১ সাল পর্যন্ত ফেনী মাদরাসার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তার এক ছেলে সাপ্তাহিক তালিম দেখাশোনা করতেন। ফেনী বাজারের নাম শহর হিসেবে পরিচিতি পায় ১৯৫২ সালে মিউনিসিপ্যালিটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে।

আমার মা মনিরুদ্দিন টিটিইর বাসার উল্লেখ করতেন। আমরা ওই বাসায় থাকতাম। পরে ওই বাসায় যান সিভিল সার্জন ডা: আবুল কাশেম চৌধুরী। তার এক ছেলে জিয়াউদ্দিন বাবলু ডাকসুর জিএস এবং উপপ্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন এরশাদ আমলে। তিনি জাসদ থেকে ডাকসুর জিএস হয়েছিলেন। ওই অবস্থাতে এরশাদের দলে যোগ দেন তিনি। পরে জাতীয় পার্টির মহাসচিবও ছিলেন। তার অপর ছেলে হাসান মাহমুদ চৌধুরী স্বপন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তার আরেক ছেলে ইফতেখার চৌধুরী শিপের অফিসার ছিলেন।

আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফেনীতে ছিলাম। তখন শহীদ সেলিনা পারভীনের প্রতিবেশী ছিলাম। ওই সময়ে উর্দুভাষী পোস্টমাস্টার ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী। পোস্টমাস্টারের ছেলে ছিলেন ল্যাড্ডন, নানু; মেয়ের নাম ছিল মুন্নি। তার বৃদ্ধ মাও তার সাথে থাকতেন। এ বৃদ্ধা উর্দু ভাষায় গান গেয়ে নাতি-নাতনীদের জাগাতেন। মায়ের মুখে শুনেছি- তিনি উর্দু ভাষায় গাইতেন- ‘চান্ডি চান্ডি হাওয়া আয়ি, সুরজ কোভি ছাতি লায়ি; মেরে পেয়ারে বাকে, উঠল আওর হাতমুখ ধোকে নাশতা করকে পাড়নে বেঠো’। এর অর্থ- ‘ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, সূর্য ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে; আমার প্রিয় বাচ্চারা, উঠো এবং হাতমুখ ধুয়ে নাশতা করে পড়তে বসো।’

সেলিনা পারভীন এবং আমার বড় বোন একসাথে পড়তেন। সেলিনা পারভীনের আসল নাম ছিল মনোয়ারা। তিনি মাসিক শিলালিপির সম্পাদক ছিলেন। তার নাম যে সেলিনা পারভীন, এটা অনেকে জানতেন না। তিনি স্বাধীনচেতা ছিলেন ছোটবেলা থেকে। একমাত্র মহিলা শহীদ হিসেবে পরিচিত তিনি। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তার স্মৃতিফলক আছে। এ প্রসঙ্গে দু’জন ব্যক্তির সাথে আব্বার পরিচয়ের উল্লেখ না করলে হয় না। একজন হচ্ছেন প্রাক্তন মন্ত্রী ও আইনজীবী রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী। তিনি শেরেবাংলার যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ছিলেন। তার সম্পর্কিত নাতি আমিনুল হায়দার চৌধুরী মালু দীর্ঘ দিন দৈনিক সংগ্রামে আমার সিনিয়র সহকর্মী ছিলেন। মালু ভাই দৈনিক সংগ্রামের স্পোর্টস রিপোর্টার ছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি ইন্তেকাল করেছেন।

ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিত মুখ মালু ভাই। অকৃতদার মানুষটি ছিলেন দৈনিক সংগ্রামের জন্য উদারপ্রাণ। ব্যাংকের দায়িত্বশীল চাকরি সত্তে¡ও তিনি কোনো দিন মাঠের খবর মিস করতেন না। আব্বার আরেকজন পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন পরবর্তীকালের প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী। তিনি নোয়াখালী জেলার নুরসোনাপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তার পিতা ছিলেন খান বাহাদুর গাজী চৌধুরী (চৌধুরী মিয়া মোক্তার)। তিনি রানী এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গিয়েছিলেন। ইংরেজিতে ভ্রমণকাহিনী বই হিসেবে লিখেছিলেন। তার অন্য ছেলের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন সাবেক পরিবেশ সচিব মরহুম জাফর আহমেদ চৌধুরী।

মায়ের মুখে শুনেছি- দাউদপুরে মনু সওদাগরের বাড়িতে আমরা ছিলাম। ঠিক তেমনি তিনি বলতেন, আমার আব্বা মরহুম শামসুল করীম গুরুতর অসুস্থ হলে তার পরিবর্তে শহীদ সেলিনা পারভীনের পিতা মরহুম আবিদুর রহমান গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেলিনা পারভীনরা রামগঞ্জ থেকে এসে ফেনীতে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তারা সব বোন উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। তার এক ভাই মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচিত কমিশনার ছিলেন। সেলিনা পারভীনের পিতা বৃদ্ধ বয়সে ইন্তেকাল করেন। আমরা তাকে খুব বৃদ্ধ দেখেছি। আম্মার কাছে আরো শুনেছি, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বাংকারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শহীদ সুফি সদরুদ্দিনও ছিলেন সেখানে। তিনি মাথা বের করতেই বিমান হামলায় শহীদ হন। তাকে ফেনীতে দাফন করা হয়েছিল; শহর থেকে ছয় মাইল পশ্চিমে গজারিয়া গ্রামে।

ফেনী কলেজ ঘিরে ফেনীর ছাত্ররাজনীতি আবর্তিত হতো। এই ছাত্ররা শেরেবাংলাকে অপমান করেছিলেন মুসলিম লীগের হয়ে। শেরেবাংলা আর কোথাও বিরূপ সংবর্ধনা পাননি। ১৯৫৪ সালে এই ছাত্ররা ওবায়দুল্লাহ মজুমদারের (পটিয়া কলেজের অধ্যক্ষ, ফেনীর পরশুরাম-ছাগলনাইয়ার এমপি) নেতৃত্বে সংগ্রাম করেছিলেন ইউএসএস (ইউনাইটেড স্টুডেন্টস সোসাইটি) নামে। বিপরীতে ছিল ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ পার্টি বা ইউপিপি। ১৯৫৪ সালে কলেজের তরুণ অধ্যাপক ওবায়দুল্লাহ মজুমদারের নেতৃত্বে সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন মোতাহারুল করীম, চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক। জয়নাল হাজারীও তখন এ দলে ছিলেন। ফেনী কলেজের প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ শফিউল্লাহ এ দলের অন্যতম নেতা ছিলেন। তিনি পরে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। তিনি রামপুরের সৈয়দ শফিউল্লাহ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। চন্দনা হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন।