বাম রাজনীতির সাংস্কৃতিক যোগসূত্র

স্বাধীন বাংলাদেশেও বামপন্থীরা সর্বভারতীয় সংস্কৃতিতে সাচ্চা মুমিন। ‘পর সংস্কৃতিতে’ ঈমান আনলে যে স্বাধীন থাকা যায় না; এ বোধবুদ্ধি বামপন্থীদের না থাকলেও এদেশের তৌহিদি জনতার রয়েছে।

নয়া দিগন্ত

প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে। সে অনুযায়ী গড়ে ওঠে তাদের জীবনধারা। সংস্কৃতি বিনির্মিত হয় সময়ের পরিক্রমায়। সংস্কৃতির মাধ্যমে অধিকার আদায়ে জন্ম নেয় প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি। সংস্কৃতির রাজনীতি আর প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির দূরত্ব হয়তোবা নেই, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে আমাদের দেশ-সমাজ বাস্তবতায় কুয়াশা জমেছে ‘সংস্কৃতির রাজনীতি’র পরিভাষায়। বিদ্যার ভারহীন দীপ্তি যেহেতু সংস্কৃতি, সুতরাং রাজনীতির কথা সংস্কৃতিকে আগে ছুঁয়ে যায়; প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির জন্মের আগে সংস্কৃতির কথাই মূলত প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির দ্বার উন্মোচন করে। রাজনীতি কোথায় কিভাবে সৃষ্টি হয়, সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে তা জানান দেয় বা দৃশ্যমান হয়।

সাতচল্লিশে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার বিচ্ছেদের মূলে ছিল সাংস্কৃতিক পার্থক্যজাত উপলব্ধি। আর্থিক জীবন ছিল এর সাথে অবিচ্ছিন্ন। অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। বাংলায় এর সূচনা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ঘটনায়। ব্রিটিশরা প্রশাসনিক সুবিধার্থে বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি কলকাতায় বসবাসকারী বর্ণ হিন্দু, জমিদার-মধ্যবিত্ত, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। বঙ্গভঙ্গের ভেতর তারা নিজেদের সমূহ সর্বনাশ আঁচ করে এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। বঙ্গভঙ্গ রদ করতে সারা বাংলায় সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়। এ কাজে ধনিক ও জমিদার গোষ্ঠী দেদার অর্থ ঢালে। এর মুখ্য কারণ ছিল, নিজেদের আর্থসামাজিক আধিপত্য খোয়ানোর আশঙ্কা। পূর্ববাংলা মানে, ভাটি বাংলা অর্থাৎ- আজকের বাংলাদেশ ব্রিটিশ ভারতের আলাদা প্রশাসনিক ইউনিট হলে কলকাতার বাবু হিন্দুদের সমূহ বিপদ অবধারিত। রাজধানী কলকাতায় তাদের আয়েশি জীবনে ছেদ পড়ার শঙ্কা তীব্রতর হয়ে ওঠে।

বাংলা ভাগের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য যে সুযোগ তৈরি হয়, তাতে কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত হিন্দুরা এতদিন রাজনৈতিক-সামাজিক যে সুবিধা একচেটিয়া ভোগ করত, তাতে টান পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আর এতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে বঙ্গভঙ্গ রদে। অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গ বহাল থাকলে পূর্ববাংলার সংখ্যাগুরু অধিবাসী, বঙ্কিমের ভাষায়- ম্েøচ্ছ বা যবনদের জীবনে ঘটবে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন। বঙ্গভঙ্গ দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলায় হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে দীর্ঘদিনের যে বৈষম্য বিদ্যমান ছিল তা খানিকটা হলেও ঘুচত।

পূর্ববাংলার জমিদার গোষ্ঠী জমিদারি হারানোর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বঙ্গভঙ্গ রদে সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তোলে। তাদের অর্থায়নে ও পৃষ্ঠপোষকতায় চরম সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী আদর্শের যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতির জন্ম হয়। পরবর্তীকালে স্বদেশী আন্দোলনের নামে এসব হিন্দু উগ্রবাদী সংগঠনে জড়িয়ে পড়েন সূর্য সেন, আশা প্রীতিলতা, ক্ষুদিরামরা। যাদের আদর্শ ধারণ করে আছে আজকের ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি, শিবসেনা তথা সংঘ পরিবার। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় এসে এক দশকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলিম নিধন চালিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের মনে রাখা আবশ্যক, ঊনবিংশ শতাব্দীর বেঙ্গল রেনেসাঁ বা হিন্দু নবজাগরণের উদরে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির জন্ম। যার সাহিত্যিক গুরু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এর শৈল্পিক রূপায়ণ হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। পূর্ববাংলার জমিদারির আয়ে ধনী রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। আর এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, ব্রাহ্ম সমাজের আড়ালে মূলত হিন্দু ধর্মের অবক্ষয় রোধে আধুনিক সাংস্কৃতিক সৌধ নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বঙ্গভঙ্গকালে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদে কাতর হয়ে রচনা করেন আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের যেটি জাতীয় সঙ্গীত সেই ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি। অন্য দিকে স্বাধীন ভারতে ১৯৪৮ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদের মাহাত্ম্য প্রচার করতে মোহিনী চৌধুরী লেখেন- ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে/কত প্রাণ হলো বলিদান/লেখা আছে অশ্রুজলে’ গানটি। এটি যে দেশপ্রেমের নামে হিন্দু জাগরণমূলক গীত তা আমাদের প্রায় সবাই ভুলে গেছেন বা ভুলে যান।

বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন এবং এর ধারাবাহিকতায় উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পালে হাওয়া দিতে হিন্দু বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, নাট্যকার, গীতিকার, সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার- সবাই অর্থাৎ সাংস্কৃতিককর্মীরা সম্মিলিতভাবে সর্বভারতীয় সংস্কৃতি অর্থাৎ- প্যাগান কালচারের আধুনিক রূপান্তর ঘটান। ওই সাংস্কৃতিক ধারাই মূলত বাম-কংগ্রেস রাজনীতির আদর্শ। যার পুরোভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী এবং জওয়াহের লাল নেহরু। অন্যদিকে, নবাব সলিমুল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে ঢাকার ইশরাক মঞ্জিলে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন) ১৯০৬ সালে গড়ে ওঠা মুসলিম লীগের হাল ধরেন একদা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অগ্রদূত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।

ইতিহাস-সচেতন ব্যক্তিমাত্র সবার জানা, বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন ছিল ভাটি বাংলায় হিন্দু জমিদারদের আর্থসামাজিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পরিচালিত এক হীন গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এখানে দেশপ্রেম মুখোশমাত্র; হীনস্বার্থ আড়ালের কূটকৌশল। অথচ পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক শ্রেণী বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে নিজেদের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক উত্থানের সুবর্ণ সুযোগ দেখেছিলেন। তাদের দেখার দৃষ্টিকোণটি ছিল বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার যৌক্তিক পদক্ষেপ। ফলে পূর্ববাংলার কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠী বঙ্গভঙ্গকে শৃঙ্খলমুক্তির উপায় হিসেবে নিয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে আর্থ-রাজনৈতিক কারণে সাতচল্লিশে বাংলা ভাগ করতে কলকাতার বর্ণ হিন্দুরা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি, সাধের বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদে কার্পণ্য করেননি। সাতচল্লিশে বাংলা ভাগ বাস্তবায়নে ছেচল্লিশের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে হাজারো মানুষ হত্যা করা হয়। কলকাতার বর্ণ হিন্দুরা ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ রদে প্রাণপাত করলেও সাতচল্লিশে বঙ্গভঙ্গ অনিবার্য করে তোলেন আর্থ-রাজনৈতিক প্রভাব ক্ষুণ্ণের শঙ্কায়।

বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে প্রাচীন মিসরের ফেরাউনের সাথে বর্ণ হিন্দুদের আচরণের খানিকটা মিল পাওয়া যায়। দ্বিতীয় ফেরাউন তার শাসনামলে বনি ইসরাইলকে দাসে পরিণত করে তাদের শ্রমে-ঘামে অর্থনৈতিক ভিত গড়ে তোলে। তাই, সে কোনো অবস্থায় বনি ইসরাইলকে নিষ্কৃতি দিতে চায়নি। বনি ইসরাইলের নিষ্কৃতির ভেতর ফেরাউন তার অর্থনীতির মূল ভিত দাসনির্ভর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মহাবিপর্যয়ের আলামত দেখতে পায়। ফলে নবী মুসা আ:-এর সাথে বনি ইসরাইলকে মিসর ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে ফেরাউন। ঠিক তেমনিভাবে ১৯০৫ সালে পূর্ববাংলা ও আসাম মিলে নতুন প্রদেশ গঠনের প্রক্রিয়ায় কলকাতাকেন্দ্রিক পূর্ববাংলার জমিদার গোষ্ঠী নিজেদের সমূহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে এটিকে তথাকথিত ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ হিসেবে বয়ান খাড়া করে বা দেশপ্রেমের নামে ভণ্ডামি করে। যে কারণে তারা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদে সফল হয়। আবার সাতচল্লিশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় হিন্দু ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী সেই বঙ্গমাতার অঙ্গহানির দাবিতে অর্থাৎ- বাংলা ভাগ করতে উঠে পড়ে লাগে।

১৯০৫ সালে পূর্ববাংলা ছিল বর্ণ হিন্দুদের অর্থনৈতিক সব কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি। সাতচল্লিশে অবিভক্ত বাংলা অস্তিত্বে এলে তা হতো তাদের অপূরণীয় আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষতি। এ জন্য সাতচল্লিশে মধ্যবিত্ত হিন্দুরা বাংলাপ্রেম ছেড়ে সর্বভারতীয় সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়াই নিজেদের জন্য শ্রেয় মনে করে। স্বাধীন দেশ নয়, ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হয়ে থাকা ছিল তাদের কাছে সর্বোত্তম।

শুরুতে আমরা উল্লেখ করেছি, সংস্কৃতি প্রতিটি জাতির রাজনীতির গতিধারার নির্ণায়ক। সেই সাথে অন্য সব জাতি-সম্প্রদায়ের সাথে ভেদরেখা টেনে দেয়। আমাদের বক্তব্য ছিল সংস্কৃতি রাজনীতির মূল কথা। সংস্কৃতি যেখানে যুক্তিসঙ্গতভাবে আলাদা থাকে; সেখানে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি চর্চার আবশ্যকতা প্রবলভাবে ধরা দেয় না। রাজনীতি সেখানে অন্যরূপে অন্য সত্তায় হাজির বা উপস্থিত থাকে। সেখানে নাগরিক অধিকার প্রাধান্য পায় সর্বাগ্রে। সেদিক দিয়ে রাজনীতি মূলত সংস্কৃতি উপলব্ধির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী, কিংবা সংস্কৃতির উপলব্ধিগত পার্থক্য যেখানে হাজির, সেখানে রাজনীতি তার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকতা এনে দেয়। সংস্কৃতির এই যে ভেদরেখা; তা-ই সাতচল্লিশে বাংলা ভাগ অনিবার্য করে তোলে। উল্টো পিঠে ভাটি বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কাছে পাকিস্তান সত্য হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু পাকিস্তানের দুই খণ্ড পূর্ব ও পশ্চিম অংশের সংস্কৃতিতে বিস্তর অমিল থাকায় নতুন গঠিত দেশটি মাত্র ২৪ বছরে ফের ভাঙনের মুখে পড়ে।

একসময়ের পূর্ববাংলা মানে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাছে একাত্তর এভাবে ধরা দিয়েছিল। একাত্তরে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। সেই বাংলাদেশে বিশ্বাসের আলোকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে নিজস্ব জীবনদর্শনে টিকে থাকার বাসনা পোষণকারী জনগোষ্ঠী নির্মম নির্যাতন নিপীড়নের শিকার। বিশেষ করে শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য মুছে ফেলার সব রকম অপচেষ্টা হয়েছে। এ কাজে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল নব উত্থিত লুটেরা শাসক শ্রেণী অর্থাৎ- আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী; যা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী জমানায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি কয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব দুই মেয়ে ব্যতীত সপরিবারে নিহত হলে তখনকার মতো স্বাধীনতার চেতনার ধজাধারীরা খামোশ হয়। কিন্তু আবার তা ফিরে আসে শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার ক্ষমতা গ্রহণের দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৯ সালে। ভারতের সার্বিক সহযোগিতা ও মদদে শেখ হাসিনা সাড়ে ১৫ বছরে দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেন। এর পরিসমাপ্তি ঘটে চব্বিশের ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে। প্রকৃতপক্ষে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ভিত্তি সর্বভারতীয় সংস্কৃতির নানাপাশ থেকে জাতিকে মুক্ত করার দৃঢ় সঙ্কল্পজাত। আজকের বাংলাদেশের সাথে পশ্চিম বাংলা তথা ভারতের ভেদরেখা টানা হয়ে গেছে ৭৮ বছর আগেই। সাতচল্লিশের বাংলা ভাগ তার সত্যায়ন। এদেশে ইংরেজের উপস্থিতি এবং সেই সূত্রে হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্যবোধ ছিল এ সত্যের মূলে। সেই মন্ত্রবলে আজ বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। অন্যপক্ষে পশ্চিম বাংলা ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। যারা সর্বভারতীয় সংস্কৃতিতে তুষ্ট। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রথমে সাংস্কৃতিক বিভাজন এবং পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে স্পষ্টত ভিন্নপথ অবলম্বন দুই বাংলার জনগোষ্ঠীকে ভিন্ন গন্তব্যে নিয়েছে।

হতাশার হলো- স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো অনেকে বাঙালিয়ানার নামে কলকাতার হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির আধারে রাজনীতি করতে চান। তারাই সাতচল্লিশের বাস্তবতা ভুল প্রমাণে সচেষ্ট। এদের পুরোভাগে রয়েছেন বামপন্থীরা। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তাদের কর্মকাণ্ডে বিষয়টি দৃশ্যমান। তার একটি দৃশ্য মঞ্চায়ন হয়ে গেল সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে; ছাত্রশিবিরের ‘বর্ষা বিপ্লব’ উপলক্ষে একটি প্রদর্শনী ঘিরে। ছাত্রশিবির ফ্যাসিস্ট হাসিনা জমানায় বিচারিক হত্যার শিকার ছয় নেতার ছবি প্রদর্শন করে। এতে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন বাম ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এমন প্রদর্শনীর প্রতিবাদে কোমর বেঁধে নামেন। যদিও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তাদের সমর্থন হাতেগোনা। কৌতূহলোদ্দীপক হলো- উগ্র হিন্দু আদর্শে উজ্জীবিত সন্ত্রাসী কর্মী যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের উৎসর্গ করে রচিত গান ‘মুক্তির মন্দির সোপানও তলে/কত প্রাণ হলো বলিদান/লেখা আছে অশ্রুজলে’ বামপন্থীদের একটি প্রিয় দেশাত্মবোধক গান। এই গান তাদের উজ্জীবিত করে। তাই তো দেখা গেল, শিবিরের কর্মসূচির প্রতিবাদ করতে গিয়েও বামপন্থী ছাত্রকর্মীরা সমস্বরে গাইতে থাকেন উল্লিখিত গানটি। এ থেকে কারো অনুমান করা কঠিন নয় যে, বামদের শিকড় কোথায় প্রথিত। সর্বভারতীয় সংস্কৃতি যে তাদের ঠিকানা, বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি তা আর গোপন থাকে না।

তৌহিদবাদী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসীদের মনে রাখা দরকার, সর্বভারতীয় সংস্কৃতি প্যাগান কালচার; পৌত্তলিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। সঙ্গত কারণে এ কথা বলা অন্যায় হবে না যে, একটি স্বতন্ত্র শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ে না ওঠার পেছনে এদেশের বাম ধারার রাজনীতি অনেকটা দায়ী। বাংলাদেশের একেশ্বরবাদী জনগোষ্ঠীর এ কথাও মনে রাখা আবশ্যক, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি বহুদিন কলকাতা থেকে পরিচালিত হতো। এ থেকে স্পষ্ট, বামদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বন্ধন ও যোগসূত্র কোথায় রোপিত।

স্বাধীন বাংলাদেশেও বামপন্থীরা সর্বভারতীয় সংস্কৃতিতে সাচ্চা মুমিন। ‘পর সংস্কৃতিতে’ ঈমান আনলে যে স্বাধীন থাকা যায় না; এ বোধবুদ্ধি বামপন্থীদের না থাকলেও এদেশের তৌহিদি জনতার রয়েছে।