হাজারো সমস্যা জর্জরিত বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কারো কাছে কোনো জাদুরকাঠি নেই; তবে একটি বিষয় হাতে নিয়ে আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালালে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হতে পারে। প্রশ্ন হলো সেটি কী? আমাদের বিবেচনায় এক কথায় সেটি হচ্ছে দেশে ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠা করা। আমরা গত দেড় দশকে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, নীতিহীনতা ও নৈরাজ্য প্রত্যক্ষ করেছি। এর থেকে উত্তরণে ২০২৪ সালে একটি ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান হয়েছে। জনমানসে বিরাট প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো সেই জন-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারবে কি না তা-ই বড় প্রশ্ন। নির্বাচন সামনে রেখে দলগুলো ভোটারদের কাছে যাচ্ছে কথার ফুলঝুরি নিয়ে। তারা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় করণীয় পরিকল্পনার চেয়ে প্রতিপক্ষকে যা তা ভাষায় নাজেহাল করা নিয়ে বেশি ব্যস্ত। আমরা যারা শান্তিপ্রিয় নাগরিক তারা জানতে চাই- রাজনৈতিক দলগুলো সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কী কী অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ব্যক্ত করছে। এবারে আমরা আলোচনা করব সুশাসন বলতে কী বুঝায় এবং বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রায়োগিক তাৎপর্য কতটুকু।
মানবজীবনের একটি অপরিহার্য বিষয় হলো সামাজিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও শাসন। মানুষ তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণে তার পছন্দের নেতৃত্ব বেছে নেয় এবং তাকে অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। বিভিন্ন পরিবেশে নেতৃত্বের পরিবর্তন হতে পারে। অন্যদিকে, শাসন হচ্ছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক, তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন। একটি সরকার এসব বিষয় নিয়ে দায়িত্ব নেয়। নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা নাগরিকদের জন্য কল্যাণকর হতে পারে। এর অভাব হলে নাগরিক জীবনে শান্তি ও কল্যাণের পরিবর্তে দুঃসহ যন্ত্রণা নেমে আসতে পারে। তাই নাগরিকদের সহযোগিতা ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
সুশাসনের সংজ্ঞা নানাজন নানাভাবে দিয়েছেন। সময়ের বিবর্তনে তার পরিবর্তনও ঘটেছে। সাম্প্রতিক দশকে বিষয়টি রাজনৈতিক ও উন্নয়ন পরিমণ্ডলে বেশ গুরুত্বের সাথে আলোচিত হচ্ছে। সংক্ষেপে সুশাসনের চারটি স্তম্ভ হলো: স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, আইনের শাসন ও নাগরিকদের অংশগ্রহণ। এছাড়াও জাতীয় ঐক্য, ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি, কার্যকরতা ও দক্ষতা এবং সংবেদনশীলতা সুশাসনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
বিশ^ব্যাংক নব্বইয়ের দশক থেকে উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে সুশাসনের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। ব্যাংকটির মতে, সুষ্ঠু উন্নয়ন ব্যবস্থাপনাই সুশাসন। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, সুশাসনে দরকার সরকারি খাতের ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, কার্যকরতা, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা, অবাধ তথ্যপ্রবাহ এবং ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য আইনি কাঠামো নিশ্চিত করা (বিশ^ব্যাংক, ১৯৯৪)। সাম্প্রতিক দশকে বিভিন্ন দেশের সুশাসন পরিমাপে বৈশি^কভাবে ইনডেক্স তৈরি করা হয়ে থাকে।
জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের মতে, সুশাসন মানে দুর্নীতি দূর করা এবং চাহিদাপূরণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের কথা বলার সুযোগ থাকা এবং সংখ্যালঘুদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া (এসক্যাপ, ২০১০)। ইউএনডিপি ১৯৯৭ সালে গভার্ন্যান্স ফর সাসটেইনেবল হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট: শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, একটি দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কিভাবে রাষ্ট্রীয় সব বিষয় পরিচালনায় কোন পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিচ্ছে তার ওপর সুশাসন নির্ভর করে। সংস্থাটির মতে, শাসনের তিনটি দিক থাকে- অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা হচ্ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অন্যান্য অর্থনীতির সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। আর রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা হচ্ছে, নীতি ও আইন প্রণয়ন করা। অন্যদিকে, প্রশাসনিক ব্যবস্থা হচ্ছে নীতি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা।
জাপানের ফুকায়ামার মতে, সুশাসন নির্ভর করে একটি রাষ্ট্র নাগরিকদের পণ্য ও সেবা পূরণে কতটা দক্ষ তার ওপর (২০১৬)। সুতরাং আমরা বলতে পারি, সুশাসন হলো রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার একটি ইতিবাচক পদ্ধতি যা সাধারণত সর্বোত্তম সম্ভাব্য সুফল অর্জনের সুযোগ করে দেয়। এর মূল কথা হলো দায়িত্বশীলতা, সুনীতি ও ন্যায্যতা। সুশাসন মানে, রাষ্ট্র ও সরকার এমন একটি পরিবেশ তৈরি করবে যার ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুশাসনের অবস্থা কোন পর্যায়ে রয়েছে তা ইউএনডিপি সুশাসনে যে নয়টি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছে তার আলোকে আলোচনা করতে পারি।
প্রথমত, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকার ও নেতৃত্বের কৌশলগত ভিশন হতে হবে দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবসম্মত। আমরা দেখতে পাই, বিগত ৫৪ বছরে সুশাসনে যে উপযুক্ত নীতিকৌশল প্রণয়ন করা প্রয়োজন ছিল তাতে বেশ ঘাটতি রয়েছে। অধিকন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে কোনো নীতিকৌশল টেকসই হয়নি। অর্থনীতির কথা যদি বলি দেখা গেল ১৯৭২ সালে বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও তাকে স্থিতিশীল ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে জগাখিচুড়ি সমাজতান্ত্রিক নীতি চালু করা হলো এবং তা দ্রুত মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। জিয়াউর রহমান তাকে সোজা করতে বাস্তবসম্মত ও গতিশীল নীতিপ্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে তাকে জীবন দিতে হলো। জিয়ার পরে বাংলাদেশে আর কোনো ভিশনারি তথা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক আমরা পেলাম না। আশির দশক থেকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে দেয়া হলো না। ফলে সুশাসন ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেল।
দ্বিতীয়ত, সুশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। কোনো রাজা-রানী বা একনায়ক-স্বৈরশাসক নয়; দেশের নাগরিকরা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় তাদের অংশীদারত্ব থাকতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে, শাসনব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্ব থাকবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে বারবার নির্বাচনব্যবস্থা প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। এমনকি বছরের পর বছর মানুষ ভোট দিতে পারেনি। ফলে সামরিক-অসামরিক আমলা ও ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত বলে কথিত রাজনৈতিক মাস্তান ও টাউটরা দেশ শাসন করেছে। নাগরিক সমাজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় যখন নীতিপ্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের অংশগ্রহণ না থাকে তখন তাকে সুশাসন বলা যায় না। তাই সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া হতে হবে তৃণমূল থেকে ঊর্ধ্বমুখী; ঊর্ধ্ব থেকে নিম্নমুখী নয়। এ ব্যবস্থাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচায়ক।
তৃতীয়ত, সুশাসনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও পাকিস্তানি শাসনামলে প্রণীত বহু আইন এবং স্বাধীনতা-উত্তর বিভিন্ন পার্লামেন্টে গৃহীত অনেক আইন রয়েছে; যা সুশাসনে সহায়ক বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু সেই আইনগুলো ন্যায্যতার সাথে প্রয়োগ ও কার্যকর হয় না। বরং ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ এ নীতি আমাদের দেশে খুব দুর্বল অবস্থানে। ক্ষমতা ও অর্থের দাপটে আইন ও বিচার যেন নিভৃতে কাঁদে। গরিব-দুঃখী ও সাধারণ মানুষ এখনো ঔপনিবেশিক যুগের মতো মজলুম হিসেবে সমাজে বাস করে। সাম্প্রতিককালে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির যে মহোৎসব চলছে তা কিন্তু আইনের শাসনের অভাবে ঘটছে।
চতুর্থত, সরকারি সব কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হলে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। জনপ্রতিনিধি বা সরকারি কর্মচারী যিনি হোন না কেন, তিনি যেহেতু নাগরিকসেবা প্রদানের কাজ করেন, সেহেতু তাকে সব কাজ নিয়ম ও বিধিবিধান মেনে সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু দেশের শাসনব্যবস্থায় বহু ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। দু-একটি ছোটখাটো উদাহরণ দিলে বিষয়টি বোঝা যাবে। যেমন- বিমানবন্দরে যাত্রীদের হয়রানি, লাগেজ নিয়ে কেলেঙ্কারি ইত্যাদি যুগ যুগ ধরে উন্নতি হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের স্বচ্ছতা না থাকায় এরূপ হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। কিন্তু ‘ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন’ যদি ঠিক না থাকে তাহলে প্রযুক্তি পুরোপুরি কাজে দেবে না। এজন্য সিস্টেম সংস্কার ও আমলাতন্ত্রের নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। নাগরিকদের জন্য অবাধ ও সহজলভ্য তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। নিরীক্ষা কার্যক্রমে দক্ষতা ও গতিশীলতা আনয়ন এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন ও দক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে হবে।
পঞ্চমত, সরকারের সব কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার সাথে সংযুক্ত হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারি প্রশাসনের সব স্তরে জবাবদিহির সিস্টেম গড়ে তোলা। প্রতিটি রাষ্ট্র্রীয় প্রতিষ্ঠানে এমন বিধিবিধান প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে যাতে কেউ জবাবদিহির বাইরে না থাকে। আমাদের দেশে জনপ্রতিনিধি ও আমলারা প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের জবাবদিহি থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। যেমন- বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা চুরি ও দেশের বাইরে পাচার করা হলো তার কারণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহির ব্যবস্থা ছিল খুব দুর্বল। ব্যাংকগুলো যে ভুয়া ডকুমেন্টের ভিত্তিতে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিতে পেরেছে, কারণ সেখানে জবাবদিহি সঠিকভাবে ছিল না, যা পার্লামেন্ট এসব অনিয়ম নিয়ে শোরগোল করতে পারত সেখানেও সমবেত হয়েছিল দুর্নীতিবাজ ও চাটুকাররা।
ষষ্ঠত, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিটি স্তরে যেসব নেতৃত্ব ও বাস্তবায়নকারী আমলা শ্রেণী থাকে তারা যদি জ্ঞান ও কর্মে দক্ষ না হন তা হলে নাগরিকরা তাদের কাক্সিক্ষত সেবা যথাসময়ে পান না। শুধু তাই নয়, যদি লক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহীত প্রকল্প বা কর্মসূচি সঠিকভাবে প্রণয়ন করা না হয় এবং সুবিধাভোগী নির্বাচনে ন্যায্যতা না থাকে তাহলে সরকারি পরিষেবা কার্যকরতা লাভ করতে পারে না। বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও কার্যকরতার অভাব সব সময় পরিলক্ষিত হয়।
সপ্তমত, রাষ্ট্রের সেবা ও সম্পদ বণ্টনে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সুশাসনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। সরকারি যত প্রকার কর্মসূচি ও হস্তক্ষেপ রয়েছে তার প্রতিটি স্তরে ন্যায্যতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অতীতের প্রায় প্রতিটি সরকার ব্যর্থ হয়েছে। নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের অন্যায্য সুবিধা দেয়া দেশের একটি কুসংস্কৃতি হিসেবে চালু রয়েছে। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের পরে বৈষম্য দূরীকরণ ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা প্রবল হয়েছে।
অষ্টমত, রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যেসব বৃহত্তর নীতি ও আইন প্রণয়ন করা হবে সেখানে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনৈক্য তো প্রকট। এর পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ও ন্যায্যতার ওপর পরিচালনায় যে নীতি ও আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন সেখানে জাতীয় ঐক্যের অভাব রয়েছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সুশাসনে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে পরিচালনা করতে হবে। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ প্রণয়নের লক্ষ্যে যখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে তখন কোনো কোনো রাজনৈতিক দল দুদককে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীনভাবে গড়ে তোলার ব্যাপারে আপত্তি জানায়। অথচ দুদকের স্বাধীন সত্তার ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার ছিল। এরকম আরো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ন্যূনতম জাতীয় ঐক্য না থাকলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়ে।
নবমত, নাগরিক চাহিদা পূরণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি নীতিনির্ধারক ও বাস্তবায়নকারী আমলাতন্ত্রের সংবেদনশীলতা তথা ত্বরিত ও যথোপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। যেমন- প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্বরিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা; কৃষকের চাহিদা মতো সার ও কীটনাশক সরবরাহ; বাজারে পণ্যের ঘাটতি মোকাবেলায় দ্রুত আমদানি করা ইত্যাদি। নাগরিক চাহিদা পূরণে জনপ্রশাসন ও নীতিনির্ধারকদের দক্ষতা অপরিহার্যভাবে প্রয়োজন। আমাদের নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্র অনেক ব্যাপারে বেশ অদক্ষতা ও শ্লথগতির পরিচয় দিয়ে থাকে। সুশাসন নিশ্চিত করায় তাই দরকার প্রাজ্ঞ, তথ্যসমৃদ্ধ ও জ্ঞাননির্ভর একটি সরকারি প্রশাসন।
উপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার, নেতৃত্ব যদি দেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতায় একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে পারে। সেই সাথে জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নীতি ও কর্মসূচি এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারে তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এছাড়া সেখানে একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ সহজ হবে।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব



