জাতীয় ঐক্য ও নির্বাচন প্রস্তুতি

আজকের নেতৃত্বের কাছে জাতি এই প্রশ্নের উত্তর প্রত্যাশা করে। কারণ জনগণের আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য নয়, এটি ছিল নৈতিক ও আদর্শিক পুনর্জাগরণের এক আহ্বান।

বর্তমান সময়ে জাতীয় ঐক্যই বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির প্রধান শর্ত। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও নানামুখী ষড়যন্ত্রের এই সংবেদনশীল প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐক্য এখন কেবল একটি রাজনৈতিক আদর্শ নয়, এটি জাতির অস্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাই বিপ্লবের পর দেশজুড়ে যে ঐক্যের চেতনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা জনগণের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আশার প্রতিফলন ছিল। আশা ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, সুশাসিত ও স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। কিন্তু এই চেতনা ক্রমে ম্লান হয়ে গেলে সেই বিপ্লবের অর্থই হারিয়ে যাবে। ঐক্য কেবল রাজনৈতিক জোটের সমীকরণ নয়; এটি নৈতিক শক্তি, জাতীয় আত্মবিশ্বাসের প্রতীক, যা জাতিকে নতুন পথে এগিয়ে নিতে পারে। তাই এই ঐক্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।

জাতীয় ঐক্য টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিজেদের ভেতরে শুদ্ধি ও সংস্কার আনতে হবে। যে দল নিজের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারে না, দুর্নীতি ও ভোগবিলাসে নিমজ্জিত কিংবা ব্যক্তিপূজা ও স্বজনপ্রীতির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তারা কখনোই জাতীয় নেতৃত্ব দিতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে, জনগণ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন ও বিচক্ষণ। তারা কথায় নয়, কাজে নেতৃত্বের মান যাচাই করে। তাই প্রতিটি দলের প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন- যেখানে নীতি, সততা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। পুরনো, ক্লান্ত, আত্মস্বার্থে নিমগ্ন নেতৃত্বকে সম্মানের সাথে অবসরে যেতে হবে, যাতে নতুন প্রজন্মের সৎ, মেধাবী ও দেশপ্রেমিক নেতারা সামনে আসতে পারে। তরুণদের নেতৃত্বে আনার মাধ্যমে রাজনীতিতে নতুন চিন্তা, নতুন মূল্যবোধ ও জনগণের প্রতি জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এই প্রজন্মান্তরের পরিবর্তন কেবল ক্ষমতার হস্তান্তর নয়, এটি রাজনৈতিক পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এখন অত্যন্ত জরুরি।

আমরা মনে করি, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফল অবশ্যই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে একটি প্রভাব ফেলবে। এবারের নির্বাচনের সমীকরণ খুব একটা সহজ হবে না। কাজেই দলগুলো সত্য ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চোখ বুঁজে না থেকে নিজ নিজ দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কার করবে এটাই কাম্য।

একই সাথে আসন্ন নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সততা ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়া জরুরি। রাজনীতিতে অপরাধী, দুর্নীতিবাজ ও অশিক্ষিত ব্যক্তিদের প্রার্থী করা মানে জনগণের সাথে প্রতারণা করা। জনগণ আজ এমন নেতৃত্ব চায় যারা নৈতিকভাবে দৃঢ়, বুদ্ধিমত্তায় পরিপক্ব ও দেশের প্রতি অনুরাগী। দলগুলোকে তাই প্রার্থী মনোনয়নের আগে তাদের ব্যক্তিজীবন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক আচরণ এবং দুর্নীতি বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার ইতিহাস খতিয়ে দেখতে হবে। নৈতিক ও যোগ্য নেতৃত্বই রাষ্ট্রকে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির জাল থেকে মুক্ত করতে পারে। রাজনীতির নোংরামি দূর করতে হলে এর সূচনা করতে হবে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া থেকেই। এটি শুধু একটি নির্বাচনী কৌশল নয়, এটি জাতির আত্মসম্মান ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বর্তমানে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। সরকার উন্নতির দাবি করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। মাঠপর্যায়ে এখনো অনেক অপরাধীচক্র সক্রিয়, চাঁদাবাজি, মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের কারবার অব্যাহত রয়েছে। এর পেছনে স্থানীয় রাজনীতি, প্রশাসনিক শিথিলতা এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা কাজ করছে। তাই আমাদের প্রস্তাব হলো, একটি বিশেষ জাতীয় অভিযানের মাধ্যমে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে, অপরাধী ও তাদের মদদদাতাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। নির্বাচন সামনে রেখে এই পদক্ষেপ জরুরি, কারণ অস্ত্রধারী অপরাধী ও দুষ্কৃতকারীরা নির্বাচনী সহিংসতা উসকে দিতে পারে। জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই রাষ্ট্রের উচিত নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া।

একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রশাসনিক সংস্কারও অপরিহার্য। স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বহুবার নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করেছে। তাই জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মাঠপর্যায়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ব্যাপক পুনর্বিন্যাস এখন সময়ের দাবি। তাদের মধ্যে যারা পূর্ববর্তী সরকারের সময় বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছেন অথবা যাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে, তাদের পরিবর্তন করতে হবে। প্রশাসনের এই শুদ্ধি অভিযান না হলে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ অর্জন সম্ভব হবে না। জনগণ তখনই নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহী হবে, যখন তারা বিশ্বাস করবে যে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন সত্যিই নিরপেক্ষ।

আমরা বিশেষভাবে সতর্কতা উচ্চারণ করতে চাই দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে। নির্বাচনের সময় বা রাজনৈতিক পরিবর্তনের মুহূর্তগুলোতে নানা শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট, দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত করা। চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল বিশেষভাবে সংবেদনশীল। অতীতে যেভাবে এই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো বিদেশী প্রভাবের আশ্রয়ে নাশকতা চালিয়েছিল, তেমনি এখনো সেই ঝুঁকি থেকে আমরা মুক্ত নই। পাশাপাশি ধর্মীয় ইস্যু ব্যবহার করে দেশে বিভাজন ও সঙ্ঘাত সৃষ্টির চেষ্টা বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, বিশেষ করে ইসকনের উসকানিমূলক কার্যকলাপ এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং একটি সংগঠিত পরিকল্পনার অংশ, যেখানে ধর্মীয় উত্তেজনা, শিল্পকারখানায় অগ্নিসন্ত্রাস এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা একই সূত্রে গাঁথা। উদ্দেশ্য একটাই, জনগণকে আতঙ্কিত করা, অর্থনীতি দুর্বল করা এবং দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করা।

এই প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি, এখন থেকেই জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ও তৎপরতা দৃশ্যমান হতে হবে, যাতে শত্রুরা জানে বাংলাদেশ প্রস্তুত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও বিভ্রান্তি রোধে বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন করা উচিত। ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশপ্রেমিক শক্তিগুলোকে এখন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কারণ ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি পুরো জাতির দায়িত্ব।

আমাদের হাতে এখনো তিন থেকে চার মাস সময় আছে। এটি আত্মতুষ্টির সময় নয়; বরং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়। একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে, যাতে নির্বাচনকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসন, অর্থনীতি ও কূটনৈতিক স্থিতি বজায় থাকে। সরকারকে বুঝতে হবে, জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারই তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জনগণের আস্থা অর্জন মানে কেবল ভোট পাওয়া নয়, এটি রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া।

জুলাই বিপ্লবের পর জাতির মধ্যে যে ঐক্য, সাহস ও আশার সঞ্চার হয়েছিল, তা যেন ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু না হয়। সেই ঐক্য রক্ষা করাই আজ আমাদের জাতীয় কর্তব্য। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ ও ক্ষমতার লোভের ঊর্ধ্বে উঠে সত্যিকারের জাতীয় দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করে, তাহলে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে। ইতিহাস আমাদের সামনে সুযোগ এনে দিয়েছে, এখন সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে। আমরা কি ঐক্যবদ্ধভাবে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ব, নাকি আবারো বিভেদ, ষড়যন্ত্র ও অরাজকতার অন্ধকারে ফিরে যাব?

আজকের নেতৃত্বের কাছে জাতি এই প্রশ্নের উত্তর প্রত্যাশা করে। কারণ জনগণের আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য নয়, এটি ছিল নৈতিক ও আদর্শিক পুনর্জাগরণের এক আহ্বান। সেই আহ্বানের মর্যাদা রক্ষা করতে হলে এখনই আমাদের ঐক্যবদ্ধ, সতর্ক ও সৎ হতে হবে। আগামী কয়েক মাসই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে- স্থিতিশীল অগ্রগতির পথে, নাকি বিশৃঙ্খলা ও বিভেদের গভীর গহ্বরে। সিদ্ধান্ত আমাদেরই; কিন্তু ইতিহাস আমাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই বিচার করবে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক