বস্তিবাসীদের অবজ্ঞা একটি সামাজিক সমস্যা

আমরা যদিও দাবি করছি, সহস্র্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অতিক্রম করে আমরা অচিরে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব; কিন্তু একটি সমাজ ও শহরের অপরিচ্ছেদ্য অংশ বস্তিবাসীর সমস্যার নিরসন না করে সে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো কতটুকু সম্ভব তা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।

উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে বস্তি রয়েছে। বস্তিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে বাঁশের বেড়া, টিন, পলিথিন, কার্টন শিট, চটের বস্তা, বিভিন্ন পুরনো ব্যানার, ফেস্টুন প্রভৃতি দিয়ে খুপরি তুলে মানবেতরভাবে জীবনযাপনের আশ্রয়স্থল গড়ে তোলা হয়। বস্তিতে সাধারণত সমাজের খেটেখাওয়া নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর বাস। এদের মধ্যে রয়েছে- ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে রিকশাচালকদের এক বিপুল অংশ, বিভিন্ন বাসাবাড়িতে খণ্ডকালীন কর্মে নিয়োজিত গৃহকর্মী, পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন কল-কারখানায় কর্মরত স্বল্প বেতনভুক্ত নারী-পুরুষ ও শিশুশ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বাজারে মুটের কাজে নিয়োজিত শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মেহনতি মানুষ।

ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকারি খাসজমি অথবা রাস্তার পাশের ফুটপাথে, রেললাইনের ধারে, বেড়িবাঁধের দু’ধারে ও লেকের পাশে খালি জায়গায় বস্তি গড়ে ওঠে। প্রতিটি বস্তির ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাজনৈতিকভাবে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থেকে বস্তি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই সাথে বস্তি থেকে ভাড়া বাবদ যে অর্থ আদায় করা হয় তাতে দেখা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালী ছাড়াও আয়ের একটি অংশ সরকারের যে বিভাগের ভূমির ওপর বস্তি গড়ে উঠেছে, সে বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় পুলিশের কিছু সদস্যের পকেটে যায়।

বস্তিতে আধুনিক নাগরিকসুবিধা বলতে কিছু নেই। এখানে রয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট। কিছু বস্তিতে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ থাকলেও অধিকাংশে রাতে হারিকেন বা কুপি বাতি প্রজ্বলিত হতে দেখা যায়। বস্তিতে নেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার ব্যবস্থা এবং নারী-পুরুষ নির্বিভেদে সবাইকে রাতের বেলায় সংগোপনে কাজটি সারতে হয়। দু-একটি বস্তিতে অস্থায়ী টয়লেট-ব্যবস্থা থাকলেও তাতে দেখা যায়, মল-মূত্রের উৎকট গন্ধকে নিত্যসঙ্গী করে জীবনযাপন করছে বস্তিবাসী।

বস্তিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর এক বিপুল অংশ দিন আনে দিনে খায়। এরা এক দিন কাজ না করলে সে দিন অভুক্ত থাকতে হয়। অসুস্থ হয়ে কাজ না করতে পারলে পথ্য জোটানো দূরের কথা, অনেকটা অভুক্ত থেকে রোগবালাইয়ের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। বস্তিতে বসবাসরত শিশুরা সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আমাদের দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও বস্তিবাসী শিশুরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত।

বস্তিবাসীরা নিজেদের খুপরি ঘরের সন্নিকটে অস্থায়ী চুলায় কাঠ, খড়, কাগজ প্রভৃতি কুড়িয়ে এনে এগুলোকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে তাদের রান্নার কাজ সমাধা করে থাকে। বস্তিবাসীর রান্না, ধোয়ামোছা ও খাবার পানি অনেক দূর থেকে, ক্ষেত্রবিশেষে টাকার বিনিময়ে এবং ক্ষেত্রবিশেষে টাকা ছাড়া সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে হয়। তাদের অনেকের ভাগ্যে প্রতিদিন গোসল করার সুযোগ ঘটে না। এমন অনেক বস্তিবাসীর কথা শোনা যায়, সপ্তাহে একবার গোসল করে দিনাতিপাত করছে। এদের গোসলের ক্ষেত্রেও দেখা যায় পর্যাপ্ত পানির অভাবে স্বল্প পানি দিয়ে গোসল করছে। এতে করে গোসলের মাধ্যমে যে পূত-পবিত্র হওয়ার বাসনা জেগে ওঠে, সেটি অপূর্ণ থেকে যায়।

মশা, মাছি, তেলাপোকা, ইঁদুর, পোকামাকড় প্রভৃতি বস্তিবাসীর নিত্যসঙ্গী এবং এসবের উপদ্রবে তারা অহরহ বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গের সম্মুখীন হন।

বর্তমানে ঢাকা শহরে বিভিন্ন বস্তি ঘিরে গড়ে উঠেছে হেরোইন, ফেন্সিডিল, মদ, ইয়াবাসহ বিভিন্ন জীবননাশী মাদকের কারবার। এসব কারবার দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। তাই স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জেনেও না জানা এবং দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। তা ছাড়া বস্তিতে বসবাসরত কিছু উঠতি বয়সী তরুণীর পতিতাবৃত্তির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়তে দেখা যায়। এর পেছনেও রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের অনৈতিক সমর্থন। মাদক ও পতিতাবৃত্তি- উভয় সমাজের যুবশ্রেণীকে বিপথগামী করলেও কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী ও তাদের সহযোগী সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবৈধ প্রাপ্তি বস্তিবাসীসহ সমাজের অনেককে মাদাকাসক্তি এবং অনৈতিক কাজে লিপ্ত হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে করে বস্তিবাসীর অনেকে নৈতিকতা ও মানবতা-বিবর্জিত হয়ে পড়ে। সমাজের অনেক অপরাধীকে দেখা যায়, পুলিশের অভিযানে ধাওয়া খেয়ে বস্তিতে গিয়ে আশ্রয় নিতে। এদের সংস্পর্শে বস্তিবাসীদের অনেকে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।

বস্তিতে বসবাসরতদের বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাদের অনেকে জুয়ার নেশায় এমনভাবে মত্ত হয়ে যায় যে, তার দ্বারা আর কোনো ধরনের স্বাভাবিক কাজ করা সম্ভব হয় না। বস্তিতে বসবাসরত উঠতি বয়সী ও মাঝ বয়সীদের কাছে অশ্লীল নীল ছবি বিনোদনের একটি প্রধান আকর্ষণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব অশ্লীল নীল ছবি দেখার পর বস্তিবাসী উঠতি বয়সী ও মাঝ বয়সীদের মধ্যে তীব্র যৌন আকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়। সেই সাথে তা চরিতার্থে তাদের কাছে নৈতিকতা ও বিবেকবোধ সুপ্ত হয়ে পড়ে।

বস্তির অনুরূপ হকার মার্কেট সরকারি খাস জমি ও রাস্তার দু’ধারের ফুটপাথে গড়ে ওঠে। মূলত এসব হকার মার্কেট ও ফুটপাথে যেসব সামগ্রী বিক্রি হয় তার এক বিরাট অংশ বস্তিবাসীর চাহিদার জোগান দেয়।

ঢাকা শহরে প্রায়ই দেখা যায়, খাস জমিতে গড়ে ওঠা বস্তি ও হকার মার্কেটে আগুন লেগে বস্তি ও হকার মার্কেট সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়ে পড়ছে। আগুন লাগার পর যদিও বস্তিবাসী এবং হকারদের তাৎক্ষণিক খাদ্য ও বস্ত্রের চাহিদা মেটানোর জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠন এগিয়ে আসে; কিন্তু সপ্তাহ বা পক্ষকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর দেখা যায়, বস্তি ও হকার মার্কেট যাদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল; তাদের সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। অনুসন্ধানে জানা যায়, এযাবৎকাল পর্যন্ত যেসব বস্তি ও হকার মার্কেটে আগুন লেগে বস্তিবাসী ও হকাররা সর্বস্বান্ত হয়েছেন, তার অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে বস্তি ও হকার মার্কেট নির্মিত হয়েছে; বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে। আগুন লাগানোর নেপথ্যে কারা, এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি হলেও প্রকৃত সত্য কখনো উদঘাটিত হয় না। বস্তি বা হকার মার্কেটের ওপর বহুতল ভবনের নির্মাতার ক্ষমতার দাপটের কাছে দেখা যায়, প্রশাসন, পুলিশ, আদালত- সব যেন নির্বিকার। কী করে সরকারি খাস জমির মালিকানা প্রভাবশালী বহুতল ভবন নির্মাতার হয়ে গেল, তার চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের জাল এত গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত যে, দেশের আইন নিয়ম-নীতি সবকিছু তাদের কাছে অসহায়।

বস্তিতে যারা বসবাস করছে শহরের নাগরিক জীবন সচল রাখতে তাদের প্রয়োজন রয়েছে। তাদের সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। আমরা সমাধান না করলে প্রাকৃতিকভাবে সমাধান হবে। ভূমিকম্প বা অনুরূপ বিধ্বংসকারী বিপর্যয়ে দেখা যাবে, দুর্যোগ মোকাবেলা করে তারা বেঁচে আছেন। দীর্ঘ বঞ্চনার অন্তর্জ্বালায় দগ্ধ এসব বস্তিবাসী যদি লুটপাটে নেমে পড়ে, তখন তাদের থামাবে কে?

কথাটি সবাই স্বীকার করবেন, বস্তিবাসী এক দিন কাজ বন্ধ রাখলে নাগরিক জীবন অচল হয়ে পড়বে, রাস্তাঘাট দেখা যাবে ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ, নর্দমা দিয়ে দুর্গন্ধয্ক্তু পানি উপচে পড়ছে। শহরের সর্বত্র বর্জ্য যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে। বস্তিবাসীকে অবজ্ঞা সামাজিক সমস্যা। সমাজের মূল স্র্রোতধারার মানুষের সাথে একই আকাশের নিচে বসবাসরত বস্তিবাসীর সমস্যার সমাধান ব্যতিরেকে নাগরিক জীবনে স্বস্তি আশা করা যায় না।

জনসংখ্যা বাংলাদেশের মূল সমস্যাগুলোর অন্যতম। সমাজের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিম্নবিত্তদের প্রায় শতভাগ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমের আওতায় এলেও বস্তিতে বসবাসরত প্রান্তিক নিম্নবিত্ত শুধু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়, তাদের মধ্যে রয়েছে বাল্যবিয়ে ও একাধিক বিয়ের প্রবণতা। তাই বস্তিতে এসে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বলতে গেলে থমকে গেছে। আর বস্তিতে বসবাসরতদের ক্ষেত্রে যদি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অপূর্ণ থেকে যায়, তাহলে দেখা যাবে- বস্তিবাসীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্টের দিকে চলে যাচ্ছে।

জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার সনদ-১৯৪৮ অনুযায়ী, পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে পাঁচটি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা হলো- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। এ পাঁচটি মৌলিক অধিকার আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের বস্তিবাসীরা এ পাঁচটির প্রতিটির সুফল সম্পূর্ণরূপে ভোগ থেকে বঞ্চিত।

আমরা যদিও দাবি করছি, সহস্র্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অতিক্রম করে আমরা অচিরে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব; কিন্তু একটি সমাজ ও শহরের অপরিচ্ছেদ্য অংশ বস্তিবাসীর সমস্যার নিরসন না করে সে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো কতটুকু সম্ভব তা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। আমাদের সবার উন্নয়ন বিফল হবে যদি সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন না করে বিষয়টি এড়িয়ে চলি। তাই বস্তিবাসীর হাহাকার শুনে কাক্সিক্ষত ব্যবস্থা নেয়া গেলে আশা করা যায় দেশ, জাতি ও সমাজের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে না। এ দাবির প্রতিপালনে সর্বাগ্রে দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত রাজনীতিকদের উদ্যোগী হতে হবে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতিবিশ্লেষক