জুলাই বিপ্লব

আঞ্চলিক সম্পর্ক ও নতুন গতিপথ

জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে নতুনভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। লেনদেনভিত্তিক কূটনীতি থেকে বেরিয়ে এসে এটি এখন ন্যায্যতা, মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে দাঁড়াতে চায়। তবে আঞ্চলিক টানাপড়েন, বিশেষ করে ভারত-চীনের দ্ব›দ্ব মোকাবেলা করে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

কর্নেল (অব:) জাকারিয়া হোসেন

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক বাঁকবদল। এ আন্দোলন শুধু দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটায়নি; বরং দেশটির জাতীয় পরিচয় ও পররাষ্ট্রনীতিও পুনঃসংজ্ঞায়িত করেছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে কৌশলগতভাবে অবস্থিত বাংলাদেশ এখন নতুন আঞ্চলিক বাস্তবতায় ভারত ও চীনের দ্ব›দ্বময় প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেকে পুনঃঅবস্থান করছে। এর ফলে একদিকে যেমন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দরজাও খুলে গেছে।

দীর্ঘ সময় ধরে চলমান কর্তৃত্ববাদী শাসন, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সঙ্কট, জ্বালানি ঘাটতি, ব্যাংক খাতে তারল্য সঙ্কট এবং দমন-পীড়নজনিত ক্ষোভ একত্রিত হয়ে জুলাই বিপ্লবের অনুঘটক তৈরি করেছিল। এ বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি ছিল শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম, যারা বৈষম্য মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বাকস্বাধীনতা, সাম্য ও মর্যাদার নতুন নৈতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে। ফলে দেশটি ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছে।

এই বিপ্লব বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়কে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ছাত্র-যুবসমাজ ন্যায়বিচার, যোগ্যতার মর্যাদা ও গণতন্ত্রের আদর্শ সামনে এনে এক ধরনের নৈতিক পুনর্জাগরণের সূচনা করেছে। নাগরিক স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ন্যায্য কর্মসংস্থানের দাবি আজ জনজীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে। শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভূমিকারও নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় গণ-আন্দোলনের একটি অনুপ্রেরণামূলক মডেল হিসেবে এটি ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের নাগরিক সমাজকে আলোড়িত করছে।

কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন আর কেবল একটি শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকতে চায় না। বিগত সময়ে ভারতের প্রতি অতি-নির্ভরশীলতায় দেশটি সার্বভৌম মর্যাদার সঙ্কটে পড়েছিল। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ভারতের স্বার্থের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছিল, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে অনেকে ভারতের স্যাটেলাইট স্টেট হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। জুলাই বিপ্লব সেই অবস্থার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশকে আবারো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিচয়ে ফিরিয়ে এনেছে।

এখানেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের জটিলতা নতুন করে সামনে আসে। ভারতের কৌশলগত স্বার্থ ও বাংলাদেশের সার্বভৌম অবস্থান, এ দুইয়ের মধ্যে একটি টানাপড়েন অব্যাহত থাকবে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, বাণিজ্যে অ-শুল্ক বাধা এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের মতো ইস্যুগুলো এখন নতুনভাবে আলোচনায় আসছে। ভারতের প্রভাব খাটানোর প্রবণতা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকতে পারে, তবে বাংলাদেশের জনমত এখন একেবারে ভিন্ন। নাগরিকরা আর ভারতের একতরফা আধিপত্য মেনে নিতে প্রস্তুত নন।

অন্যদিকে, চীন খুব দ্রুত নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি নিছক কূটনৈতিক পদক্ষেপ নয়; বরং বেইজিংয়ের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশলগত চাল। বাংলাদেশ চীনা অবকাঠামোগত বিনিয়োগ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হয়েছে। পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর ও অন্যান্য প্রকল্প তার দৃষ্টান্ত। কিন্তু একই সাথে চীনের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলো ঢাকাকে সতর্ক করেছে যাতে বাংলাদেশ বেইজিংয়ের দিকে অতিরিক্ত ঝুঁকে না পড়ে। চীনা ঋণ, সামরিক সহযোগিতা কিংবা বঙ্গোপসাগরে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত জটিলতা বাড়াতে পারে।

এখন বাংলাদেশের সামনে বড় প্রশ্ন হলো- ভারত ও চীনের মধ্যকার প্রতিযোগিতার মধ্যে কিভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে। একদিকে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাবশালী শক্তি এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক প্রতিবেশী। অন্যদিকে, চীন বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্যতম প্রধান কুশীলব এবং বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বড় বিনিয়োগকারী। ফলে বাংলাদেশের জন্য সর্বোত্তম কৌশল হলো নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, বহুপাক্ষিক জোটে সক্রিয় থাকা এবং জোটনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে উভয়ের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা।

তবে ভারত ও চীনের টানাপড়েনের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিও কম নয়। ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে চাইবে, আর চীন অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি জোরদার করতে চেষ্টা করবে। এর ফলে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান আরো স্পর্শকাতর হয়ে উঠতে পারে। শুধু তাই নয়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা এবং সীমান্ত নিরাপত্তা ইস্যুতেও ভারত-চীনের ভিন্ন অবস্থান বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও একই ধরনের চাপ তৈরি হতে পারে। ভারত বাংলাদেশের রফতানি পণ্যে অ-শুল্ক বাধা তৈরি করতে পারে অথবা সীমান্ত বাণিজ্য জটিল করে তুলতে পারে। অন্যদিকে চীনের ওপর ঋণনির্ভরতা বাড়লে তা আর্থিক ঝুঁকি তৈরি করবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি নির্ভরতায় চীনের দিকে অতিরিক্ত ঝুঁকলে পশ্চিমা দেশগুলোর বাণিজ্যিক সুবিধা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কৌশল হওয়া উচিত- বাজার বৈচিত্র্যকরণ, নতুন অংশীদার রাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য চুক্তি এবং টেকসই বিনিয়োগ আকর্ষণ।

নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ঢাকায় নতুন নেতৃত্বের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে, সীমান্তে উত্তেজনা বাড়াতে পারে কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে। অন্যদিকে চীনের সামরিক সহযোগিতা বাড়ালে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের প্রতিক্রিয়া তীব্র হতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশকে সতর্ক কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এড়ানো যায়।

তবু, এ বিপ্লব বাংলাদেশের জন্য নতুন আকাক্সক্ষার পথ তৈরি করেছে। নাগরিক সমাজ এখন একটি সার্বভৌম, ন্যায়ভিত্তিক ও ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দেখতে চায়। ভারত থেকে পারস্পরিক সম্মান ও ন্যায্য পানি বণ্টন, চীনের কাছ থেকে দায়িত্বশীল বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর, মিয়ানমারের কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন এবং পাকিস্তানের সাথে নতুন বাস্তবতায় সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ- এসব বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতির অংশ হয়ে উঠেছে।

জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে নতুনভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। লেনদেনভিত্তিক কূটনীতি থেকে বেরিয়ে এসে এটি এখন ন্যায্যতা, মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে দাঁড়াতে চায়। তবে আঞ্চলিক টানাপড়েন, বিশেষ করে ভারত-চীনের দ্ব›দ্ব মোকাবেলা করে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। যদি বাংলাদেশ এ ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে, অভ্যন্তরীণ ঐক্য বজায় রাখতে পারে এবং বহুপক্ষীয় সহযোগিতায় সক্রিয় হয়, তাহলে জুলাই বিপ্লব দীর্ঘমেয়াদে শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়; বরং আঞ্চলিক নেতৃত্বেরও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।