২০১৬ সালের ৯ আগস্ট সন্ধ্যায় ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেমকে (বন্ধু ও পরিবারের কাছে যিনি ‘আরমান’ নামে পরিচিত) মিরপুর ডিওএইচএসে তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে তুলে নেয়া হয়। এরপর যা ঘটেছিল, তা কোনো সাধারণ গ্রেফতার ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত একটি গুমের শিকার হয়ে প্রায় আট বছর ধরে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরের দিন, দেশজুড়ে ছাত্র ও জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেমকে মুক্তি দেয়া হয়, যার মাধ্যমে তার দীর্ঘ আট বছরের দুর্দশার অবসান ঘটে।
অপহরণের সময় ব্যারিস্টার মীর আহমদ ছিলেন একজন তরুণ আইনজীবী, যিনি দ্য ল’ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যুদ্ধাপরাধের বিচার ও আপিল প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের পক্ষে সক্রিয়ভাবে আইনি সহায়তা প্রদান করছিল। এই নেতাদের মধ্যে একজন ছিলেন তার পিতা, জামায়াতের বিশিষ্ট নেতা মীর কাসেম আলী। তার পিতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের এক মাসেরও কম সময় আগে, যখন তিনি পিতার পক্ষে সক্রিয়ভাবে আইনি সহায়তা দিচ্ছিলেন, তেমনি এক সময়ে ব্যারিস্টার মীর আহমদকে এভাবে তুলে নেয়া হয়। এ নিবন্ধে ব্যারিস্টার মীর আহমদের গুমের পূর্ববর্তী ঘটনাবলি, যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি সংঘটিত হয় এবং দীর্ঘদিন বিচারবহিভর্ূত আটক থাকার পর তার জন্য সম্ভাব্য আইনগত প্রতিকারগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
আমি এখনো স্পষ্টভাবে সেই দিনটি মনে করতে পারি, যে দিন ব্যারিস্টার মীর আহমদকে তুলে নেয়া হয়। সে দিন উদ্বিগ্ন ও অস্থির চিত্তে তিনি চেম্বারে ঢুকেছিলেন, আমাদের বলছিলেন, তার ওপর নজরদারি চলছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ইতোমধ্যে তার মিরপুর ডিওএইচএসের বাসায় গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হতে চেয়েছে, তিনি সেখানে থাকেন কি না। আমি তাকে বলেছিলাম, চেনা জায়গা এড়িয়ে চলতে এবং বাড়ি থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু পুলিশের ঘনিষ্ঠ এক সূত্র তাকে লুকিয়ে না থাকার পরামর্শ দেয়। তাদের মতে, লুকিয়ে থাকলে র্যাব আরো অস্থির হয়ে পড়বে। যদি তারা জানে তাকে কোথায় পাওয়া যাবে, তাহলে বরং ‘শান্ত থাকবে’। সে দিনের পরবর্তী সময়ে, র্যাব তার বাসায় হানা দেয় এবং তার স্ত্রী ও ছোট সন্তানদের সামনে থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে টার্গেটকৃত মক্কেলদের পক্ষে লড়াই করা এক তরুণ আইনজীবী নিখোঁজ হয়ে গেলেন, আর অস্বীকারের নিপুণ কৌশলে রাষ্ট্রযন্ত্র নিঃশব্দে সক্রিয় হয়ে উঠল। প্রায় আট বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার, তাদের নিরাপত্তাবাহিনী, এমনকি তৎকালীন প্রধান বিচারপতিও এমন এক কল্পিত বাস্তবতা রচনা করে রেখেছিলেন, যেন কিছুই ঘটেনি।
র্যাব তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় ব্যারিস্টার মীর আহমদ জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের সাথে আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। এটি ছিল তার পিতা মীর কাসেম আলীর শেষ আইনি আশার ভেলা। অপহরণের পরদিন, খন্দকার মাহবুব আদালতে দাঁড়িয়ে শুনানি স্থগিত রাখার আবেদন জানান, তিনি এই বলে ব্যাখ্যা প্রদান করেন, তার জুনিয়র আইনজীবীকে অপহরণ করা হয়েছে। এ ব্যাখ্যার প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার মন্তব্য ছিল অবজ্ঞাপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, ব্যারিস্টার মীর আহমদ ‘লুকিয়ে আছেন’। সেই অবহেলাজনিত মন্তব্য, যা পরে রাষ্ট্রের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, একসময় রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার অংশে পরিণত হয়, যার ছায়ায় হারিয়ে যান মীর আহমদ। ব্যারিস্টার মীর আহমদকে ছাড়া ২০১৬ সালের ২৪ ও ২৮ আগস্ট রিভিউ শুনানি এগিয়ে চলে। খন্দকার মাহবুবের তার সহকারীকে ছাড়া একাই মামলা লড়তে হয়। ৩০ আগস্ট, আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। তিন দিন পর, ২ সেপ্টেম্বর মীর কাসেম আলীকে ফাঁসি দেয়া হয়। এমনকি ব্যারিস্টার মীর আহমদকে জানানোও হয়নি যে তার পিতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
পরবর্তী বছরগুলোতে পরিবারটির জন্য প্রতিটি সাধারণ পারিবারিক বিষয়াবলিও এক-একটি দুর্বিষহ পরীক্ষায় পরিণত হয়। পিতা নিখোঁজ থাকায় সন্তানদের স্কুলে ভর্তি ও নথিপত্রের বিষয়ে আইনি জটিলতায় পড়তে হয়। এ সমস্যার সমাধানে ব্যারিস্টার মীর আহমদের স্ত্রীকে সন্তানদের আইনি অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় আদালতে আবেদন করতে হয়। কিন্তু এমন একটি সাধারণ আবেদনও বাধার মুখে পড়ে। বিচারক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া বারবার শুনানি পিছিয়ে দেন। দীর্ঘসূত্রতা, অযথা বিলম্ব এবং প্রশাসনিক জটিলতার পর অবশেষে আদালত তাকে অভিভাবকত্বের আদেশ দেন, যা তার সন্তানের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।
একপর্যায়ে, আমরা হাইকোর্ট বিভাগে হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন দাখিল করবার কথা ভেবেছিলাম, যাতে কর্তৃপক্ষ বারিস্টার মীর আহমদকে আদালতে হাজির করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তার জীবনের নিরাপত্তার আশঙ্কায় এ পরিকল্পনা বাদ দিতে বাধ্য হই। এ ভয় অমূলক ছিল না। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে আদালতের দারস্থ হওয়া পরিবারগুলোর চরম মূল্য দিতে হয়েছে। একটি আলোচিত ঘটনায়, অ্যাডভোকেট মো: তাজুল ইসলাম হেবিয়াস কর্পাস আবেদন দাখিল করার পর র্যাবের প্রতিশোধমূলক হামলার শিকার হয়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। তদুপরি, বিচারব্যবস্থাও কোনো আশার আলো দেখাতে পারেনি। আদালতগুলো সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত ছিল এবং তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুব আলম ছিলেন সরকারের অন্যতম আগ্রাসী রক্ষাকর্তা। আওয়ামী লীগকে জবাবদিহির হাত থেকে রক্ষা করতে মিথ্যা বক্তব্য দিতে তার জুরি মেলা ভার ছিল। মীর আহমদের মতো গুম এবং পরবর্তী বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ড সম্ভব হয়েছিল কেবল তখনকার সুপ্রিম কোর্টের নীরব সম্মতির কারণে। ২০২১ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্র র্যাব এবং এর সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তার আগ পর্যন্ত এ গুম ও হত্যার অভিযানের গতি কমেনি।
বারিস্টার মীর আহমদের সিনিয়র, বারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের অবিরাম চেষ্টার পর বিষয়টি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের নজরে আসে। দূতাবাসের কর্মকর্তারা বিষয়টি সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের কাছে উত্থাপন করেন। সরকার গোপনে আমেরিকানদের কাছে স্বীকার করে, মীর আহমদ তাদের হেফাজতে রয়েছে। এ স্বীকারোক্তির কথা বারিস্টার রাজ্জাককে জানানো হয়। মার্কিন কর্মকর্তারা তাকে বলেছিলেন, যেহেতু সরকার এক বিদেশী সরকারের কাছে তার আটক থাকার কথা স্বীকার করেছে, তাই তাকে হত্যার আশঙ্কা এখন কম। এ আশ্বাস ২০২৪ সালে তার মুক্তি পর্যন্ত আমাদের আশ্বস্ত করে রাখে।
ব্যারিস্টার মীর আহমদ অবশেষে মুক্ত, এখন বাংলাদেশ সরকারের সামনে একটি স্পষ্ট আইনি বাধ্যবাধকতা দাঁড়িয়ে আছে : তাকে আট বছর ধরে জোরপূর্বক গুম করে রাখার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বাংলাদেশ ‘জোরপূর্বক গুমের সব ব্যক্তির সুরক্ষার আন্তর্জাতিক কনভেনশন’ (ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিজ-অ্যাপেয়ারেন্স)-এর একটি সদস্যরাষ্ট্র। এই কনভেনশনের ধারা ২৪ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে গুমের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের ক্ষয়ক্ষতির জন্য ‘পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ’ দেয়া।
এই কনভেনশন স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেয়, এমন ক্ষতিপূরণে বস্তুগত ও নৈতিক উভয় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বস্তুগত ক্ষতি বলতে বোঝায় সরাসরি আর্থিক ক্ষতি। এ ক্ষেত্রে, ব্যারিস্টার মীর আহমদ সুপ্রিম কোর্টের একজন কর্মরত আইনজীবী হিসেবে সেই আট বছরে যে আয় করতে পারতেন, তা ছাড়াও তার পরিবারের ওপর চাপিয়ে দেয়া অর্থনৈতিক দুর্ভোগও এর আওতায় পড়ে। নৈতিক ক্ষতি বলতে বোঝায় অবৈষয়িক ক্ষতি, যেমন- যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আটক থাকা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং আইনগত সহায়তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে যে গভীর মানসিক যন্ত্রণা, হৃদয়বিদারক কষ্ট ও মনস্তাত্তি¡ক আঘাত ব্যারিস্টার মীর আহমদকে সহ্য করতে হয়েছে, তার কোনো আর্থিক হিসাব করা যায় না। এ যন্ত্রণা ছিল নিঃসঙ্গতার বিষাক্ত দীর্ঘশ্বাস, অনিশ্চয়তার অন্ধকার এবং ন্যায়বিচার থেকে ছিটকে পড়ার এক নির্মম অভিজ্ঞতা। বাস্তবিক অর্থে, এর মানে হলো- সরকার এবং যেসব রাষ্ট্রীয় সংস্থা তার গুমের জন্য দায়ী, তাদের প্রতিটি বছর, যেটি তার ও তার পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা কেড়ে নিয়েছে এবং প্রতিটি মাস, যেটি তাকে অবৈধ আটক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্যে রেখেছে, তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এ দায়বদ্ধতা কোনো সদিচ্ছার বিষয় নয়। এটি আন্তর্জাতিক আইনের অধীন একটি বাধ্যতামূলক প্রতিশ্রুতি, আর এ প্রতিশ্রুতি পালন করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ তার স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘনকারী রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হবে।
এ কনভেনশন শুধু ক্ষতিপূরণ নয়; বরং জবরদস্তিমূলক গুমের শিকার ব্যক্তিদের পুনর্বাসনেরও দাবি করে। পুনর্বাসন বলতে বোঝায়- সরকারকে সক্রিয়ভাবে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ক্ষতিগ্রস্তরা যথাযথ চিকিৎসা ও মানসিক সহায়তা পেয়ে তাদের জীবন পুনর্গঠন করতে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন। ব্যারিস্টার মীর আহমদের ক্ষেত্রে এ ট্রমা শুধু তার একার ছিল না। তাকে অপহরণ করা হয়েছিল তার স্ত্রী ও দুই অতি অল্পবয়সী কন্যার সামনে থেকে। এ নির্মম ঘটনার মানসিক ক্ষত তাদের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে। তার বৃদ্ধা মা, যিনি বছরের পর বছর কাটিয়েছেন এক অনিশ্চয়তা ও যন্ত্রণার মধ্যে, জানতে পারেননি তার সন্তান জীবিত না মৃত, তিনিও এ পুনর্বাসনের অধিকারী।
সনদের বিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো- এসব ব্যক্তিকে উপযুক্ত চিকিৎসা ও মনস্তাত্তি¡ক সহায়তা দেয়া, যাতে তারা যে ক্ষতি ও যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, তা কিছুটা হলেও লাঘব হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এ অব্যাহত নিষ্ক্রিয়তা শুধু আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে না, এটি সেই অন্যায়কে আরো গভীর করে তোলে, যা ইতোমধ্যে সংঘটিত হয়েছে।
কোনো পরিমাণ অর্থ বা আনুষ্ঠানিক ক্ষমা ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেমের হারানো সময়ের প্রকৃত ক্ষতিপূরণ হতে পারে না। আটটি অপূরণীয় বছর তার জীবন থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে পিতার সান্নিধ্য ছাড়া তার ছোট ছোট কন্যা কিশোরী হয়ে উঠেছে। একজন প্রতিশ্রুতিশীল আইনজীবীর পেশাগত পথও এ আট বছরে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। নিয়তির কী পরিহাস- যে মীর আহমদ নিজে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার, তিনি বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন মানবাধিকারের আলো। নীরবতার আড়ালে হারিয়ে না গিয়ে, তিনি এখন গুমের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, সচেতনতা গড়ে তুলছেন এবং এখনো নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিদের জন্য ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি