নির্বাচন ও রাজনৈতিক দল

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Scarrow গণতন্ত্র সংহতকরণে রাজনৈতিক দলের ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন। রাজনৈতিক দল যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণ করবে, প্রকারান্তরে তারা সে সুফল বা কুফল ভোগ করবে। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, এভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির লালন ও বিকাশ যেন ইনকিউবিটরে একটি শিশু লালনের মতো। অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক অংশগ্রহণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সহনশীলতা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিচয় দিতে হবে। এর মাধ্যমেই জাতির কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে উঠবে। রাজনৈতিক সমঝোতা জাতিকে ‘জাতীয় ঐকমত্যে’র কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল একটি অপরিহার্য অংশ। রাজনৈতিক দলব্যবস্থা প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রে কেন্দ্রীয় বিষয়। রাজনৈতিক দল শাসনব্যবস্থার আবর্তন-বিবর্তনে এতটাই গুরুত্ব অর্জন করেছে যে, সরকারের শাসন ব্যবস্থা রাজনৈতিক দল ব্যতীত কল্পনা করা যায় না। বাস্তব অর্থে গণতন্ত্র রাষ্ট্রপতি অথবা সংসদীয় পদ্ধতিতে- যাহোক রাজনৈতিক দল অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘স্বার্থ জ্ঞাপন ও স্বার্থ বাস্তবায়ন’ হচ্ছে রাজনৈতিক দলের প্রধান কার্যক্রম। রাজনৈতিক দল ছাড়া তা সম্ভব নয়। স্বার্থ জ্ঞাপন ও স্বার্থ বাস্তবায়নের প্রভাবক রাজনৈতিক দল। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক দল সরকারব্যবস্থার সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সংযোগ ঘটায়। রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনের বৈধতা অর্জন করে। তাদের দায়িত্ব শুধু স্বার্থ জ্ঞাপন ও স্বার্থ বাস্তবায়ন নয়; বরং রাষ্ট্রের পরস্পর বিরোধী দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতা বিধান। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় সংহতি নির্মাণও তাদের কাজ। রাজনৈতিক দল যখন এসব নিয়মতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা থেকে সরে যায় তখন Robert Michel’s (১৮৭৬-১৯৩৬) এর মতে ‘গোষ্ঠীতন্ত্রের লৌহ শাসন’ (Iron law of oligarchy) প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় এবং গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো পাকিস্তান আমলের ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক আমল’ এ যথার্থ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতার পরপরই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের লালনপালন ও বিকাশের পরিবর্তে অবশেষে রবার্ট মিশেলস কথিত ‘গোষ্ঠীতন্ত্রের লৌহ শাসন’ কায়েম করে। জিয়াউর রহমানের শাসনকালে নিপাতনে সিদ্ধ ঘটনার মতো সামরিকতন্ত্র বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করে। ১৯৯১ সালে আরেকটি সামরিক স্বৈরতন্ত্রের কবলে নিপতিত হয় দেশ। বিএনপির স্বদিচ্ছায় সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যায় দেশ। কিন্তু তিন জোটের রূপরেখা মোতাবেক গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হয়। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

গণমাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। গণতন্ত্রের বিধান, আইনের শাসনের পরিবর্তে আবারো স্বেচ্ছাতন্ত্রের প্রকাশ ঘটে। ১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার সাময়িক উপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও অচিরেই দেশ ওয়ান-ইলেভেনের মতো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মোকাবেলা করে। রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক আচরণে ব্যর্থ হয়। ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক উন্নয়নের বদলে অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক অনুন্নয়ন অনুভূত হয়। গোষ্ঠীতন্ত্রের লৌহ শাসন অব্যাহত থাকে ২০০৯-২০২৪ পর্যন্ত। দেশের সার্বিক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের অধিকার ও অনুশীলনের অবসান ঘটে। যে নির্বাচনব্যবস্থা গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি তা নির্বাসিত হয়। ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৪ সালে আমি-ডামির ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভাবনীয় অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরতন্ত্রের পতন ও পলায়ন ঘটে। দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় দেড় বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর দেশ আবার গণতন্ত্রের পথে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে।

যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমেই জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় সেহেতু আশু নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সুস্থ ও সুন্দর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বের সুবর্ণ সুযোগ উপস্থাপিত হয়েছে। গোষ্ঠীতন্ত্রের লৌহ শাসনের অবসান হয়েছে। বিগত ১৫ মাসে রাজনৈতিক দলগুলো অবাধ গণতন্ত্রের চর্চা করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের জনমানসতত্তে¡ গণতন্ত্র তথা রাজনীতির প্রকাশ ও প্রকোপ স্বাভাবিক নয়। একটি দেশের জনগণ যদি তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির চেয়ে রাজনীতিতে অতিশয় সক্রিয় হয়, তাহলে তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা হাইব্রিড ডেমোক্র্যাসি বলে থাকেন। বাংলাদেশের জনদারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব ও সহনশীল রাজনীতির অভাবের কারণে একটি অতিমাত্রিক রাজনৈতিক নেতাকর্মী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। এরা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিতে চায়। বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের ফলে একটি অসহনশীল, শক্তিনির্ভর ও বেপরোয়া রাজনৈতিক নেতাকর্মী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সন্ত্রাস রাজনীতির সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান এ ধরনের রাজনৈতিক আচরণের বিপরীত বার্তা বহন করলেও উপযুক্ত দিকনির্দেশনা ও নৈতিকতার অভাবে দেশটি ‘অবিকল নকলে’ ফিরে গেছে। অনুপস্থিত স্বৈরতন্ত্রের বদলে একই রকম রাজনৈতিক আচরণ জনগণ লক্ষ করছে। এ ক্ষেত্রে প্রভু বদল বা হাতবদল ছাড়া ভিন্ন কিছু ঘটেনি। যখন যেখানে যে রাজনৈতিক দল প্রভুত্ব খাটানোর ক্ষমতা রাখে তারা সর্বত্রই একই আচরণ করছে। এ আচরণের জন্য রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্ব যতটা দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী জনমানসতত্ত¡। আগেই বলেছি, জনগণের মধ্যে ‘প্রভু-ভৃত্যে’র যে সম্পর্ক তৈরি করা হয়েছে তা জনগণকে অভ্যস্ত করে তুলেছে। তা ছাড়া সাধারণ ফুটপাথের দোকান থেকে শিল্পপতি পর্যন্ত নিরাপত্তা চায়। এই নিরাপত্তা তার জীবনের জন্য, সম্পত্তির জন্য, সম্মানের জন্য। যেহেতু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, সেজন্য তারা আরেকটি রাজনৈতিক শক্তির কাছে নিজেদের আশ্রয় চেয়ে প্রশ্রয় নিশ্চিত করেছে।

দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র নতুন করে নির্বাচন অভিমুখী হয়েছে। সব বাধা-বিপত্তি ও অনিশ্চয়তা অতিক্রম করে দেশ নির্বাচনী যুদ্ধে অগ্রসর হয়েছে। এই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে একটি নির্বাচিত সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি গণভোটের রায়ে নির্ধারিত হতে যাচ্ছে সংবিধানসহ রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবনার ভবিষ্যৎ। এ নির্বাচনের মাধ্যমে গোটা জাতি অতীতের তিনটি কলঙ্কজনক নির্বাচনের জবাব দিতে যাচ্ছে। এখন গোটা জাতির সামনে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেল। রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি নির্বাচনের আয়োজনে অংশগ্রহণ করছে। বলা যেতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলো বিগত দেড় বছরে অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিল। ইতোমধ্যেই বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে অতিমাত্রিক রাজনৈতিক কার্যকলাপ সারা দেশে অনুভূত হয়েছে। একই সাথে ডজন ডজন নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের প্রকাশ ও নিবন্ধন চেষ্টা দেশের কথিত হাইব্রিড গণতন্ত্রের প্রমাণ রেখেছে। বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য সব ধরনের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে জোটে আশ্রয় গ্রহণ এবং নতুন নতুন জোট গঠনের প্রচেষ্টা একটি লক্ষণীয় বিষয়। জোট গঠন ক্ষেত্রে সবাই প্রধান প্রধান দলের আশীর্বাদ বা অনুকম্পা চায়। এতদিন যারা দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আস্থার সাথে জোটে থেকেছে তারা এখন জোটের প্রার্থী হতে না পেরে বিষোদগার করছে। এসব ক্ষেত্রে ক্ষমতা এবং শুধু ক্ষমতার রাজনীতিই দৃশ্যমান হচ্ছে। নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের কোনো বালাই থাকছে না। অবশ্য বাম ও ডান ধারার আদর্শবাদিতা যে একেবারেই অনুপস্থিত তা বলা যাবে না।

রাজনৈতিক দলের নির্বাচনকেন্দ্রিক জোটের ক্ষেত্রে আওয়ামী ঘরানার দৃশ্যমান কার্যক্রম এখনো স্পষ্ট নয়। প্রথমত, রাজনৈতিক দল হিসেবে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছে না- এটি একটি বাস্তবতা। কাজেই আওয়ামী লীগের এখন প্রধান কাজ হচ্ছে নির্বাচন বানচাল করা। নির্বাচনে যাতে জনগণ অংশগ্রহণ করতে না পারে সে জন্য তারা নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কোন্দলের সুযোগ নিয়ে তারা হত্যা, রাহাজানি ও অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা করবে। এ কারণে সীমান্ত দিয়ে আসতে পারে অস্ত্র। আওয়ামী লীগের লোকদের এসব অস্ত্র সরবরাহ করে আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি তাদের লক্ষ্য। এখন দৃশ্যমান হচ্ছে যে তারা শুধু সশস্ত্র উপায়ে নয়; বরং রাজনৈতিক উপায় নির্বাচনকে মোকাবেলা করার ফন্দি এঁটেছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে জাতীয় পার্টি যেমন তাদের ওপর ভর করেছিল, এখন তারা জাতীয় পার্টির ওপর ভর করতে চাচ্ছে। যেখানে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কথা নয়, সেখানে আকস্মিকভাবে তাদের গ্রিন সিগন্যাল দেয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক নয়। ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টির এক অপভ্রংশ জোট গঠন করেছে। অপর অংশটি আরো সরব হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বলা যায় প্রতিবেশী দেশ এবং আওয়ামী লীগের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে নীরব প্রতিযোগিতা চলছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এটি অতি অবশ্যই একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়।

সমাগত নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ। আগেই বলা হয়েছে, প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত হয়। নির্বাচনই হচ্ছে একমাত্র ব্যবস্থা যার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শাসক নির্ধারিত হবে। বিভিন্ন মাত্রার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এতে অংশগ্রহণ করবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উত্তরাধিকারের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। শেখ বংশের বিদায়ের ফলে বংশীয় রাজনীতির একটি অধ্যায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেষ হয়েছে। এর ফলে সৌভাগ্যবান হয়েছে দ্বিতীয় উত্তরাধিকারের শক্তিটি। বিপ্লবোত্তর সময়ে একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মন্তব্য করছিলেন যে, ঠিক এখনই যদি নির্বাচন হয় তাহলে প্রধান রাজনৈতিক দলটি আওয়ামী লীগের মতোই ২৯৭ আসন পাবে। পার্থক্য এই যে, আওয়ামী পাওনাটি শক্তির আর বিএনপির পাওনাটি সম্মতির। প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হবে বলে অনেকের ধারণা ছিল। যতই দিন যাচ্ছে ততই নির্বাচনের হালচাল পরিবর্তনের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। অতি সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় ৬৬ শতাংশ বনাম ৩০ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। অন্যত্র ৩০ শতাংশ বনাম ২৬ শতাংশের কথা বলা হচ্ছে।

জামায়াতের রাজনৈতিক উত্থান অনেককে অবাক করেছে। যেখানে বিএনপি-জামায়াত রাজনৈতিক মৈত্রীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করছিল, এখন সেখানে জামায়াতই প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা। রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনৈতিকভাবেই নির্বাচনে একে অপরের মোকাবেলা করতে হবে। জনগণ তাদের নিজ নিজ কর্মসূচি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বুঝেশুনে ভোট দেবে। সেখানে শক্তি প্রয়োগের কোনো স্থান নেই। কিন্তু আমরা নাগরিক সাধারণ ইতোমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত আচরণ লক্ষ করেছি। ইতোমধ্যে ভিপি নুর প্রতিপক্ষের চরম হিংসার সম্মুখীন হয়েছে। আন্দালিব রহমান পার্থের লোকজন ভোলায় আক্রমণের শিকার হয়েছে। ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ নির্বাচনী প্রচারণাকালে প্রতিপক্ষের হামলার সম্মুখীন হয়েছেন। কোনো কোনো জায়গায় বিএনপি বনাম জামায়াতের মধ্যে উত্তেজনার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসবই অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ। আশার কথা যে, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা সংযমের কথা বলছেন। এই সেদিন বিএনপির কর্ণধার তারেক রহমান বলেছেন, একজন ভালো আর সবাই খারাপ- এ ধরনের ধারণায় বিশ্বাস করা যাবে না। জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বও সুন্দর আচরণের কথা বলছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা একটি ফ্যাসিবাদী শক্তি মাত্র অতিক্রম করেছি। এর প্রভাব ও রেশ সমাজে এখনো বিদ্যমান।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Scarrow গণতন্ত্র সংহতকরণে রাজনৈতিক দলের ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন। রাজনৈতিক দল যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণ করবে, প্রকারান্তরে তারা সে সুফল বা কুফল ভোগ করবে। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, এভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির লালন ও বিকাশ যেন ইনকিউবিটরে একটি শিশু লালনের মতো। অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক অংশগ্রহণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সহনশীলতা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিচয় দিতে হবে। এর মাধ্যমেই জাতির কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে উঠবে। রাজনৈতিক সমঝোতা জাতিকে ‘জাতীয় ঐকমত্যে’র কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।

লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]