নিরুদ্দেশ ভাবনা

আন্দোলনের মূলমন্ত্র- গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার এই চেতনায় জাগ্রত থাকার ভাবনারা নিরুদ্দেশ হতে পারে না।

মেহরপুরের মেহেরুন্নেসা খানম নতুন যেকোনো কিছুতে অগ্র-পশ্চাৎ ভাবার পক্ষপাতী। নিজের ধর্মবিশ্বাস, অনুধাবন ও আচার-আচরণ আকিদা পালনে নিরপেক্ষতার পদাবলি বয়ান করতে গিয়ে পারিপার্শ্বের অনেক কিছু তার ভাবনা থেকে উধাও হয়ে যায়, দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। মেহেরুন বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি বটে; কিন্তু নিজের ভাব-ভাবনায় পরিবেশ পরিস্থিতির অনেক কিছু তার অ্যান্টেনায় ধরা পড়ে। পাশের গ্রামে কী ঘটছে তার সংসারে তার প্রভাব প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকতায় না দেখে এর আগের-পিছের অনুষঙ্গগুলোতে চোখ বুলিয়ে দিব্যদৃষ্টিতে তিনি অনেক কিছু দেখতে পান।

‘সকাল বেলায় আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা’ মরমি শিল্পী আবদুল আলিমের গানের কলি নবাব সিরাজ উদদৌলার মর্মান্তিক পরিণতি বোঝানোতে বাজানো হয়েছিল সিনেমায়। এর মধ্যে অনেক কিছু উপলব্ধির উপাদান ছিল। প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে যা কিছু অস্বাভাবিক ঘটে তা যে বিধাতার ইচ্ছার প্রতিফলন, এ কথাটি অতিমাত্রায় ইহজাগতিকতায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকাদের মাথায় ঢোকে না। এটি প্রায়ই ঘটে। তার দেশে প্রতিটি পটপরিবর্তনে ঘটনাঘটনে অচিন্ত্যনীয় অস্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, এসবের পেছনে প্রকৃতির প্রতি অতি বাড়াবাড়ি বা সীমালঙ্ঘনের কার্যকরণগত সম্পর্ক বিদ্যমান এবং এসবই প্রভু নিরঞ্জনের তরফে তার নিয়ন্ত্রণে প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে আপতিত হয়।

সকালে মেহেরুন্নেসা যখন আল কুরআনের ৬৭ নং সূরা আল মুলক তিলাওয়াত করছিলেন, তখন সূরাটির ১৬-১৭ সংখ্যক আয়াতে আটকে যায় তার চোখ- ‘তোমরা কিভাবে নিশ্চিত হলে যে, আল্লাহ সহসা ভূমিকম্প সৃষ্টি করে তোমাদেরসহ জমিনকে ধসিয়ে দেবেন না? তোমরা কিভাবে নিশ্চিত হলে যে, আল্লাহ তোমাদের ওপর প্রলয়ঙ্করী কঙ্কর ঝড় বইয়ে দেবেন না? তখন তোমরা জানতে পারবে আমার সতর্কবাণী কত সত্য ছিল।’ মেহেরুন্নেসার মনে পড়ে, মানুষ নিজের জীবন নিয়ে কত না বড়াই করে, ফেলে আসা সময়ের উপর্যুপরি ভুলগুলো ভুলে গিয়ে, সামনের সময় নিয়ে কত কল্পনা ও পরিকল্পনার ছক আঁটে। ভাব-কল্পনায় কত রঙিন ফানুস ওড়ায়; কিন্তু কদাচিৎ ভাবে না, তার মনে পড়ে না, ‘হায় রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস’। মেহেরুন্নেসার এক নিকটাত্মীয় নিজেকে সুঠাম, সবল ভাবতেন। প্রচুর পসার ছিল তার। সুইমিং পুলে গোসলে নেমে আর উঠতে পারেননি। ঘুমানোর আগে কারোরই কি এমন মনে হয় না যে, ‘এই শোয়া’ আমার ‘শেষ শোয়া হবে’। প্রজাহিতৈষীর পরিবর্তে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতি দুরাচারে নিমগ্ন প্রতাপশালী রাজা ল²ণ সেন দুপুরে রাজসিক ভোজনরত অবস্থায় ইখতিয়ার উদ্দীন বিন বখতিয়ার খিলজির মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহীর খুরের শব্দ শুনেই ভয়ে প্রাসাদের পেছন দরজা দিয়ে নদিয়ায় পালিয়ে বাঁচেন। মেহেরুনদের আমঝুপি কুঠিতে বসে রবার্ট ক্লাইভ ঘসেটি বেগম, মীর জাফরদের সাথে শলাপরামর্শে মেতে ১৭৫৭ সালে বাংলা বিহার উড়িষ্যার সার্বভৌমত্ব দখলে নেয়। এর ২১৪ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সেই মেহেরপুরেরই বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। মেহেরপুরের মেহেরুন এ জন্য গর্ববোধ করেন। মেহেরপুর বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জেলা; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তার অবস্থান অতি উঁচুতে।

তাবত ঐশী গ্রন্থে মানুষকে সবসময় মৃত্যুর কথা মনে রাখতে বলা হয়েছে। তবে অতিসচেতন হওয়ার নামে সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে বসলে চলবে না। সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণে রাখার অর্থ- নিজেকে সচল, সতেজ ও সজীব রাখা, নিজের আত্মমর্যাদা বজায় রেখে ও রাখতে দায়িত্ব সচেতন থাকা। এ জন্য তো আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন, অগ্র-পশ্চাৎ ভাবার, অনুধাবনের তাগিদ দিয়েছেন। প্রকৃতি তার পসার সাজিয়ে সামনে বসে আছে। তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হবে প্রাণবন্ত থাকার জন্য। সবকিছুর ওপর মানুষের বড় দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো আল্লাহর সৃষ্ট জীবের প্রতি সদয় আচরণ, পরোপকার। বাইবেল ও ত্রিপিটক বলছে- ‘তুমি কারো প্রতি অসদাচরণ করলে তুমি তার কাছ থেকে খারাপ ব্যবহারই পাবে। আর তুমি যদি সদয় হও, প্রতিদানে তুমিও সদয় ব্যবহার পাবে।’ আমরাই আমাদের শত্রু সাজি, আমরা প্রতিহিংসায় ভুগে নিজেরাও পরস্পরের প্রতিহিংসার শিকার হই। একজন রাষ্ট্রনায়ক রাষ্ট্রের সব নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করবেন, দলমত নির্বিশেষে সবার প্রতি সমান আচরণ করবেন। রাষ্ট্র বা সরকার পরিচালনার শপথ নেয়ার সময় এ জন্য উচ্চারণ করতে হয়, ‘রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কারো প্রতি ভিন্ন আচরণ করব না’। অথচ ক্ষমতায় আসীন হয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে- সেখানে জনগণ হয়েছে প্রতিপক্ষ। তাদের দমানোর জন্য, বিদ্রোহ দমনের জন্য, শত্রুকে ফাঁসানোর জন্য নিজেই সৃষ্টি করা পথ-পন্থার প্যাঁচে নিজেকেই পড়তে হয়েছে। নিকট এবং অতীত ইতিহাসে রয়েছে তার এন্তার প্রমাণ। এই পরিণতি ‘সৃষ্টির সেবা, স্রষ্টার ইবাদত’ এই ধ্যানধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এটি শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, গণহত্যার শামিল। এই অপরাধ থেকে কেউই রেহাই পায় না। জাগতিক বিচারব্যবস্থা বা প্রতিকার পদ্ধতি ব্যর্থ হলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবেই।

মেহেরুন তার দেশ ও সমাজে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির প্রসঙ্গ উঠলে দেখতে পান, বিগত ৫৪ বছরে বাংলাদেশের অর্জন একেবারে কম না হলেও যতটা হওয়ার সম্ভাবনা ও সুযোগ ছিল, ততটা হয়নি। স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সক্রিয় ছিল। প্রায় পাঁচ দশক সময় অতিক্রান্ত হলেও গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তিতে দাঁড়িয়েছে, বাস্তবতার আলোকে তা বলার সময় আসেনি। সহনশীলতা, ধৈর্য, সবার জন্য আইনের সমপ্রয়োগ নিয়ে এখনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ মেলে। সঙ্ঘাত-সহিংসতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে এখনো বেরিয়ে আসা যায়নি। জনগণ এখনো রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করেন। নাগরিকদের আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধ চেতনা গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন উদ্বেগ ও শঙ্কামুক্ত, ঐকমত্যের বলীয়ান শক্তির। প্রয়োজন আস্থাবান ও সততার নেতৃত্বের।

স্বাধীনতা অর্জনে বেশি প্রয়োজন সংগ্রাম ও শক্তির। আর স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন প্রযুক্তি, কৌশল, ঐক্য ও ন্যায়বোধ। এ ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষায় জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা ও সৎ বিবেচনা কাজে লাগানো অপরিহার্য। জনগণ যথেষ্ট সচেতন ও সঙ্ঘবদ্ধ না হলে স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য স্বাধীনতার মর্যাদা দিতে হয় এবং সদা সতর্ক থাকতে হয়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের এই মৌল চেতনায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে অনুপ্রাণিত হওয়ার বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল এক রক্তক্ষয়ী সর্বাত্মক জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এ লড়াই, এ বিপুল আত্মত্যাগ নিছকই একটি ভূখণ্ড, জাতীয় সঙ্গীত, পতাকা বা মানচিত্রের জন্য ছিল না। সুদীর্ঘকাল শোষণ ও বঞ্চনার, বৈষম্য ও বৈরিতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের জন্য এমন একটি রাষ্ট্রকাঠামো পেতে চেয়েছিল, যা কতগুলো সুনির্দিষ্ট আদর্শ ও মূল্যবোধ ধারণ করবে। নাগরিকদের মধ্যে সেগুলো নির্বিঘ্ন চর্চার পরিসর তৈরি করবে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে সেসব আদর্শ ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না বলে পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে টেকেনি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইতিহাসে একটি অনন্য ও অভিনব বাস্তবতা তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য এক দিকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে অভিষিক্ত করে, অন্য দিকে নতুন রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল হিসেবে পাওয়া সেসব আদর্শ ও মূল্যবোধ চর্চার এক কঠোর দায় আরোপ করে এবং অবারিত সম্ভাবনার সুযোগ করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ তাই একাধারে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের সমাপ্তি এবং আরেকটি আত্মমর্যাদা লাভের দীর্ঘ লড়াইয়ের সূচনা। সেই ভাবনার সূত্র ধরেই চব্বিশের জুলাই নতুন করে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নতুন করে দেখার প্রত্যয় লাভ ঘটে। মেহেরুন ভাবেন, এর মধ্যে কোনো ফাঁকফোকর থাকার কথা নয়, আর তাই যদি হয় তা হলে ধরে নিতে হবে- তাদের প্রিয় বাংলাদেশ গড়ার ভাবনারা নিরুদ্দেশের পথে। মনে রাখতেই হচ্ছে, এখনো দিকে দিকে শকুনিরা নিঃশ্বাস ফেলছে। চিহ্নিত একটি মহল যেভাবে এ দেশকে সাম্রাজ্যবাদীদের ঘাঁটি বানাতে চায়, তেমনি অন্য একটি গোষ্ঠী এ দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্তে লিপ্ত। অথচ জুলাই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল কিন্তু শুধু স্বৈরাচারের পতন নয়; গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, মানুষের মৌলিক অধিকার ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা তথা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। দেশ এগিয়ে যাক সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনুশীলনের দিকে। মেহেরুন মনে করেন, জুলাই বিপ্লবের অর্জনকে কোনোভাবেই ম্লান হতে দেয়া যাবে না। অর্জিত অধিকারকে অধিকতর অর্থবহ করে তুলতে দলমত নির্বিশেষে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, শান্তি ও সমৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের জন্য কাজ করে যেতে হবে। আন্দোলনের মূলমন্ত্র- গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার এই চেতনায় জাগ্রত থাকার ভাবনারা নিরুদ্দেশ হতে পারে না।

লেখক : অনুচিন্তক