অন্তর্বর্তী অসময়

নিরাশ আঁধারে আশার আলোর মতো এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে প্রতিভাত হবে বলে আশা করা যায়। এই মুহূর্তে শতধাবিভক্ত বাংলাদেশের রাজনীতি একটি সুনির্দিষ্ট ও ঐক্যবদ্ধ বলয়ে প্রবেশ করবে বলে জনগণ মনে করে। অন্তর্বর্তীকালীন অসময়ের অবসান তখনই ঘটবে, যখন বাংলাদেশে সফল নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে।

সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এটি চিরন্তন সত্য। সময়ের মাঝেই অতিক্রান্ত হয় জনজীবন। দৃষ্টির অগোচরে ঘটে যায় অনেক ঘটন-অঘটন। আবার কোনো কোনো ঘটন-অঘটন ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রসারিত হয়, প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের এই সময়টিতে ঘটছে এমনই ঘটন-অঘটন যা নাগরিক সাধারণকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। আবার কোনো কোনো ঘটনা আশার আলো ছড়ায়। জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তীকালে এতসব ঘটনা ঘটছে, যার হদিস নেয়া কঠিন।

হাসিনা স্বৈরাচারের পতন থেকে আরেকটি নির্বাচিত সরকার পর্যন্ত সময়কে আমরা বলছি অন্তর্বর্তীকাল। একটি অন্তর্বর্তী সরকার দেশটি পরিচালনা করছে। নৈতিকভাবে দেখতে গেলে এই সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের দরদভরা সমর্থনপুষ্ট। কারণ জনগণ তাদের রক্তের বিনিময়ে এই সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়টি প্রফেসর ইউনূস সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এটি রাজনৈতিক সরকার না হওয়ার ইতিবাচক দিক আছে। সেটি হলো কোনো রকম ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠীর জন্য সরকার কাজ না করে আপামর জনগণের জন্য কাজ করছে। ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ এ রকম একটি মহৎ দৃষ্টিভঙ্গি এই সরকারের রয়েছে। আবার ক্ষমতাপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দলগুলোর জন্য এই সরকার অনুক‚ল নয়। তারা তাদের দলের জন্য কোনো কাজ করছে না। সাধারণভাবে সামগ্রিকভাবে ও আইনানুগভাবে এই সরকার অনেক শক্তিশালী। কিন্তু দলবাজরা বা ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই সরকারকে অবাধ স্বাধীনতা, অবাধ সুযোগ দিতে নারাজ। সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে একশ্রেণীর অনৈতিক ও বিবেকবর্জিত মানুষ যারা সরকারের নিরপেক্ষতাকে দুর্বলতা মনে করছে। সব সমাজেই কিছু বিপজ্জনক লোক থাকে। তারা পরিস্থিতির সুযোগ নেয়। বাংলাদেশের জনমনস্তত্ত্ব তথা চারিত্রিক বিষয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিদ্বজ্জনের অভিমত সুখকর নয়। প্রাচীন কালের একজন ইবনে বতুতা এবং বর্তমানের একজন আকবর আলি খান জনগণের মানসিক অবস্থান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ব্যক্ত করেছেন।

বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যক্তিকে বেশি বিশ্বাস করে। শক্তিশালী নেতা, ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব কিংবা ‘রক্ষক’-এর খোঁজ জনমনস্তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এর পেছনে দুর্বল প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং আইনের শাসনের ঘাটতি বড় ভূমিকা রেখেছে। একই সাথে এ দেশের জনগণ অত্যন্ত সহনশীল ও অভিযোজনক্ষম। দারিদ্র্য, দুর্যোগ ও সঙ্কটের মধ্যেও তারা টিকে থাকার কৌশল রপ্ত করেছে। তবে এই সহনশীলতাই অনেকসময় প্রতিবাদহীনতায় রূপ নেয়, যা ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের জনমনস্তত্ত্বে আবেগ রাজনীতির প্রভাব প্রবল। যুক্তির চেয়ে পরিচয়, স্মৃতি ও প্রতীক এখানে বেশি কার্যকর। ফলে রাজনৈতিক বিভাজন অনেকসময় যুক্তিনির্ভর না হয়ে আবেগনির্ভর হয়ে ওঠে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিগত ১৬ মাসের যদি হিসাব-নিকাশ নেয়া হয় তাহলে জনগণের দিক থেকে বিরূপ মনোভাবই প্রাধান্য পাবে। নৈতিকভাবে জনসমর্থনপুষ্ট এই সরকার দাবি আদায়ের ও আন্দোলনের যে প্লাবন দেখেছে, তাতে মনে হয় না যে, মানুষগুলো বিবেক ও বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। কোনো একটি বিপ্লব বা আন্দোলনে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের বাইরে কিছু মানুষ থাকে যারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এরা লুটপাট ও সহিংসতা প্রদর্শন করে। স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছর ৫ আগস্ট যখন হাসিনার স্বেচ্ছাচারের কার্যালয়ে জনতা প্রবেশ করে তখন কিছু লোক পলায়নপর পরিস্থিতির কথা জানার পরও ভাঙচুর করে। চ্যানেলগুলোর পর্দায় দেখা গেছে, লোকজন সরকারি অফিসের সবকিছু বগলদাবা করে অথবা মাথায় নিয়ে সটকে পড়ছে। পাইকারি লুটপাটের পরদিন যখন ফেরত দেয়ার আবেদন জানানো হয় তখন কেউ কেউ কিছু জিনিসপত্র ফেরত দিয়ে যায়। তবে তা লুটপাটের তুলনায় সামান্যই।

এ ঘটনা ও জনচরিত্র দ্বারা আমরা মন্তব্য করতে পারি, লুটেরা লোকজন স্বাভাবিক নয়। তারা রীতিমতো অপরাধপ্রবণ। প্রাথমিক পর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লোকজন সম্পর্কে মানুষের ভালো ধারণা ছিল। প্রফেসর ইউনূস ও তার উপদেষ্টামণ্ডলী সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও পরবর্তীকালে যেসব খবর বেরিয়েছে তাতে মানুষের হতাশা বেড়েছে। মধ্যবর্তী কিছু রাজনৈতিক অরাজনৈতিক দালাল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। আমলাতন্ত্রের পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ে যে অভিযোগ এসেছে, তা উড়িয়ে দেয়ার নয়। কোনো কোনো উপদেষ্টার পিএস, এপিএসের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান অসত্য বলছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন একটি অসময় পার করছে। বিপদাপদ ও বাধাবিপত্তি তার পিছু ছাড়ছে না।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আশা করা গিয়েছিল, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটবে। রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিকার উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে নির্বাচন কার্যক্রমে ব্যাপৃত হয়ে পড়বে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার এক দিন পর যে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভূমিকম্পের মতো। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র, তেজদীপ্ত বীর তরুণ, ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন। অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন।

এ ঘটনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য অসম্ভব বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করে। প্রধান উপদেষ্টা একটি ইতিবাচক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। কিন্তু হাদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞানের প্রকাশ ঘটে তা অকল্পনীয় ও অভাবনীয়। জনগণের যে ক্ষোভ ও ক্রোধ প্রকাশিত হয়েছে তা অলঙ্ঘনীয়। যে জন-আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিজ্ঞা হাদির মৃত্যুতে প্রকাশিত হয়েছে তা রাজনৈতিক দলনির্ভর নয়। তবে অবশ্যই তা একটি আদর্শকেন্দ্রিক। এখন সে আদর্শকে কেন্দ্র করে শত্রুমিত্রের যে বিভাজন ঘটছে তাও রীতিমতো বিব্রতকর।

এসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা রীতিমতো দুষ্কর। হাদি পক্ষের আন্দোলনে যে বিস্ফোরণ লক্ষ করা গেছে তার অতি আবেগে আক্রান্ত হয়েছে সংবাদপত্র। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না। এই হামলায় রহস্যজনকভাবে উসকানিদাতা তৃতীয় পক্ষের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে। এখন বিষয়টিকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের মোক্ষম অস্ত্রে পরিণত করার পাঁয়তারা করছে বিরোধী পক্ষ। পতিত ফ্যাসিস্টদের অবস্থানও স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের যে অংশ বিগত বছরগুলোতে দ্ব্যর্থহীনভাবে হাসিনা স্বেচ্ছাচারকে প্রকাশ্য সহযোগিতা দিয়ে গেছে, সেই অংশ আত্মপ্রকাশ করার সাহস দেখাচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে পতিত ফ্যাসিস্টদের প্রভু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশের সৃষ্টি করছে। ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক সবচেয়ে নিম্নপর্যায় অতিক্রম করছে। বাংলাদেশ সরকার যেখানে তার নাগরিকদেরকে অনেক দূর থেকেই হাইকমিশন অভিমুখ যাত্রায় বাধা দিচ্ছে, সেখানে দিল্লি ও কলকাতায় বাংলাদেশ হাইকমিশন হামলার সম্মুখীন হচ্ছে। ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক বিগত ৫৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অধ্যায় অতিক্রম করছে। এটি কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অভ্যন্তরীণভাবে এবং বৈদেশিকভাবে খারাপ সময় অতিবাহিত করছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো কিছু অভ্যন্তরীণ ঘটনা ও দুর্ঘটনা সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেছেন, বাংলাদেশ এখন একটি ট্রানজিশনাল প্রসেস পার করছে। এর মধ্যেই কিছুসংখ্যক ব্যক্তি ও মহল অন্তর্বর্তীকালীন সময়কে বাধাগ্রস্ত করার জন্য ভয়ঙ্করভাবে চক্রান্ত করছে। বিএনপি মহাসচিব আরো বলেন, ভয়াবহ ফ্যাসিস্ট শাসন আমাদের সব মূল্যবোধ ধ্বংস করে দিয়েছিল, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেই ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে বেরিয়ে এসে আমরা এখন একটি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি। একটি নির্বাচিত সরকার ও নির্বাচিত পার্লামেন্ট দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নেবে, এ প্রত্যাশা আমরা সবাই করছি। মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, এই পিরিয়ডে সরকারের ব্যর্থতার কারণে আইনশৃঙ্খলার যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার অন্তত এই কয়টি মাস যোগ্যতার পরিচয় দেবে এবং এফিসিয়েন্সির সাথে দেশ পরিচালনা করবে। এভাবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করছে।

নিরাশ আঁধারে আশার আলোর মতো এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে প্রতিভাত হবে বলে আশা করা যায়। এই মুহূর্তে শতধাবিভক্ত বাংলাদেশের রাজনীতি একটি সুনির্দিষ্ট ও ঐক্যবদ্ধ বলয়ে প্রবেশ করবে বলে জনগণ মনে করে। অন্তর্বর্তীকালীন অসময়ের অবসান তখনই ঘটবে, যখন বাংলাদেশে সফল নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে।

লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]