নয়া দিগন্তের দুই দশকের সম্পাদক

নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম আলমগীর মহিউদ্দিন
নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম আলমগীর মহিউদ্দিন |ফাইল ছবি

বাংলাদেশের সংবাদপত্র অঙ্গন সবসময় আলো-আঁধারির দ্বন্দ্বে আবৃত। এ দ্বন্দ্বের মাঝে কিছু মানুষ ছিলেন যারা একদিকে সাহসের সাথে পথ দেখানোর দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন আলমগীর মহিউদ্দিন, দুই দশকের বেশি সময় ধরে নয়া দিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এক নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক।

আলমগীর মহিউদ্দিন ছিলেন এমন একজন সম্পাদক, যিনি সংবাদপত্রকে শুধু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়; বরং বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন হিসেবে দেখতেন। তার কাছে সংবাদপত্র মানে ছিল জনমানুষের কণ্ঠস্বর, প্রান্তিকের আর্তি, রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন এবং সত্যের দিশারি। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘সত্য লেখা মানে শুধু তথ্য দেয়া নয়, সত্যকে সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড় করিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া।’

নয়া দিগন্তের পথচলার স্বপ্ন তৈরির প্রাথমিক সময়ে আলমগীর মহিউদ্দিনকে পত্রিকার হাল তুলে দেন পত্রিকাটির স্থপতি মীর কাসেম আলী। আলমগীর মহিউদ্দিন জীবনের শুরুটা পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পাইলট হিসেবে শুরু করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। পিতার চূড়ান্ত অসম্মতিতে ফিরে আসতে হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স অধ্যয়নকালে এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহরে তিনি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হন। ঢাকা ও করাচির বিভিন্ন সংবাদপত্রের সাথে স্ট্রিংগার হিসেবে তার কাজের শুরু। তখন মফস্বল সাংবাদিকদের থোক ভাতার বাইরে লাইনেজ হিসাবে সম্মানী দেয়ার বিধান ছিল সংবাদপত্রে। আলমগীর ভাই জানান, এভাবে যে আয় হতো তা একজন ক্যাডার সার্ভিসে চাকরিজীবীর মাসিক বেতনকে ছাড়িয়ে যেত।

সাংবাদিকতার সে সময়ের টান যুবক আলমগীর মহিউদ্দিনকে গণমাধ্যমের জগতে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়। এক পর্যায়ে তিনি রাজশাহী থেকে চলে আসেন ঢাকায়। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান-এপিপিতে যোগ দেন। এটি ছিল পাকিস্তান সময়ে সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রধান বার্তা সংস্থা। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এপিপি ও পিপিআইয়ের নেটওয়ার্ক একীভ‚ত করে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা গঠন করা হয়। শুরু থেকে তিনি বাসসের সাথে যুক্ত ছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আবার এ সংস্থার পরিচালনা বোর্ডের সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন। বাসসে রিপোর্টার হিসেবে কাজের সময় থেকে তিনি জাতীয় রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে রাজনৈতিক আলোচনা ও ঘটনাপ্রবাহ খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ছিল তার দৈনন্দিন কার্যক্ষেত্রের অন্যতম স্থান। এ সময়ে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীনসহ অন্য অনেকের গল্প তিনি নয়া দিগন্তের বিভিন্ন সভায় শুনিয়ে রিপোর্টারদের গাইড করতেন, কিভাবে খবরের অন্দরমহলে ঢুকে তথ্য বের করে আনতে হয়।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারা খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। রিপোর্টার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর বিট কভার করতে গিয়ে তিনি রাষ্ট্রের অনেক সংবেদনশীল বিষয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন। এ সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক ঘটনা তিনি গল্পচ্ছলে বর্ণনা করতেন রিপোর্টারদের সামনে। পরে বাসস থেকে যোগ দেন শেখ ফজলুল হক মনির মালিকানাধীন বাংলাদেশ টাইমসে। আলমগীর মহিউদ্দিন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে সম্মান ও মর্যাদার সাথে টাইমসে তিনি কাজ করেছেন। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও তিনি টাইমসে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। সেখানে বার্তা সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক এবং সর্বশেষ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এর পরে নিউ ন্যাশনে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করার পাশাপাশি আলমগীর মহিউদ্দিন নানা বিদেশী গণমাধ্যমেও কাজ করতেন। সাংবাদিকতার উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্স ব্রিটেনসহ অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। এ সময়ের অনেক অভিজ্ঞতার কথাও শোনাতেন তিনি। তার প্রতিটি গল্পের মধ্যে আনন্দ ও শিক্ষা দুটোর সংমিশ্রণ থাকত।

২০০৪ সালে মীর কাসেম আলী, শাহ আবদুল হান্নান, কমোডর আতাউর রহমান, অধ্যাপক আবু নাসের আবদুজ্জাহের যখন একটি গণমাধ্যম গ্রুপ এবং এর প্রথম প্রকাশনা হিসেবে দৈনিক নয়া দিগন্ত শুরুর পরিকল্পনা করেন, তখন তাদের প্রথম কাজ ছিল পত্রিকাটির সম্পাদক কে হবেন ঠিক করা। এর আগে পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে শামসুল হুদা এফসিএ ডিক্লারেশন-সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করেন। তাকে সব ধরনের সহায়তা করেন সাংবাদিক আবু তাহের মোস্তাকিম। সাংবাদিকদের টিম গোছানোর দায়িত্ব দেয়া হয় নির্বাহী সম্পাদক সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবরকে (বর্তমান সম্পাদক)। নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাতারা সর্বসম্মতভাবে আলমগীর মহিউদ্দিনকে সম্পাদক হিসেবে নির্ধারণ করেন। তখন তিনি নিউ ন্যাশন পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন। চার দশকের বেশি সময় ধরে ইংরেজি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত আলমগীর মহিউদ্দিন বাংলা সংবাদপত্রে কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন সেটি নিয়ে কারো কারো মধ্যে সংশয় ছিল। অচিরে এ সংশয় কেটে যায় যখন তিনি বাংলায় তার কলাম লেখা শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যে নয়া দিগন্তের পাঠকরা জনাব মহিউদ্দিনের সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় গভীর অন্তর্নিহিত বার্তাসমৃদ্ধ কলামের অনুরক্ত হয়ে পড়েন।

আশির দশকের মাঝামাঝি আমরা যখন দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন আলমগীর মহিউদ্দিন একজন মধ্যবয়সী চৌকস সাংবাদিক। তখন তিনি বাংলাদেশ টাইমসের বার্তা সম্পাদক। ৫০ সিসির একটি মোটরসাইকেল চালাতেন। দুপুরের দিকে তাকে দেখা যেত প্রেস ক্লাবে। আমরা সচিবালয়কেন্দ্রিক রিপোর্টারদের একটি গ্রুপ এ সময় সচিবালয়ের কাজ সেরে প্রেস ক্লাবে বা আশপাশে সময় কাটাতাম। আমাদের বন্ধু সাংবাদিক ফিরোজ আহমদ ছিলেন বাংলাদেশ টাইমসের রিপোর্টার। তখন আলমগীর ভাই আমেরিকান গণমাধ্যম ইউপিআইয়ের বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। ফিরোজ ভাই তখন রিপোর্টার হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি আলমগীর ভাইকে নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। ফিরোজ ভাই থাকতেন প্রেস ক্লাবের পাশে তোপখানা রোডের ফটোসাংবাদিক সমিতির অফিসের পাশের একটি কক্ষে। রুমটি ছিল আমাদের আড্ডার একটি জায়গা। তার মাধ্যমে আলমগীর ভাইয়ের সাথে কথা ও পরিচয়। এর প্রায় দুই দশক পরে দৈনিক নয়া দিগন্তে সম্পাদক হিসেবে পাই তাকে।

একটি নতুন পত্রিকার পথযাত্রায় চিফ রিপোর্টারের সাথে সম্পাদকের যোগাযোগ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রায় প্রতিদিন পত্রিকার রিপোর্ট নিয়ে কথাবার্তা হতো তার সাথে। পত্রিকার আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা শুরুর পর সপ্তাহের ছয় দিন সম্পাদকীয় সভা হতো। এ সভায় সভাপতিত্ব করতেন আলমগীর ভাই। তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ানসহ নানা পত্রিকার সাংবাদিকদের রেফারেন্স দিয়ে গল্প করতেন, কৌশল নিয়ে কথা বলতেন, কিভাবে পত্রিকাকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ করে তোলা যায়। নয়া দিগন্ত প্রকাশের পর অল্প সময়ের মধ্যে পত্রিকাটি সারা দেশে আলোচনায় চলে আসে। একপর্যায়ে এর প্রচার সংখ্য দুই লাখ ছাড়িয়ে যায়। মীর কাসেম আলীর পাশাপাশি শাহ আবদুল হান্নান ও কমোডর আতাউর রহমান নিয়মিত দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দিতেন সাংবাদিকদের। আর আলমগীর মহিউদ্দিন ও সালাহউদ্দিন বাবরের নেতৃত্বে আমরা এ টিম নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।

আলমগীর মহিউদ্দিন একদিকে আধুনিক সাংবাদিকতার কৌশল রপ্ত করেছিলেন, অন্যদিকে পুরনো ধারার অনুসন্ধানী ও মূল্যবোধভিত্তিক সাংবাদিকতা অটুট রেখেছিলেন। ফলে নয়া দিগন্ত দ্রুত শক্ত একটি অবস্থান তৈরি করে। সংবাদ নির্বাচন, সম্পাদকীয়, বিশেষ ক্রোড়পত্র- সবখানে ছিল পত্রিকাটির স্বাতন্ত্র্যের ছাপ।

আলমগীর মহিউদ্দিন ছিলেন নিরহঙ্কার, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে কঠোর শৃঙ্খলাবোধসম্পন্ন। তরুণ সাংবাদিকদের শেখাতেন- শুধু খবর লেখা নয়, খবরের ভেতরে থাকা ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বোঝার দায়িত্বও সাংবাদিকের। তার দরজা সবসময় সহকর্মীদের জন্য খোলা থাকত; কারো লেখা সংশোধন করতেন ধৈর্য ধরে, আর প্রশংসাও করতেন অকুণ্ঠচিত্তে।

সহজ-সরল জীবনযাপন, পেশার প্রতি আসক্তি এবং নিভৃত চিন্তাশীলতা ছিল তার বৈশিষ্ট্য। তিনি প্রমাণ করেছিলেন- একজন সম্পাদকের শুধু প্রশাসনিক দক্ষতা থাকলেই চলে না, ইতিহাসের গভীরতম বোধও তার থাকতে হয়। আলমগীর মহিউদ্দিন বিশ্বাস করতেন, সাংবাদিকতা কেবল পেশা নয়, একটি দায়বদ্ধতা। তার কলম কথা বলত শান্ত কিন্তু নির্ভীকভাবে, যদিও নানা সময় রাজনৈতিক চাপ, মালিকপক্ষের সীমাবদ্ধতা কিংবা রাষ্ট্রীয় বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তার পরও তিনি পত্রিকাকে নীতি ও আদর্শের একটি পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করেছেন।

২০০৮ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নয়া দিগন্ত বেশ অর্থনৈতিক চাপে পড়ে যায়। নয়া দিগন্তের প্রচার সংখ্যা অনুসারে আগে যেখানে ৫০-৬০ লাখ টাকা সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে আয় হতো, সেখানে এক পর্যায়ে তা নামতে নামতে লাখ টাকায় চলে আসে। মীর কাসেম সাহেব তার গতিশীল নেতৃত্বে নয়া দিগন্ত এবং এর সহযোগী আরেক প্রতিষ্ঠান দিগন্ত টিভির হাল ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। ২০১২ সালে এক মিথ্যা অভিযোগে ফ্যাসিবাদী সরকার তাকে গ্রেফতার করলে পত্রিকা আরেক দফা চাপে পড়ে যায়। এরপর ইঞ্জিনিয়ার ইস্কান্দর আলী খান ও জনাব শিব্বির মাহমুদ এর হাল ধরেন। অন্য পরিচালকদের সহযোগিতায় তারা পত্রিকাটিকে ধরে রাখেন। পত্রিকার আয় কমার সাথে সাথে সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা বকেয়া পড়তে থাকে। এর মধ্যে ২০২০ সালের করোনার আঘাত নয়া দিগন্তের জন্য সত্যিকার মহাবিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়ায়। এ সময়ে পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখার কঠিন কাজ তুলে নেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী হারুনুর রশীদ। তাকেও দীর্ঘ দুই মাস করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে থাকতে হয়। এ কঠিন সময়ে সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন সংবাদকর্মীদের পাশে ছায়ার মতো থেকে সাহস জোগান। বৈশিষ্ট্যগতভাবে ঠাণ্ডা, গভীর চিন্তা ও কৌশলী মানুষটির জীবনেও নেমে আসে বিপর্যয়।

ছয় দশকের মতো দাম্পত্য জীবনের সহধর্মিণীকে করোনা তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। আমরা যারা সম্পাদকের কিছুটা ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছি তারা জানতাম ভাবীর প্রভাব আলমগীর ভাইয়ের জীবনকে কতটা গভীরভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। ভাবী কর্মজীবনের শেষ দিকে ছিলেন নার্সিং ইনস্টিটিউটের পরিচালিকা। দুই মেয়ের মমতাময়ী মা। বরিশালের গৌরনদীর এক অভিজাত পরিবারের বড় মেয়ে- যিনি তার বিশাল পরিবারের ভাই বোন ও স্বজনদের অভিভাবকত্ব করতেন।

সহধর্মিণীকে হারানোর পর আলমগীর ভাই অনেকটা বদলে যান। আগে সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় দুপুরের খাবার গুছিয়ে দিতেন ভাবী। দিনে অন্তত কয়েক দফা খবর নিতেন। ভাবীর বিদায়ের পর তিনি জীবনের প্রতি খানিকটা উদাসীন হয়ে পড়েন। কখনো প্রেস ক্লাবে গিয়ে খেতেন, আবার খেতেও ভুলে যেতেন। নতুন করে আর লেখাও তার হয়ে উঠত না। তিনি দিনে একবার অন্তত বার্তাকক্ষে আসতেন। হালকা করে বলতেন খলিলীর কাছে আসি এক কাপ চা আর বিস্কুট খেতে। তখনো তার মুখে হাসি দেখা যেত, কিন্তু এর ভেতরে থাকত দীর্ঘশ্বাস। এ সময় আমরা মাসের কোন দিন কত বেতন পেতাম তা ঠিক হিসাব রাখতে পারতাম না। কিন্তু তা নিয়ে আলমগীর ভাইয়ের কোনো অনুযোগ শুনিনি। তিনি সরলভাবে ৫০০ টাকা হাজার টাকা লাগলে হিসাব বিভাগ থেকে নিতেন।

একদিন আলমগীর ভাই এলে আমি একটি বিশেষ সংখ্যায় লেখার জন্য অনুরোধ করি। একসময় বসলেই যার লেখা হয়ে যেত; সেই আলমগীর ভাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, এখন কলম হাতে নিয়ে বসলে আপনার ভাবীর চেহারা ভেসে ওঠে, আর লিখতে পারি না। এ মনোবেদনা তাকে এতটা গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে যে, তিনি একপর্যায়ে সব কিছু ভুলে যেতে থাকেন। চেয়ার থেকে উঠে সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করতেন আমি যেন কোথায় যাচ্ছিলাম। নিচে ড্রাইভার বাবুল গাড়ি নিয়ে হয়তো অপেক্ষা করছেন, তিনি হেঁটে রাস্তায় গিয়ে বাসে ওঠে গেছেন।

শেষের দিকে আলমগীর ভাইয়ের শারীরিক অবস্থা বাইরে যাওয়ার মতো আর ছিল না। তবু প্রেস ক্লাবে ও নয়া দিগন্তে না এসে তিনি থাকতে পারতেন না। আমরা ড্রাইভার বাবুলকে একা যাতে তিনি কোথায়ও না যেতে পারেন সে জন্য বলে দিয়েছিলাম। এর পরও মাঝে মধ্যে ব্যত্যয় ঘটে যেত। বাবুল পাশে কোথায়ও হয়তো আছেন, তিনি খুঁজে না পেয়ে বের হয়ে বাসে বা রিকশায় উঠে গেছেন। সবাই থাকার পরও ভাবীহীন শেষ চারটি বছর আলমগীর ভাইয়ের ছিল নিঃসঙ্গ। তিনি বড় মেয়ের সাথে মনিপুরি পাড়ায় নিজের ফ্ল্যাটে থাকতেন। তার ‘প্রিয়তমা’ ছিল নাতনী। ও পড়ালেখার জন্য কানাডায় চলে গেলে আলমগীর ভাই আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।

আলমগীর ভাই আজ আর নেই। তিনি রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি, অনেক কথা। পরম করুণাময় আলমগীর ভাই ও ভাবী দিলরুবা আক্তার- দুইজনকে আবার জান্নাতের বাগানে মিলিত হওয়ার সুযোগ দান করুন সে অনুনয় আজকের দিনে।

[email protected]