বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন : আগামীর বার্তা

বামপন্থী ও সেকুলার গোষ্ঠী মুখে গণতন্ত্র ও প্রগতির কথা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তথাকথিত মুক্তচিন্তার চারণভূমি করে রেখেছিল। তাদের কথিত মুক্তচিন্তার দর্শন হচ্ছে মূলত ইসলামবিরোধিতা। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামপন্থী ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পাওয়ায় সবচেয়ে মনোকষ্ট পেয়েছে সেকুলার গোষ্ঠী।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ চারটি প্রধান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০-৪০ বছর পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলো। এটি পরিষ্কার যে, অতীতের সরকারগুলো দলীয় সঙ্কীর্ণ স্বার্থ বিবেচনায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে দেয়নি। এবারে সব নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ জন্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি ও তার প্রশাসনকেও প্রশংসা করতে হয়। সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পাওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী ও তাদের সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলোর। কারণ তারা যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তথা সহনশীলতা ও সহযোগিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে; তা এককথায় নজিরবিহীন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে হিংসাত্মক কার্যকলাপের বহু কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছে। সেখানে জুলাই অভ্যুত্থানের শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছেন। চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটিতে একটিও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ছাত্রদের মধ্য থেকে জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটিতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিপুল বিজয় সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। যে সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে একদম কোণঠাসা অবস্থায় ছিল, শিবির পরিচয় মানে নিশ্চিত মৃত্যু, নির্যাতন বা পুলিশি মামলার শিকার হওয়া। হাসিনা জমানায় সংগঠনটির বহু নেতাকর্মী ভিন্ন মতাবলম্বী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে নিহত বা নির্যাতিত হয়েছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে ছাত্রশিবির অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি শুধু ছাত্রলীগ নয়, ছাত্রদল ও অন্যান্য সেকুলার ছাত্র সংগঠন সবাই মিলে ছাত্রশিবিরকে কোণঠাসা করে রাখতে জোট বেঁধেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন ছিল শিবিরের জন্য নিষিদ্ধ। আওয়ামী সরকার ৫ আগস্টের কয়েক দিন আগে জামায়াতে ইসলামীর সাথে ছাত্রশিবিরকেও নিষিদ্ধ করেছিল। বহুমুখী চাপ সত্তে¡ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সবার সাথে মিলেমিশে লড়াই চালিয়েছেন। অবশেষে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছে।

১৯৭২ সালে ডাকসুতে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল জয়লাভ করেছিল। এরপর দু-একবার ছাত্রলীগ জিতেছিল। ১৯৭৯ সালে মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে জাসদ ছাত্রলীগ জয়লাভ করে। নব্বই দশকে আমানউল্লাহ আমানের নেতৃত্বে ছাত্রদল প্যানেল বিজয়ী হয়। দীর্ঘদিন পরে ২০১৮ সালে নুরুল হক নুর ভিপি হন। কিন্তু ভিপিসহ দুটো পদ ছাড়া অন্য পদ ছাত্রলীগ দখল করে নিয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল বিভিন্ন সময় বিজয়ী হলেও ছাত্রশিবির কখনো প্রতিদ্ব›িদ্বতায় আসতে পারেনি। অবশ্য ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল জসীমউদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে ভিসিহ বেশ কিছু পদে বিজয়ী হয়েছিল। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ছাত্রশিবির যে ঢাকাসহ চারটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করল, তা সবাইকে অবাক করেছে।

এবারে আমরা পর্যালোচনা করে দেখি, কী কী কারণে ইসলামী ছাত্রশিবির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলোতে একচেটিয়া বিজয় পেয়েছে।

এক. ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের যে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তা এখন সবার কাছে পরিষ্কার। বিশেষ করে সম্মুখসারিতে না থেকেও নেপথ্যে কৌশল নির্ধারণ ও জনশক্তি সরবরাহ করে আন্দোলন বেগবান করেছিল। এটি সহজে বোধগম্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে যেসব ছাত্র সংগঠন জড়িত ছিল তাদের মধ্যে শিবির ছিল সাংগঠনিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী। শিক্ষার্থীদের অপরিসীম সাহসিকতা দেখে সর্বস্তরের জনগণ আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের পতনে ছাত্রশিবিরের সক্রিয় অংশগ্রহণকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বীকৃতি দিয়েছেন। তারা যে ক্যাম্পাসে মজলুম ছিল তাও শিক্ষার্থীরা দেখেছেন। আবার প্রতিবেশী ভারত শিবিরকে মেনে নিতে পারে না বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এসব বিষয় শিবিরকে শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

দুই. ছাত্রশিবির ১৯৭৭ সালে গঠিত হওয়ার পর মাত্র কয়েকটি বছর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে নির্বিঘেœ কাজ করতে পেরেছিল। আশির দশক থেকে বাম ও সেকুলার ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের প্রতিহত করতে শুরু করে। এরপর শিবিরের বহু নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের হাতে হতাহত হন। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা এতটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে, স্বাভাবিক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেনি। তবে শিবিরের কাজের যে ধরন তার সাথে অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনের মিল নেই। অন্য সংগঠনগুলো সাধারণত রাজনৈতিক বা শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া নিয়ে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করে থাকে। তাদের নেতাকর্মীরা নিজেকে গঠনে নিত্যকার কোনো কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত থাকে না। কিন্তু শিবিরের দৈনন্দিন অনুসরণীয় কর্মসূচি থাকে, যা করতে প্রকাশ্যে করা জরুরি নয়। যেমন- আল কুরআন বা বইপুস্তক অধ্যয়ন, নামাজ পড়া, অন্যদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো বা ইসলামের আলোকে চরিত্র গঠন ইত্যাদি নীরবে করা সম্ভব। সুতরাং শিবির প্রকাশ্য রাজনৈতিক বা ইস্যুভিত্তিক কর্মকাণ্ড চালাতে না পারলেও সাংগঠনিক কাজকর্ম অব্যাহত রাখতে পেরেছে। তা ছাড়া গোপনে কাজ করার মধ্যে যে একটি অ্যাডভেঞ্চার থাকে তা তরুণদের সহজে প্রলুব্ধ করে। অধিকন্তু তাদের বিরুদ্ধে সরকার ও প্রতিদ্ব›দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ড সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহানুভূতি সৃষ্টি করেছে। এভাবে বহুসংখ্যক শিক্ষার্থীর কাছে শিবিরের নেতাকর্মীরা তাদের দলীয় আহ্বান নিয়ে পৌঁছাতে পেরেছেন। ফলে তাদের সমর্থক-বলয় বেড়েছে।

তিন. আমাদের সমাজে চার দিকে নৈতিক অবক্ষয়ের একটি অপ্রতিরোধ্য প্রবাহ লক্ষ করা যায়। এর সাথে বিশেষ করে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার, যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, র‌্যাগিংসহ বিভিন্ন অপরাধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জেঁকে বসেছিল। এসব অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণে স্বভাবত সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ফ্যাসিবাদ পতনের পর এরূপ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ আকুতি ছিল আরো প্রবল। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী নৈতিকতার মানদণ্ডে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় ছিলেন না। পক্ষান্তরে, ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা নৈতিকতার দিকে দিয়ে বেশ উচ্চমার্গে থাকায় তারা সহজে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের বিনয়ী ও নিরাপদ হিসেবে সহজে বিবেচনা করেন। ফলে দৃশ্যত পোশাক-পরিচ্ছদে আধুনিকা মেয়েরাও ছাত্রশিবিরের প্যানেলকে ভোট দেন। সুতরাং এটি সহজে বলা যায়, নৈতিক শক্তি ও আকর্ষণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শিবিরের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

চার. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছিল। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কম-বেশি অনুরূপ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। অতীতে কোনো ছাত্র সংগঠন বা নির্বাচিত ছাত্র সংসদের উদ্যোগে এরূপ কর্মসূচির দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই। ফলে তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে দারুণরকম ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। লক্ষণীয়, অতীতে বিজয়ী ছাত্র সংসদের নেতারা শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচির পরিবর্তে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। পক্ষান্তরে, ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বাধীন সংসদ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেছে। তারা যদি এরূপ নীতি অব্যাহত রাখতে পারে তাহলে তারা জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারবেন বলে আশা করা যায়।

পাঁচ. ছাত্রশিবিরের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলা। এ লক্ষ্য সামনে রেখে সংগঠনটির নেতাকর্মী সবাই অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গঠনে মনোনিবেশ করেন। ফলে বহু মেধাবী শিক্ষার্থীকে দেখা যায় শিবিরের নেতৃত্ব দিতে। মেধাবী নেতৃত্বের প্রতি তার সহপাঠীদের একটি আলাদা আকর্ষণ থাকে। ষাট-সত্তর দশকে ছাত্র ইউনিয়নে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী দেখা যেত। পরবর্তীতে জাসদ ছাত্রলীগেও মেধাবীদের সমাবেশ ঘটেছিল। শুরুতে ছাত্রদলেও কিছু মেধাবী নেতৃত্ব চোখে পড়ত। ছাত্রশিবিরে শুরু থেকে মেধাবীদের সংযুক্তি লক্ষ করা যায়। তাই ছাত্রশিবিরের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন বৃদ্ধির এটিও একটি কারণ।

ছয়. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত সচেতন এবং লেখাপড়ার সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দাবি নিয়ে ছাত্রলীগ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল। পাশাপাশি কমিউনিজম ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বুলি ছাত্র-তরুণদের একসময়ে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ পুঁজিবাদী ধারার রাজনীতি করলেও তরুণদের সমর্থন পেতে ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘সেকুলার’ মতবাদ গ্রহণ করে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ইমেজে জনপ্রিয়তা পায়। সময়ের পরিক্রমায় সমাজতন্ত্রের আবেদন নিঃশেষ হয়ে গেছে। ছাত্রলীগ নতুন কোনো আদর্শ নিয়ে সামনে এগোতে পারেনি। ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ উভয়ে অনৈতিক ও সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে; যা সংগঠন দু’টির জনপ্রিয়তা কমার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্য দিকে আদর্শিক ও নৈতিক শক্তি নিয়ে ছাত্রশিবির নেতাকর্মীরা উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশে নিজেদের সবার সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হন। এ ছাড়া সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের আবেদনও আগের মতো কাজ করছে না।

সাত. আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- বিগত ৫৪ বছরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে ইসলামোফোবিয়ার যে একটি ভয়ের সংস্কৃতি ঠাণ্ডামাথায় গড়ে তোলা হয়েছিল, এর কারণে সত্যিকার অর্থে মুক্তচিন্তার পরিবেশ ব্যাহত হয়েছিল। জুলাই বিপ্লবের পর এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও অগ্রগতি হয়েছে। এখন তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিবাদের কথা যেমন শোনা যায় না, তেমনি সেকুলারদের দাম্ভিকতাও চোখে পড়ে না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চায় ধীরে হলেও অগ্রগতি হচ্ছে। অন্য দিকে বিশ্বব্যাপী ইসলামোফোবিয়ার প্রাবল্যও কমে এসেছে। এরূপ প্রেক্ষাপটে দেশের আধুনিক শিক্ষার অগ্রসর প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুক্তচিন্তার পরিবেশ উন্নতি লাভ করছে। এর প্রভাব পড়েছে ছাত্রশিবিরের কর্মতৎপরতায়।

আট. জেন-জি বা ডিজিটাল যুগের এ প্রজন্মের চিন্তাচেতনা অনেক বেশি প্রগতিশীল। তারা স্বাধীনচেতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতে বিশ্বাসী এবং উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল মনোভাবাপন্ন। তারা এমন এক যুগের নাগরিক যারা মুহূর্তে দুনিয়ার এক প্রান্তের খবর আরেক প্রান্তে পেয়ে যান। অনেক কাজ তারা দ্রুত করতে পারেন। তারা গোঁজামিল পছন্দ করেন না- এক কথায় স্ট্রেইট কাট। এ প্রজন্মের ভাবনা ও মনমানসিকতা না বুঝতে পারলে তাদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হবে, এটি স্বাভাবিক। আমাদের মনে হয়, অনেক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী তরুণ হলেও বৃহত্তর তরুণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি; যে কারণে শিক্ষার্থীদের চাহিদামতো বয়ান ও কর্মসূচি সামনে তুলে ধরতে পারেননি। পক্ষান্তরে, ছাত্রশিবিরের নেতৃত্ব তরুণদের স্বপ্ন উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং তাদের বয়ানও সেরূপ আকর্ষণীয়। অন্য সংগঠনের নেতারা যেখানে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে মুখ্য বয়ান দিয়েছেন, সেখানে ছাত্রশিবির শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল কর্মসূচি তুলে ধরেছে, যা তাদের বিজয় সহজ করে দিয়েছে।

নয়. গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি একটি মৌলিক উপাদান। একটি সমাজে বসবাসকারী সবাইকে সমান অধিকার ও মর্যাদা দেয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য, যা সংবিধানে বিধৃত থাকে। বিষয়টি সব রাজনৈতিক সংগঠন বা ছাত্র সংগঠনেও প্রতিফলিত হওয়া দরকার। ছাত্রশিবির যেহেতু একটি ইসলামী সংগঠন, সেহেতু তারা অন্য ধর্মের অনুসারীদের ব্যাপারে কী নীতি ও আচরণ করে, তা ছিল একটি বড় প্রশ্ন। ছাত্রশিবির অন্য ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের এবং আধুনিকা নারী শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে যে প্যানেল দিয়েছে, তা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং তাতে তাদের উদারনীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এরূপ উদারনীতির কারণে শিবির সম্পর্কে অনেকের ধারণায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে; যা তাদের বিজয় ত্বরান্বিত করেছে।

একটি বিষয়ে বহুলভাবে আলোচিত হচ্ছে, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলের কোনো প্রভাব পড়বে কি না। পড়লে কতটুকু পড়তে পারে- ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল; কিন্তু তখন অনুষ্ঠিত ডাকসু ভোটে বিজয়ী হয়েছিল ছাত্র ইউনিয়ন। তাদের মূল সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টি বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কোনো দিন ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নও দেখেনি। কারণ তারা পার্লামেন্টে দু-চারটির বেশি আসন পায়নি। তাদের সংগঠনও তেমন শক্তিশালী ছিল না। আবার ১৯৭৯ সালে মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে জাসদ ছাত্রলীগের ডাকসুতে বিজয়ী হলেও তাদের মূল রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কখনো ক্ষমতায় যাওয়ার মতো শক্তি অর্জন করতে পারেনি। অন্য দিকে ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তখন ছাত্রলীগ ডাকসুতে জিতেছিল। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় পায়।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদল আমানউল্লাহ আমানের নেতৃত্বে ডাকসুতে জয় পায়। এর পরের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। এবারে কী ঘটতে পারে। এখানে দুটো বিষয় লক্ষণীয়। এক. কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হচ্ছে এবং দুই. রাষ্ট্রক্ষমতায় যে দল আছে তাদের জনপ্রিয়তার পর্যায়টা কী। এবারের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে ২০২৪ সালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে, যখন সবাই একটি গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা নিয়ে ভোট দিয়েছেন। ভোটাররা দেখেছেন, গণ-অভ্যুত্থানে কার কতটুকু ভূমিকা ছিল। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রভাব খাটায়নি। তাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল না। এরূপ প্রেক্ষাপটে এটি বলা যেতে পারে, গণ-অভ্যুত্থানের পর যখন দেশবাসী একটি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার প্রত্যাশা করছেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটি আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠনের পক্ষে ভোট দিয়ে সবাইকে এ বার্তা দিয়েছেন যে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এ মুহূর্তে তারা সবচেয়ে উপযুক্ত। সুতরাং দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের পছন্দ ও সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কমবেশি পড়বে।

বামপন্থী ও সেকুলার গোষ্ঠী মুখে গণতন্ত্র ও প্রগতির কথা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তথাকথিত মুক্তচিন্তার চারণভূমি করে রেখেছিল। তাদের কথিত মুক্তচিন্তার দর্শন হচ্ছে মূলত ইসলামবিরোধিতা। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামপন্থী ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পাওয়ায় সবচেয়ে মনোকষ্ট পেয়েছে সেকুলার গোষ্ঠী।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইসলামপন্থী সংগঠন ছাত্রশিবিরের বিজয় এটি ইঙ্গিত দেয়, এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাম ও সেকুলারদের তথাকথিত মুক্তচিন্তার অজুহাতে ‘ইসলামোফোবিয়া’ প্রতিহতের নামে অসহিষ্ণুতা ও দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটল। এখন প্রকৃত অর্থে মুক্তচিন্তার অভয়াশ্রম হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সব মত ও পথের সবাই নিজ নিজ অবস্থানে বিচরণ করবে মানবিক মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক সহনশীলতার আবহে।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব