সড়কে ঝরছে প্রাণ, রেলপথ হোক সমাধান

সড়কপথে দুর্ঘটনা, যানজট ও অতিরিক্ত নির্ভরতার যে দুষ্টচক্রে আমরা আটকে আছি, তার কার্যকর সমাধান হতে পারে শক্তিশালী ও আধুনিক রেলব্যবস্থা।

হেলাল উদ্দীন

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ৬,৯২৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, যাতে ৭,২৯৪ জন নিহত এবং ১২,০১৯ জন আহত হন। তবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুসারে নিহতের সংখ্যা আরো বেশি। তাদের হিসেবে ২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮,৫৪৩ জন নিহত হন। এতে নিহতের হার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৭ শতাংশ বেড়েছে। এই পরিসংখ্যানে প্রতিবারই উঠে আসে বাস, ট্রাক, তথা সড়কপথের যানবাহনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, রাস্তার দুর্বল অবকাঠামো ও নিরাপত্তাহীন পরিবহন ব্যবস্থার চিত্র। প্রশ্ন জাগে, যেখানে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে হাজারো মানুষ, সেখানে কেন আমরা এখনো আন্তঃশহর যোগাযোগে সড়কপথের বিকল্প হিসেবে দ্রুত, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ কোনো পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি? এ ক্ষেত্রে রেল কি হতে পারে না সড়কের একটি কার্যকর বিকল্প?

বাস বা সড়কপথের অন্যান্য যানবাহন সহজলভ্য বলে দীর্ঘদিন ধরে দেশের অনেক আন্তঃজেলা রুটে এটিই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে আছে। তবে এ যাত্রায় রয়েছে উচ্চ ঝুঁকি, অতিরিক্ত যানজট, ক্লান্ত বা অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনা এবং সময়ের অপচয়। এক দিকে যাত্রীসংখ্যা বাড়ছে, অন্য দিকে রাস্তাগুলো বিভিন্ন ধরনের অব্যবস্থাপনা ও নিয়ম না মানার প্রতিযোগিতার কারণে অনিরাপদ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার কিলোমিটারে মৃত্যুর হার প্রায় ৬৭ জন এবং মাত্র ২ শতাংশ সড়ক বর্তমানে ট্রাফিক-সেফটি মানদণ্ড ‘৩-স্টার বা তার বেশি’ রেটিং পেয়েছে। অর্থাৎ, আমাদের সড়ক অবকাঠামো এখনো উন্নত নিরাপত্তার অনেক নিচে।

সার্বিকভাবে বিচার করলে, সড়কপথের তুলনায় রেলপথে যোগাযোগের কিছু স্পষ্ট সুবিধা আছে। বিশেষ করে উন্নত রেললাইনে চলাচল সড়কপথের চেয়ে দ্রুততর। একই দূরত্বে ট্রেনে ভ্রমণের খরচ সাধারণত বাসের চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত কম হতে পারে, বিশেষ করে দীর্ঘপথে। তা ছাড়া রেলপথে যাত্রীদের আরাম ও নিরাপত্তা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বহু আগেই আন্তঃশহর যোগাযোগে রেলের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে এনেছে। জাপানে ‘শিনকানসেন’ (ঝযরহশধহংবহ) নামের বুলেট ট্রেন প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার বেগে চললেও দুর্ঘটনার হার শূন্যের কাছাকাছি। ইউরোপে ফ্রান্সের ঞএঠ ও জার্মানির ওঈঊ রেলব্যবস্থা হাজার কিলোমিটার দূরের শহরগুলোকে কয়েক ঘণ্টায় যুক্ত করছে। এমনকি চীন মাত্র এক দশকে বিশ্বের দীর্ঘতম হাইস্পিড রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যেখানে বছরে শতকোটি মানুষ দ্রুত ও সাশ্রয়ী ভ্রমণ করছে। এই উদাহরণগুলো আমাদের শেখায় যে, কোনো দেশের উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা শুধু আর্থিক নয়, বরং সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নেরও প্রতিফলন। সড়কনির্ভরতা কমিয়ে রেলকেন্দ্রিক পরিবহন নীতি গ্রহণ করলে বাংলাদেশের পক্ষেও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (ঝউএ) অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবহন নীতিতে এখন ‘এৎববহ গড়নরষরঃু’ ধারণার আওতায় ট্রেনকে বাস ও বিমানের বিকল্প হিসেবে উৎসাহিত করা হচ্ছে, কারণ এটি কম কার্বন নিঃসরণ করে এবং পরিবেশবান্ধব। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশে এই ‘সবুজ পরিবহন’ ধারণা গ্রহণ করা শুধু সময়োপযোগী নয়, বরং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য। যুক্তরাজ্যে ‘ঐঝ২ চৎড়লবপঃ’-এর মতো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে রাজধানী থেকে উত্তরাঞ্চলের শহরগুলোতে ট্রেনের গতি দ্বিগুণ করতে। এসব উদাহরণ থেকে শেখা যায়, রেল কেবল পরিবহন নয় বরং এটি উন্নত অর্থনীতি ও পরিবেশবান্ধব নীতির প্রতীক।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশের রেল যোগাযোগব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও প্রয়োজনের তুলনায় সেটা অপ্রতুল। যেমন- ঢাকা থেকে পর্যটননগরী কক্সবাজারে প্রতিদিন যে পরিমাণ যাত্রী যাতায়াত করে তাতে করে দিনে ৬-৭টা ট্রেন দিলেও যাত্রীর অভাব হবে না। কিন্তু সেখানে বর্তমানে প্রতিদিন মাত্র ২টি ট্রেন যাতায়াত করছে। অন্য দিকে পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও ঢাকা থেকে খুলনা কিংবা যশোর এর সরাসরি ট্রেনের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। আবার ঢাকা থেকে দেশের অনেক শহরে যাওয়ার জন্য কোনো রেললাইনই নেই। ইদানীং ট্রেন যাত্রার এক মহা আতঙ্কের নাম পাথর ছুড়ে মারা। প্রায়ই বাইরে থেকে ছোড়া পাথরে আহত হচ্ছে ট্রেনের যাত্রীরা। বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। তা ছাড়া টিকিট পেতে ভোগান্তি তো আছেই। অনলাইনে টিকিট পাওয়া যেন সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার মতো।

অনলাইনের টিকিটগুলো বিক্রয় শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই উধাও হয়ে যায়। টিকিট প্রাপ্তিতে জটিলতা, যথেষ্ট ট্রেন না থাকা, দুর্বল সেবাকাঠামো, মূল শহর থেকে রেলস্টেশনগুলো দূরে হওয়া ইত্যাদি কারণে সময় ও অর্থ সাশ্রয়ী হওয়া সত্তে¡ও একপ্রকার বাধ্য হয়েই মানুষ সড়কপথে বাস, মিনিবাস, মাইক্রো বা ট্রাকে করে যাতায়াত করছে। ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও পঙ্গুত্ববরণ করছে অসংখ্য মানুষ। এসব দুর্ঘটনার অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও কম নয়।

সুতরাং সময় এসেছে রেলব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশের যোগযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করার। প্রথমত, ঢাকা থেকে দেশের অন্যতম প্রধান শহর তথা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট রাজশাহী, খুলনা ও যশোর রুটে ট্রেন সংখ্যা দ্রুত বাড়াতে হবে। এই রুটগুলোতে বাসের বিকল্প হিসেবে যথেষ্ট সংখ্যক ট্রেন থাকলে যাত্রীরা আগ্রহী হবেন। পাশাপাশি নতুন রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে যে শহরগুলোতে রেল যোগাযোগ নেই সেগুলো রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, রেল অবকাঠামো ও রোলিং-স্টকে (ইঞ্জিন ও কোচ) বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন।

উন্নত সিগন্যালিং ব্যবস্থা, নিরাপদ ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণ ও স্টেশনে ইমার্জেন্সি সাপোর্ট-সিস্টেমের দ্রুত সংস্কার করা জরুরি। তৃতীয়ত, স্টেশনে যাত্রীসেবা বৃদ্ধি, ট্রেনে ওয়াই-ফাই, খাবার সেবা, আরামদায়ক সিট রিজার্ভেশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। চতুর্থত, টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা সিন্ডিকেটমুক্ত ও স্বচ্ছ করতে হবে। অনলাইন টিকিটিং সিস্টেমে নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা জরুরি। একই সাথে কালোবাজারি রোধে কঠোর শাস্তি ও প্রযুক্তিনির্ভর মনিটরিং দরকার। পঞ্চমত, জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সরকারি প্রচার কার্যক্রমের মাধ্যমে রেল ভ্রমণের সুবিধা তুলে ধরা যেতে পারে। রেলপথ ব্যবহারে পরিবেশ রক্ষার বার্তাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

সড়কপথে দুর্ঘটনা, যানজট ও অতিরিক্ত নির্ভরতার যে দুষ্টচক্রে আমরা আটকে আছি, তার কার্যকর সমাধান হতে পারে শক্তিশালী ও আধুনিক রেলব্যবস্থা। এটি কেবল নিরাপদ ও সাশ্রয়ী নয়, বরং এটি সভ্য, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব সমাজের প্রতীক। রেল খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হলে রেলপথ হতে পারে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও নিরাপদ যোগাযোগমাধ্যম। সময় এসেছে রেলের দিকে নজর দেয়ার।

লেখক : কর্মকর্তা, ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)