প্রায়ই ভাবি, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে যে শিক্ষকতায় কাটিয়ে পঁচাত্তরোর্ধ জীবনের এ বাঁকে পৌঁছেছি সে পেশাটির আজ এমন বিবর্ণ চেহারা কেন? কেনই বা আজ শিক্ষক বলতে অশ্রদ্ধা আর অবহেলার ভাব চলে আসে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে মনের মধ্যে অবচেতনভাবে যেন বেজে উঠে জনপ্রিয় গানের কলি- ‘পথের মাঝে পথ হারালে আর কি পাওয়া যায়?’ হ্যাঁ, আমাদের শিক্ষকসমাজ সত্যি আজ যেন এক পথহারা পথিকের মতো।
জীবনের শুরুতে আমি যখন ১৯৫৭ সালে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন প্রাইমারি স্কুলের আমাদের একজন শিক্ষক যিনি সবার কাছে জনপ্রিয় লতিফ মাসসাব (লতিফ মাস্টার সাহেব) নামে পরিচিত ছিলেন, তার পড়ানোর ঢঙে আমরা সবাই খুব অভিভূত ছিলাম। একজন শিক্ষক একটি হাফ শার্ট ও লুঙ্গি পরে খালি পায়ে ক্লাসে ঢুকেন। ঢুকে পড়ানো শুরু করে দেন গল্পোচ্ছলে, হাতে কোনো বই নেই, কাগজ নেই। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন, কখনো কিছু বলে হাসাচ্ছেন, আবার কখনো মন্ত্রমুগ্ধের মতো চমৎকৃত করছেন। কী বাংলা, কী ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান সর্বত্র তার সমান পদচারণা। সাবলীলভাবে পড়িয়ে যাচ্ছেন, কী গল্প করছেন বোঝার উপায় নেই। আমরা শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। ক্লাসে শুধু নয়, অন্যত্র অন্য উপলক্ষেও যার উল্লেখ আমি আরো একটি লেখায় করেছিলাম। মনে পড়ে, আমরা ১৯৫৯ সালে প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় সুদূর রামগঞ্জ (বর্তমানে ল²ীপুর জেলায়) থেকে পরীক্ষাকেন্দ্র নোয়াখালী জেলা সদর মাইজদী যাওয়ার পথের একটি অংশ নৌকায় যাচ্ছিলাম। পাশাপাশি দু’টি নৌকার একটিতে আমার বাবা (তখনকার শিক্ষা অফিসার) অন্যটিতে লতিফ মাসসাবের সাথে আমরা পাঁচজন বৃত্তি পরীক্ষার্থী ডাকাতিয়া নদী পাড়ি দিচ্ছিলাম। এ নদী যাত্রার পাঁচ-ছয় ঘণ্টা সময়ের মধ্যে যতক্ষণে অন্য নৌকায় একজন মাঝি আমাদের দুপুরের খাবার রান্না করছিলেন ততক্ষণে স্যার আমাদের বৃত্তি পরীক্ষার বাংলা, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল ও স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান বিষয়গুলো এমন চমৎকারভাবে দুইবার মুখে মুখে রিভিশন করিয়ে দিয়েছিলেন যে, আমাদের বৃত্তি পরীক্ষায় আর কোনো বেগ পেতে হয়নি। স্যারের পড়া শিখিয়ে দেয়ার এমন মনকাড়া ঢঙে এতই অভিভূত হয়েছিলাম যে, এ কচিমনে সে দিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, জীবনে যদি কিছু হই তবে শিক্ষক হবো। আজ জীবনের এ প্রান্তে দাঁড়িয়ে হলফ করে বলতে পারি, সে দিনের সে সিদ্ধান্ত আমাকে পরবর্তীকালে শিক্ষকতায় টেনে নিয়ে যায়।
তবে শিশুকালে শিক্ষক হওয়ার সিদ্ধান্তটি পরবর্তীকালে ঘটনাপ্রবাহে আরো ডালপালা ছড়াতে থাকে। আমি যখন প্রাইমারি শিক্ষা শেষে ১৯৬০ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই তার অল্প ক’দিনের মাথায় হেড মাস্টার স্যারের তলব পেয়ে তার কক্ষে যাই। তিনি আমাকে দেখে বললেন, তুমি প্রাইমারি স্কলারশিপ পরীক্ষায় ডিস্ট্রিক্টে ফোর্থ হয়েছ। এখন আগামী ক্লাস সিক্সের এমই স্কলারশিপ পরীক্ষায় ডিভিশনে ফার্স্ট হতে হবে। এ জন্য আমি প্রতিদিন টিফিন পিরিয়ডে তোমাকে গণিত করিয়ে দেবো। তুমি যাদবের পাটিগণিত বইটি সংগ্রহ করো। হেডমাস্টার স্যার যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট গোল্ড মেডালিস্ট এবং কালিনারায়ণ স্কলার তার মতো এমন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি যখন আমার মতো পুচকে একটি ছেলের এমন দায়িত্ব নিলেন, আমি আনন্দে কী যে করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। যাদবের পাটিগণিত যুগ যুগ ধরে অবিভক্ত ভারতে নাইন-টেনে অর্থাৎ ম্যাট্রিক পরীক্ষার সর্বোচ্চ স্ট্যান্ডার্ড পাঠ্যবই। অনেক খোঁজাখুঁজি করে বইটি পেয়ে গেলাম। ক্লাস সিক্সে পুরো মোটা বইটি স্যার আমাকে করিয়ে দিলেন। এমই স্কলারশিপে সত্যি চট্টগ্রাম বিভাগে ফার্স্ট হলাম। এমনকি পরবর্তীতে অষ্টম শ্রেণীর জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষাতেও চট্টগ্রাম বিভাগে ফার্স্ট হই। যাদবের পাটিগণিত সমাধান করায় এসএসসি পর্যন্ত স্কুল ও বোর্ডের প্রতিটি পরীক্ষায় গণিতে ১০০ নম্বরের কম আর কখনো পাইনি। শুধু প্রধান শিক্ষক নন, আমাদের প্রত্যেক শিক্ষক ছিলেন এমনই। আমাদের হেডমৌলভি স্যারকে দেখতাম প্রতিদিন টিফিন পিরিয়ডে স্কুল থেকে মসজিদে যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে থেকে প্রত্যেক ছাত্রের নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়া নিশ্চিত করতেন। কী অভাবনীয় দায়িত্ব নিষ্ঠা। কোথায় পাব আজ এমন নিঃস্বার্থ দরদি শিক্ষক?
স্কুলের মতো কলেজে (চট্টগ্রাম কলেজ ১৯৬৫-৬৭) এসেও পেয়েছি লিজেন্ডারি সব অনুকরণীয় শিক্ষককে। নাট্যকার মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন আমাদের বাংলার শিক্ষক। আর বাংলা বিভাগীয় প্রধান ছিলেন বাংলার আকাশের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র সাহিত্যক পণ্ডিত ড. আলাউদ্দিন আল আযাদ। দু’জনের পিরিয়ডে থাকত আমাদের ক্লাসভর্তি উপস্থিতি। মমতাজ স্যার তো হাসিয়ে সবার পেট ব্যথা করে দিতেন। হাসতে হাসতে বলতেন, জানো আমি কেন আজ এমন গল্প করে সময় কাটালাম? আসলে আমি আজ ক্লাস প্রিপেয়ার করে আসতে পারিনি। পরে ঘরে গিয়ে দেখতাম সে দিনের গদ্য/কবিতাটি তিনি পুরো পড়িয়ে দিয়েছেন। দেশ সেরা সাহিত্যিক ‘বব’ এর লেখক জনাব আবু রুশদ মতীন উদ্দিন আমাদের পড়াতেন ইংরেজি কবিতা। অত্যন্ত সুদর্শন ও দীর্ঘকায় এ শিক্ষক ছিলেন আমাদের চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ। পরে হয়েছিলেন শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক। তখন অধ্যক্ষরা ক্লাস নিতেন। আজকাল প্রিন্সিপাল সাহেবরা আর ক্লাস নেয়ার সময় পান না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও (১৯৬৭-৭১) আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন বিজ্ঞান জগতের এক এক মহীরুহ। আমাদের রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন পাকিস্তানের ‘সেরা বিজ্ঞানী পদক’ প্রাপ্ত মরহুম শ্রদ্ধেয় প্রফেসর মোকাররম হোসেন খোন্দকার। তিনি কত বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তার প্রমাণ হলো শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিজ্ঞান অনুষদ কমপ্লেক্সের’ নামকরণ করা হয় একাত্তরে লোকান্তরিত এ আইকনিক শিক্ষকের স্মরণে ‘মোকাররম হোসেন সায়েন্স ভবন কমপ্লেক্স’। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভিসি ও সাবেক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সিএসআইআরের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম শিক্ষা কমিশনের সভাপতি প্রফেসর মফিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন আমাদের অতিপ্রিয় জৈব রসায়ন শিক্ষক; যার ‘শিক্ষাদানের ঢং’ নকল করে আমরা পরবর্তীতে হয়েছি এক একজন শিক্ষক। আমি নিজে, আমার সহপাঠীরা নাট্যকার-কথাসাহিত্যিক ড. হুমায়ূন আহমেদ, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আলাউদ্দিন, বিশ্বখ্যাত পরিবেশবিজ্ঞানী আমেরিকার ক্যালটেকের শিক্ষক ড. আতিক রহমান এবং আরো অনেকে। আমাদের এসব কালজয়ী শিক্ষকরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছেন।
৩৩ বছরের কর্মজীবনে শিক্ষকতার শেষ পর্যায়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান, নায়েমের মহাপরিচালক বা এনটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও শিক্ষকতাকে আমি মন-প্রাণ দিয়ে উপভোগ করেছি। আর তাই তো এ পেশার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে অবসরের পর ধারাবাহিকভাবে কখনো সামরিক বাহিনী পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়-এমআইএসটির ভিজিটিং প্রফেসর, আবার কখনো বা এডিবি অথবা ওর্য়াল্ড ব্যাংকের শিক্ষা/কারিকুলাম সম্পর্কিত প্রজেক্টে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছি। এর পাশাপাশি আশির দশক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর রসায়ন পাঠ্যপুস্তক রচনা করে চলছি। শিক্ষা আর শিক্ষকতাকে মন-প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসি বলে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সব কিছুতে আমার আজ অবধি এত বিচরণ। কারণ, আমার মধ্যে যে বিশ্বাসটি কাজ করে তা হলো- ‘এ টিচার নেভার রিটায়ারস’- এর মধ্যে যখন এ দেশের শিক্ষক নামধারী কারো স্খলনের সংবাদ পত্রিকায় পড়ি; তখন মনে খুব কষ্ট পাই। একটি নয়, দু-তিন-চারটি নয়। অসংখ্য সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে এ সম্পর্কে। এই সে দিন দেখলাম পঞ্চগড় সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে তার কাছে গণিতে টিউশন নিতে আসা নবম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে জনতা ধরে পুলিশে দিয়েছে। আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন্যান্স বিভাগের এক শিক্ষক তার এক ছাত্রীর সাথে একটি খালি কক্ষে আপত্তিকর অবস্থায় ছাত্রদের হাতে ধরা পড়েছেন। এক পত্রিকার দীর্ঘ রিপোর্টে বেরোলো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীকে এক শিক্ষকের হয়রানির খবর। বিশ্ববিদ্যালয় কেন, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে এক স্কুলের হেড মাস্টার উপবৃত্তি দেয়ার কথা বলে তৃতীয় শ্রেণীর শিশুশিক্ষার্থীকে গোপনকক্ষে ডেকে নিয়ে যা করলেন তা পুরো জাতির মথা হেট করে দেয়। এটি শুধু এখানে ওখানে নয়, রীতিমতো মহামারী আকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু দিন আগেও কি আমরা দেখিনি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তার অধীনে গবেষণারত ছাত্রীকে যৌন হয়রানির দায়ে চাকরি হারিয়েছেন? ভাবতে অবাক লাগে, এসব ব্যক্তি শিক্ষকতা করতে কেন আসেন?
ইদানীংকালে শিক্ষকদের নৈতিক স্খলনের আরো একটি দিক উন্মোচিত হয়েছে। বিগত শাসনামলে গণরুম সংস্কৃতির চারণক্ষেত্র বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি পেটোয়াবাহিনীর আয়নাঘরে পরিণত হয়েছিল। আর তার সহযোগী ছিল শিক্ষক নামধারী কিছু ব্যক্তি। কল্পনা করা যায়, কোনো শিক্ষার্থী আক্রান্ত হয়ে টেলিফোন করলে প্রক্টর নামক মহামানবদের কোনো সাড়া পাওয়া যেত না। শুধু কি তাই? আমরা তো ভুলে যাইনি যে, বিগত ডাকসু নির্বাচনকালে রোকেয়া হলের প্রভোস্ট সে হলের এক অসহায় ছাত্রীর অভিভাবককে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে গভীর রাতে সাভার থেকে এসে তার মেয়েকে হল থেকে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। কী পাষণ্ড! অথচ এ কাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের দলদাস ভিসি কোনো অন্যায় দেখেননি। দেখবেন কী করে? তিনি তো ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে তার শিক্ষার্থীদের পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। লজ্জা হয় ভেবে যে- এসব প্রক্টর, প্রভোস্ট, ভিসি- এরা সবাই নাকি শিক্ষক! যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এমন সব শিক্ষক নামধারীদের আনাগোনা। ভাবুন তো একবার এরাও শিক্ষক আর স্বাধীনতাপূর্ব কালে আমরা পড়েছি যাদের কাছে প্রফেসর মোকাররম হোসেন খোন্দকার, প্রফেসর মফিজ উদ্দিন আহমদ (জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি), প্রফেসর মতীন চৌধুরী (সাবেক ভিসি, ঢাবি), প্রফেসর শামসুল হক (সাবেক ভিসি, ঢাবি) অথবা আমাদের সময়ের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক কবীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক রাজ্জাক, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী (ভিসি, ঢাবি), প্রফেসর ইন্নাস আলী (সাবেক ভিসি, বুয়েট) প্রমুখ তারাও শিক্ষক- যেন রীতিমতো এক একজন ধ্রুবতারা, শিক্ষার বাতিঘর।
সে সময় দেশব্যাপী আরো কয়েকজন ইতিহাসখ্যাত শিক্ষক ছিলেন। একজন হলেন চাঁদপুরের অজোপাড়াগাঁয়ের মতলব হাই স্কুলের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হেডমাস্টার ওয়ালী উল্লাহ পাটোয়ারী। সারা দিন স্কুল পরিচালনা এবং ক্লাস নেয়ার পরও তিনি বিদ্যুৎবিহীন মতলবের অন্ধকার গ্রামীণ পথ বেয়ে হারিকেন হাতে ঘুরে ঘুরে দেখতেন তার ছাত্ররা পড়ালেখা করছে কি না, প্রয়োজনে কাউকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছেন তো আবার কাউকে শাসনও করছেন। কী অসাধারণ দায়িত্ববোধ! স্কুলের ফলও ছিল বোর্ড সেরা। প্রতি বছর মেধা তালিকায় কেউনা কেউ থাকত। তাদের একজন ছিলেন পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে ইস্ট পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ডের ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করা আব্দুল মতিন পাটোয়ারী, বুয়েটের সাবেক ভিসি। ঘটনাক্রমে তিনি ছিলেন ওয়ালি উল্লাহ পাটোয়ারী স্যারের জামাতা। দেশের প্রত্যন্ত বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকার কোণে শিক্ষার আলো ছড়ানো এ মহাপ্রাণ শিক্ষক একাধিকবার দেশসেরা শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এমন আর একটি স্কুল ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা শঙ্কর হাইস্কুল। এ স্কুলের মহাপ্রাণ শিক্ষকদের নাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে স্কুল থেকে ১৯৬০ সালে ইস্ট পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ডে প্রথম হয়েছিলেন এ দেশের ইতিহাসে সেরা ছাত্রদের একজন মাহবুব হোসেন খান। তিনি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে বিএসসি (অনার্স) ও এমএসসি উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। অক্সফোর্ডে পিএইচডি করতে গিয়ে খুব ৎবষঁপঃধহঃষু লন্ডন কেন্দ্রে পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিস (সিএসএস) পরীক্ষা দিয়ে তাতেও ফার্স্ট হয়ে গেলেন। আবার পিএইচডি করেও দেশে ফিরে ঢাবিতে শিক্ষকতায় যোগ দেন। পরে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে চলে যান। এসব মেধাবী শিক্ষার্থীর পেছনের কারিগর ছিলেন মহতী শিক্ষকরা। যেসব কিংবদন্তি শিক্ষকদের কথা বললাম সেগুলো আজ অন্য গ্রহের কাহিনী বলে মনে হবে।
দুর্ভাগ্য এ দেশের। এসব মহীরুহসম ব্যক্তিত্ব আর শিক্ষকের অভাবে আমাদের শিক্ষার আকাশে আজ ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা। গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, কখনো চলছে প্রশ্নফাঁস আর নকল প্রবণতা, কখনো কোচিং দৌরাত্ম্য, কখনো পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে কনটেন্ট চুরি, আবার কখনো বা পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে দুর্নীতি। তবে সব কিছু ছাপিয়ে পীড়াদায়ক বিষয় হলো- দক্ষ, মেধাবী এবং দায়িত্ববোধসম্পন্ন শিক্ষকের আকাল। কেন যেন লম্পট, দুশ্চরিত্র, নীতিজ্ঞান বর্জিত, মূল্যবোধের লেশমাত্র নেই এমন কিছু লোকজন আজ শিক্ষকতার চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়ছে। আর ঢুকে নেমে পড়ছে দলবাজি আর নৈতিক ও চারিত্রিক স্খলনের প্রতিযোগিতায়। তাই শিক্ষার প্রতিটি স্তরে কর্তব্যপরায়ণতা, নিষ্ঠা, নৈতিকতা, সততা ও দক্ষতায় ক্রমাগত ধস চলছে। তা না হলে যেখানে শোনা যায় হাইস্কুল আর কলেজে শিক্ষকের কাছে কোচিং না করলে পরীক্ষায় ভালো নম্বর দেন না, সেখানে অবাক হয়ে দেখলাম স¤প্রতি খোদ রাজধানী শহরে ফ্রি টিউশনের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস শেষে শিক্ষার্থী প্রতি নির্দিষ্ট হাদিয়ায় কচি বাচ্চাদের কোচিং গ্রহণ এক প্রকার বাধ্যতামূলক। কী অদ্ভূত!
জবাবদিহি না থাকলে যা হয়। আগে সারা জীবন দেখে এসেছি স্কুল ইন্সপেক্টর এবং শিক্ষা অফিসাররা প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিনিয়ত স্কুল পরিদর্শন করতেন; যাতে শিক্ষকরা অনুপস্থিত না থাকেন বা নিয়মিত পড়ালেখা হয়। আজকাল শিক্ষা অফিসাররা স্কুল পরিদর্শনে যান না, তারা অফিস করেন। সারা জীবন অধ্যাপনা করে এবং শেষ পর্যায়ে শিক্ষা বিভাগের উঁচুপদে টেক্সটবুক বোর্ডের চেয়ারম্যান ও নায়েমের মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করে শিক্ষা বিভাগের আদ্যোপান্ত নখদর্পণে থাকার পরও বুঝতে পারি না শিক্ষা অফিসারদের অফিসে কী কাজ?
আজ সারা বিশ্বে যেখানে স্কুলের কচি শিক্ষার্থীরাও এআই নিয়ে রীতিমতো মাতামাতি করছে, সেখানে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের কোচিং থেকে নোট সংগ্রহ করে মুখস্থ করায় ব্যস্ত। আর তাই তো বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলকভাবে শিক্ষার গুণগত মান যে হারে বাড়ছে আমাদের দেশে ঠিক একইভাবে কমছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এবং আমাদের কুরআন শরিফেও আছে, বিভিন্ন যুগে এক এক জাতি এক এক সময়ে এক এক কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার কেন যেন ভয় হচ্ছে আমরা সে দিকে এগোচ্ছি কি না। তাই আমাদেরও অনেক বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকার, সমাজ, ব্যক্তি- সবার সম্মিলিত উদ্যোগে কেবল বাস্তবসম্মত একটি শিক্ষাকাঠামো এবং অবশ্যই দৃঢ় হাতে শিক্ষার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ গড়ে তুলে এ জাতিকে রক্ষা করতে হবে।
ব্যক্তিগত সুখ-শান্তি পদদলিত করে আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে শিক্ষার ধারণা সৃষ্টিকারী মহান শিক্ষাগুরু সক্রেটিস, এরিস্টোটল ও প্লাটো শিক্ষার যে দীপশিখা জ্বালিয়েছিলেন সেটি পথ দেখিয়ে মানবজাতিকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। সুতরাং আমরাও যেন এ পথ থেকে ছিটকে না যাই। আমাদের আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আন্তরিক, নির্লোভ এবং কর্মঠ একটি শিক্ষকসমাজ যারা আমাদের অগ্রজদের মতো বিনিময় প্রত্যাশী হবেন না, কেবল দিয়ে যাবেন অকাতরে। আর তাতে আলোকিত জাতি গঠনের পথে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। আশার কথা হলো- এ আকালের মধ্যেও মাহরীন চৌধুরীর মতো ধ্রুবতারাসম শিক্ষকের জন্ম হয় আমাদের এ সমাজে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড



