দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মোমেন বলেছেন, সরকারের আট উপদেষ্টার ‘সীমাহীন দুর্নীতি’ অভিযোগের বিষয়টি পত্রিকায় আসার পর সেটিতে তাদের চোখ পড়েছে। তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস একেবারেই দুর্নীতির বিপক্ষে একজন মানুষ। এটি যদি তার উপদেষ্টা পরিষদের কেউ হন, সে ক্ষেত্রেও তিনি বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নন। সেই সাথে যোগ করেছেন, একটি বিষয় আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, আমরা যে অভিযোগ করব সেটি যেন সুনির্দিষ্ট হয়। আমরা যদি শুধু বলি, তিনি কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ অংশগুলো যদি আমরা প্রমাণ করতে না পারি শেষ পর্যন্ত সেই অভিযোগ কিন্তু টিকবে না। এমনকি উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধেও যদি অভিযোগ থাকে, সেটি যদি সুনির্দিষ্ট হয় আপনারা নিজেরাই নিয়ে আসুন না কেন, সাংবাদিকরা এ সমাজের দর্পণ। আপনারা থ্রো করবেন আমরা এগুবো। আপনারা লক্ষ রাখবেন, আমরা যেন আমাদের কাজটিও ঠিকমতো করি। ঠিকভাবে না করতে পারলে এর সমালোচনা করবেন।
আট উপদেষ্টার দুর্নীতির অভিযোগকারীও এ বিষয়ে পরে আর কিছু বলেননি। দুর্নীতির কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। অথচ বলার সময় বলেছিলেন খুব চড়া-কড়া গলায়। আড়ালে-আবডালে নয়। একদম প্রকাশ্যে অনুষ্ঠানের মঞ্চে। তাও যেনতেন অনুষ্ঠান নয়। যেনতেন জায়গাও নয়। বিষয়বস্তুও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, ভাবগম্ভীর। ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আগামী দিনের জনপ্রশাসন’-শীর্ষক সেমিনার। অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার সীমাহীন দুর্নীতির প্রমাণ নিজের কাছে রয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সচিব। অত্যন্ত ক্লিয়ার অ্যান্ড লাউডে কারো নাম উচ্চারণ না করে বলেছেন, এই আট উপদেষ্টার সাথে যোগাযোগ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয় না, বদলিও হয় না। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা বর্তমানে অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি।
‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আগামী দিনের জনপ্রশাসন’-শীর্ষক সেমিনারটি আয়োজন করে প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। সাড়ে তিন ঘণ্টার সেমিনারটিতে প্রশাসন ক্যাডারের শীর্ষ পদের প্রায় সব কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। বক্তৃতায় আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘আমলাদের চরিত্র না হয় খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের রক্তের ওপর দিয়ে চেয়ারে বসা অন্তত আটজন উপদেষ্টার সীমাহীন দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ দিতে পারব। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আট উপদেষ্টার দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।’ এ সময় উপস্থিত কর্মকর্তারা ‘ঠিক ঠিক’ বলে হাততালি দেন। জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ, শহীদ আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী, শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী ও শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তিও ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
সাবেক এই সচিব বলেন, কষ্ট লাগে একজন উপদেষ্টার এপিএসের অ্যাকাউন্টে ২০০ কোটি টাকা পাওয়া গেলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তিনি প্রশ্ন করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একটি মন্ত্রণালয় নূরজাহান বেগম চালাতে পারেন? স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মতো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় একজন অনভিজ্ঞ উপদেষ্টা যার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে একাধিক ব্যক্তিগত অভিযোগ রয়েছে, তাকে দিয়ে চালানো ঠিক হচ্ছে? ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত এক বছরে দুর্নীতি না কমে বরং বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, এক সহকারী কমিশনার (ভূমি) একটি স্কুলের জমির নামজারিতে ৩০ লাখ টাকা চেয়েছেন। ঢাকার আশপাশের একজন ইউএনও একটি কারখানার লে আউট পাস করতে ২০ লাখ টাকা চেয়েছেন। আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘আমি একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে বসি। গত বছর ৫ আগস্টের পর ওই অফিসে হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ভিড় করছেন। আমার বস তারেক রহমান ডেকে বললেন, ‘কী হচ্ছে? এরা কারা। তারা এখানে কী জন্য আসে।’ আমি বলেছি, এরা সবাই বঞ্চিত। এরা গত ১৫ বছর হাসিনার আমলে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। হাসিনার পতনের পর উচ্ছ¡াসে ছুটে এসেছেন ন্যায়বিচার পেতে। উনি বলেছেন, ‘দলীয় অফিসে ইনসার্ভিস কর্মকর্তারা আসা ভালো লক্ষণ নয়। আপনি তাদের অফিসে আসতে নিষেধ করে দেন।’ আমি অফিসের গেটে নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছি। ইনসার্ভিস কোনো কর্মকর্তা অফিসে আসতে পারবেন না। যদি কোনো সমস্যা থাকে অফিসার্স ক্লাবে আসবেন।’
এসব কথার সুবাদে আবদুস সাত্তার এখন বাম্পার। ব্যাপক ভাইরাল। তার বলা কথাগুলো ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। মূলধারার গণমাধ্যমে চলছে নানা বিশ্লেষণ। জমছে টেলিভিশনের টকশো। সাত্তার, তারেক রহমান, বিএনপি মিলিয়ে আলোচনা সুপার-ডুপার। আবদুস সাত্তারের ব্যাপক প্রশংসা চারদিকে। তিনি নিজে দাবি করেছেন এবং সহকর্মীরাও বলছেন, আবদুস সাত্তার ভীষণ দায়িত্বশীল মানুষ। তথ্য-উপাত্ত ছাড়া কথা বলা লোক নন তিনি। নিশ্চয়ই তার কাছে প্রমাণ রয়েছে। তার এই বক্তব্যকে বিবেচনায় নিয়ে সরকারের চিহ্নিত করা উচিত, ওই আট উপদেষ্টা কারা।
ঘটনার ধারাবাহিকতা বেশ ইন্টারেস্টিং। দ্রুত সময়ের মধ্যে আট উপদেষ্টাকে নিয়ে আবদুস সাত্তারের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়েছে, কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে তা ঠিক নয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে জানানো হয়, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এ বি এম আবদুস সাত্তার নাম উল্লেখ না করে কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। প্রমাণ উপস্থাপন বা ব্যক্তিদের শনাক্ত না করে ঢালাওভাবে অভিযোগ করা দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং জনআস্থার জন্য ক্ষতিকর।
আবদুস সাত্তারের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিবৃতিতে সরকার তার (সাবেক সচিব) কাছে সব প্রমাণ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে আহ্বান জানিয়েছে। আবদুস সাত্তার এখন পর্যন্ত কোথাও বা সরকারের কারো কাছে তার আনা অভিযোগের কোনো প্রমাণ দিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। সেখানে বাড়তি মাত্রা দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেই সাথে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সততার ওপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। গণমাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব দলের পক্ষে বলেন, এর সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা প্রধান উপদেষ্টাসহ এই অন্তর্বর্তী সরকারের সব উপদেষ্টাকে অত্যন্ত সম্মান করি এবং তাদের ওপর আস্থা রাখি, তাদের ইন্টিগ্রিটির ওপরও আমরা আস্থা রাখি। কয়েকটি পত্রিকায় সাবেক সচিব এ বি এম আবদুস সাত্তারের বরাত দিয়ে আট উপদেষ্টা নিয়ে বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই বলে উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। আরো বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, ওই বক্তব্যের দায় সম্পূর্ণভাবে ওনার নিজের। দলের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
থেমে থাকেনি বা দেরি করেনি সেদিনের সেমিনারের আয়োজক অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনও। আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের বক্তব্য জানিয়েছে তারা। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: নজরুল ইসলাম এবং মহাসচিব ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, ৮ আগস্ট ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আগামী দিনের জনপ্রশাসন’-শীর্ষক সেমিনারে উপদেষ্টাদের নিয়ে দু-একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদটি নেতিবাচক। দাবি করেন, সেমিনারের বিষয়বস্তু- সম্পর্কিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল। ওই বিজ্ঞপ্তির আলোকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও দু-একটি গণমাধ্যমে সেমিনারের মূল প্রবন্ধ ও বিষয়বস্তুর বাইরে উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য নয়। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, সেমিনার একটি অ্যাকাডেমিক বিষয়। এতে বিভিন্ন পর্যায়ের বিজ্ঞজনেরা দেশের জনপ্রশাসনের গতিপ্রকৃতি ও প্রত্যাশা নিয়ে তাদের নিজস্ব বক্তব্য দেন। অ্যাসোসিয়েশনের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন মনে করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। দৃশ্যমান সংস্কার কার্যক্রমসহ অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতীয় স্বার্থে এখন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তারের উচিত, যে আট উপদেষ্টা সীমাহীন দুর্নীতি করেছেন বলে তার কাছে প্রমাণ রয়েছে, সেসব উপদেষ্টার নাম অতিদ্রুত প্রকাশ করা। শুধু নাম নয়, কী দুর্নীতি করেছেন, তাও প্রমাণসহ স্পষ্ট করা উচিত। আর যদি অভিযোগ মিথ্যা হয়, সেই বিষয়টিও স্পষ্ট করা সময়ের দাবি। নাহলে অগ্রহণযোগ্য কথার অপরাধে তাকে আইনের আওতায়ও নেয়ার কথা বলছেন অনেকে।
যেহেতু পাবলিকলি একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা অভিযোগ তুলেছেন, সেহেতু এটি শুধু কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত হবে না। অভিযোগকারীর অবশ্যই উচিত সুনির্দিষ্ট তথ্য কি আছে সেটি সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে জানানো। মানুষেরও জানার অধিকার আছে। যেহেতু তিনি এখনো অভিযোগ প্রত্যাহার করেননি, সেহেতু এখন সরকার তদন্তের কোনো ব্যবস্থা নেয় কি না, সেদিকে অনেকের কৌতূহল রয়েছে। একই সাথে স্বাধীন সংস্থা হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনকেও এ বিষয়ে সক্রিয় হওয়া উচিত বলে অনেকে মনে করেন। তা না হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অভিযোগ গুরুত্ব হারাবে। তাতে দুর্নীতিবিরোধী চলমান পরিস্থিতি অতীতের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও দুর্নীতি দমন কমিশন নিজ থেকেই এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না তা নিয়ে সংস্থাটির কর্মকর্তারা এখনো কেউ কোনো মন্তব্য করতে শোনা যায়নি।
এখন সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল? কিছুই দাঁড়ায়নি। মাঝ দিয়ে কয়েক দিন নানা হাইপে, ভজঘটে সময় পার। গোটা বিষয়টি থেকে গেল নিষ্পত্তিহীন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট