জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি জেলার বিপরীতে একাধিক নির্বাচনী এলাকায় একজন রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়। নির্বাচন কমিশন এ নিয়োগ কার্যটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর অধীন সমাধা করে। রিটার্নিং অফিসারকে সহায়তা করতে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় একজন সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী এ যাবৎকাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে প্রশাসন ক্যাডারের জেলার দায়িত্বে নিয়োজিত জেলা প্রশাসক পদধারী কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে আসছে। সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ১৯৯০ সাল-পরবর্তী উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের নিয়োগ দিয়ে আসছে। যদিও গত দশম সংসদ নির্বাচনে কিছু নির্বাচনী এলাকায় থানা নির্বাচন অফিসারদের সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। সংসদ বহাল থাকাকালীন মৃত্যু বা অন্য যেকোনো কারণে সংসদ সদস্য পদ শূন্য হলে এরূপ একাধিক নির্বাচনে জেলা নির্বাচন অফিসারদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়ার নজির রয়েছে। এসব নির্বাচনে থানা নির্বাচনী অফিসারদের সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
রিটার্নিং অফিসার প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সরকারি অথবা বেসরকারি সংস্থার একজন কর্মকর্তাকে প্রিজাইডিং অফিসার, এক বা একাধিক কর্মকর্তাকে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং প্রতিটি ভোটকক্ষে একাধিক পোলিং অফিসার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এসব কর্মকর্তা নিয়োগ বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সরকারি অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সরকারি অথবা বেসরকারি হওয়া বিষয়টি অব্যক্ত।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান একটি বৃহৎ ও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। নির্বাচন কমিশনের সীমিত জনবল দিয়ে এ বৃহৎ ও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ কারণে নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের যেরূপ জনবলের প্রয়োজন হবে; নির্বাচন কমিশন দ্বারা অনুরুদ্ধ হলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেরূপ জনবলের ব্যবস্থা করবেন। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কোনো পৃথক নির্বাহী ক্ষমতা না থাকায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী তার কার্য সমাধা করেন।
সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত। সাংবিধানিক পদধারী হিসেবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা শপথের অধীন। শপথগ্রহণ ব্যতিরেকে তারা স্বীয় কার্যে আসীন হন না। শপথগ্রহণ করাকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি বলতে হয় তারা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং তাদের সরকারি কার্য ও সরকারি সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হতে দেবেন না।
আমাদের দেশে ইতঃপূর্বে দলীয় ও নির্দলীয় উভয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগে স্বীয় স্বাধীনতা পাশ কাটিয়ে সরকারের আকাক্সক্ষার প্রতিফলনে নিয়োগ কার্য সমাধায় সচেষ্ট থেকেছে। এ যাবৎকাল পর্যন্ত দলীয় ও নির্দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগে জেলা প্রশাসকের অন্যথা প্রত্যক্ষ করা যায়নি। জেলা প্রশাসকরা জেলায় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দলীয় ও নির্দলীয় উভয় সরকারের আস্থাভাজন। যেকোনো দলীয় বা নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জেলা প্রশাসকের কাছে দলীয় বা নির্দলীয় সরকারের কোনো আকাক্সক্ষা থাকলে তা পরিপূরণে তারা যে নির্বাচন কমিশনের চেয়ে সরকারের আকাক্সক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন; তা ইতঃপূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে প্রত্যক্ষ করা গেছে।
নির্বাচন কমিশন চাইলে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পরিবর্তে সরকারের অন্য যেকোনো বিভাগের কর্মকর্তাদের জাতীয় সংসদের নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে রিটার্নিং অফিসার অথবা সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। আবার কোনো একক বিভাগের পরিবর্তে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়েও এ দায়িত্ব পালনে কোনো বাধা নেই। কথাটি অনস্বীকার্য, সশস্ত্রবাহিনীসহ সরকারের কয়েকটি বিভাগ থেকে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হলে প্রতিটি বিভাগের মধ্যে একটি প্রতিযোগী ভাব কাজ করবে যে, কোন বিভাগ দায়িত্বটি সুচারুরূপে পালনে কতটুকু সফলতা দেখাতে পেরেছে। এ ধরনের প্রতিযোগী ভাব সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যে সহায়ক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পরবর্তী প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীরা দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে আনুষ্ঠানিক প্রতিদ্ব›িদ্বতায় অবতীর্ণ হন। বিভিন্ন প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী যেন নির্বিঘ্নে স্বীয় নির্বাচনী এলাকায় তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, সে বিষয়ে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব অপরিসীম। কিন্তু এ দায়িত্ব পালনে দেখা যায়, রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে; তাতে পুলিশ বাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র্যাব, আনসার বাহিনী, ব্যাটালিয়ন আনসার, বিজিবি ও কোস্টগার্ড আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। একদা প্রতিরক্ষাবাহিনীও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিল; কিন্তু নবম সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংশোধনী আনয়নপূর্বক প্রতিরক্ষাবাহিনীগুলোকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে বাদ দেয়া হয়।
এ কথা অনস্বীকার্য, নির্বাচনী আইন অনুযায়ী বর্তমানে যেসব বাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্তর্ভুক্ত সেসব বাহিনীর ওপর রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিভিন্ন নির্বাচনের সময় দেখা গেছে, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত এসব বাহিনীর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশনা পালনে যতটুকু না তৎপর তার চেয়ে বেশি তৎপর তাদের উপরস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা বাস্তবায়নে। এই সমন্বয়হীনতায় দেখা যায়, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কার্যকলাপের ওপর রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল। এ ধরনের শিথিলতায় একজন রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের পক্ষে নির্বাচনী এলাকার আইনশৃঙ্খলা সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়ক পর্যায়ে রাখা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়।
নির্বাচনকালীন নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত সব শ্রেণীর কর্মকর্তা নির্বাচনী কর্মকর্তা নামে অভিহিত। এ সময় তাদের চাকরি নির্বাচন কমিশনের অধীন ন্যস্ত বলে গণ্য হয়। নির্বাচনকালীন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা যেন মাঠপর্যায়ে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশনা মেনে কাজ করেন, তা নিশ্চিতের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে; কিন্তু অতীতের দলীয় ও নির্দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী স্বীয় দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে প্রার্থীর পক্ষাবলম্বন করলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কদাচিৎ এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ভবিষ্যতে যেকোনো নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ওপর বিশেষত রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার এবং সার্বিকভাবে নির্বাচন কমিশনের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ যেন প্রতিষ্ঠা পায়; তা নিশ্চিতের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ হলে কমিশন এবং রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের পক্ষে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। আর আইনশৃঙ্খলা রিটার্নিং অফিসার অথবা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণে না থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন যে ব্যাহত হবে, সে প্রশ্নে কোনো বিতর্ক নেই।
জাতীয় সংসদের যেকোনো সাধারণ নির্বাচনে প্রতিরক্ষাবাহিনীগুলোকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অংশ হিসেবে নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত করা হলে তা যে সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়ক এটি নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবার উপলব্ধিতে রয়েছে। তবে বিশেষ উদ্দেশ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংশোধনী আনয়নপূর্বক প্রতিরক্ষাবাহিনীগুলোকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সংজ্ঞা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। দেশের সচেতন জনমানুষ মনে করে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে সংশোধনী রদপূর্বক পুনঃপ্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সংজ্ঞার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক।
জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন প্রতিটি জেলার অন্তর্ভুক্ত নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ নির্বাচন কমিশনের পক্ষে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসাররা পালন করেন। একটি জেলার নির্বাচনের সার্বিক ফল সমন্বয়ের কাজ রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে সম্পন্ন হওয়া পরবর্তী রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক একটি নির্বাচনী এলাকা থেকে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ফল বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশনের বরাবর যা প্রেরিত হয় সচরাচর তা-ই চূড়ান্ত গণ্যে নির্র্বাচন কমিশন থেকে পুনঃবিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। অতঃপর এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলে একজন প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়া বিষয়ে সরকারিভাবে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। সুতরাং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব অপরিসীম। সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যক। নির্বাচনী আইনে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশবাসী আশা করেন, নির্বাচন কমিশন অতীতের ধারাবাহিকতার ব্যত্যয়ে স্বীয় উপলব্ধি থেকে উদ্ভাবনমূলক এমন কিছু করবেন, যা অতীতের গ্লানি অবসানে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতিবিশ্লেষক