দেশ ভাগের পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু মহাসভার সাথে জাতীয় কংগ্রেসের গাঁটবন্ধন থাকলেও আরএসএসএস সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তা সেই ১৯৪৭-৭৭, মাঝখানে বামপন্থীদের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার বা ১৯৭২-৭৭ ফের কংগ্রেসের জমানা, ১৯৭৭-২০১১ সাল পর্যন্ত বাম জমানার ৩৪ বছরে আরএসএস সেভাবে মাথা তুলতে পারেনি। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে পালাবদল (তৃণমূল) বা ২০১৪ সালে ভারতে মোদির নেতৃত্বে তিন তিনবার বিজেপির ক্ষমতায় আসাটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে আরএসএস শক্তিশালী হয়নি, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও আরএসএস চরচর করে বাড়ছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের তখত-ই-তাউসে ২০২১ সালে বিজেপি বিরোধী দলের মর্যাদা পাওয়ার পর বাংলাদেশেও আরএসএসের মাটি শক্তিশালী হয়েছে। তারও আগে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে তিন থেকে ১৮ আসনে পৌঁছানোর পর আরএসএস শুধু পশ্চিমবঙ্গেই শক্তিশালী হয়নি, বাংলাদেশেও আরএসএসএস তার শক্তিশালী সাংগঠনিক শক্তিকে বৃদ্ধি করেছে।
২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমবঙ্গে যেখানে ছিল আরএসএসের শাখা ৪০০, এখন তা বেড়ে হয়েছে ছয় হাজার। অন্যান্য শাখা মিলে তা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এটি একটি অবাক করার মতো ঘটনা। আর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের আমলেই দ্রুতগতিতে আরএসএসসহ হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বা সঙ্ঘপরিবার বেড়েছে চরচর করে। বাংলাদেশে আরএসএসের কো-অর্ডিনেটর হলেন কিশোর সরকার, প্রণব দেবনাথ ও পঙ্কজ দেবনাথ এবং রাজেশ নাহা। এরা বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাথে কমবেশি যুক্ত। প্রণব দেবনাথ ও পঙ্কজ দেবনাথ আরএসএসের সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন বলে অভিযোগ। রাজেশ নাহা বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু যুব জোটের সাধারণ সম্পাদক। এদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হলো ঢাকার ১৯ নম্বর জয়কালী মন্দির রোড। ঢাকা মহানগর কার্যালয় হলো, এয়ারপোর্ট সুপার মার্কেট, বিজয় সরণি, ঢাকা। ওই বিজয় সরণিতে অবস্থিত বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের অফিসও। এদের নেতা হলেন সুকৃতি কুমার মণ্ডল যিনি ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সোস্যাল সায়েন্সে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী ও ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি। ঢাকার ফার্মগেটের কাছে মনিপুরীপাড়ায় তার ব্যক্তিগত অফিস। তিনি ‘এইবেলা’ নামে একটি সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক ও বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে লেখেন। একসময়ের প্রবল প্রতিপত্তিশালী হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতা আইনজীবী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ও রানা দাশগুপ্ত বা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য উষারতন তালুকদারসহ অনেকেই প্রকাশ্যে বা তলে তলে আরএসএসসহ সঙ্ঘপরিবারের সাথে যুক্ত কম বেশি। আইনজীবী মিঠুন চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ মাইনোরিটি পার্টি (বিএমপি) তৈরি হয়েছে কার ইশারায়?
আমরা যেমন জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলদেশ টিম (এবিটি), জামাতুল মুজাহিদীন ইন্ডিয়া (জেএমআই), আলকায়দা, হুজিকে মোটেই সমর্থন করি না, তেমনি আরএসএসসহ সঙ্ঘপরিবারকেও সমর্থন করি না। ২০০২ সালে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের মহাবোধি সোসাইটিতে গঠিত হয়েছিল Campaign Against Atrocities On Minorities in Bangladesh (CAAMB/ক্যাম্ব)। বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও ওখানকার তথাকথিত মেকি সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী, কলকাতার কিছু নকশালপন্থী নেতা বিমল প্রামাণিক, মোহিত রায় ও অচিন্ত গুপ্তদের সহায়তায় ক্যাম্বর জন্ম হয়। বিমল প্রামাণিক রাজশাহীর হাড়োয়ার সন্তান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিতে এমএসসি। একাত্তর-পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতা আসেন। একসময় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় সংহতি পরিষদের সদস্য ছিলেন। মোহিত রায় কুমিল্লার ভ‚মিপুত্র হলেও কলকাতায় নকশাল রাজনীতি করতেন। ছিলেন একজন পরিবেশবিদ। এখন তিনি বিজেপির উদ্বাস্তু সেলের নেতাও। থাকেন যাদবপুরের কাছে সন্তোষপুরের ইস্টার্ন পার্কে। ক্যাম্বের কাজ হলো, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কী নির্যাতন হয়, তার কাহিনী চটকদারি করে পরিবেশন। তবে বালিগঞ্জ শিক্ষাসদন থেকে শুরু করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ক্যাম্বের সম্মেলন হলেও বাম জমানায় পুলিশের নজরদারি থাকায় খুব বেশি এগোতে পারেনি। তবে এই সংগঠন তলে তলে আরএসএসের হয়ে কাজ করেছে বলে বাংলাদেশে আজ আরএসএসসহ সঙ্ঘপরিবারের বাড়বাড়ন্ত বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। পশ্চিমবঙ্গে এদের সম্মেলনগুলোতে আসতেন বিজেপি ও আরএসএসের শীর্ষ নেতৃত্ব।
আরএসএস নারী শাখা দুর্গাবাহিনী বিগত পাঁচ-ছয় বছর থেকে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকার জেলাগুলোতে। পশ্চিমবঙ্গে উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট, মিনাখা, হাড়োয়া, বাগদা, বনগাঁ ও সন্দেশখালি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগর, পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ, নামখানা, ক্যানিং ও বাসন্তি এলাকার প্রবল প্রতাপ দুর্গাবাহিনীর। ঠিক বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরিশালে দুর্গাবাহিনীর কাজকর্ম বেড়েছে। বাংলাদেশের এই জেলাগুলোতে ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বঙ্গসেনা, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, আমরা হিন্দু, হিন্দু সংহতির ব্যাপক দাপট। ১৯৮২ সালের ২৫ মার্চ গঠিত বঙ্গসেনার জন্ম যার নেতা মূলত কালীদাস বৈদ্য ও চিত্তরঞ্জন স্যুটার। দু’জনই মারা গেছেন। দু’জনই বরিশালের ভ‚মিপুত্র। এই সংগঠন বাম জমানায় নানাভাবে ভেঙে যায়। এদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাংলাদেশের যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা , বাগেরহাট ও বরিশালে হিন্দু বাঙালিদের নিয়ে পৃথক স্বাধীন বঙ্গভ‚মি গড়ে তোলা। এখন এই সংগঠনের নেতা শিশির সরকার। উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর কাছে মসলন্দপুরে এদের অফিস। এদের বর্ডার এলাকায় খুব দাপট। এদের পৃথক স্বাধীন বঙ্গভ‚মির রাজধানী খুলনার গল্লামারি। শিশির সরকার খুলনার সন্তান। এখন এরা আরএসএসের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস বা বিজেপির ঘাঁটি এখন হিন্দিভাষীদের মধ্যে। অনেকটাই উদ্বাস্তু বাঙালিদের মধ্যে। এখন আবার আদিবাসীদের মধ্যেও গড়ে উঠছে।
যেকোনো দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনকে তীব্র নিন্দা করি এবং তার প্রতিকার হওয়া দরকার সে দেশের আইন অনুসারে। বাংলাদেশে এখন আরএসএসের শাখা হাজার খানেকের কাছাকাছি। আরএসএস স্বাধীনতার আগে শক্তিশালী ছিল যশোর-খুলনা-বাগেরহাট-বরিশালে।
আমাদেরকে একটু অতীতের দিকে যেতে হয়। ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী ছিল কলকাতা। এখন কলকাতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের রাজধানী ও ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী। এই কলকাতার মানিকতলার তেলকল মাঠে আরএসএস নেতা সদাশিব গোলওয়ালকর ১৯৩৯ সালের ২২ মার্চ প্রথম আরএসএস শাখার সূচনা করেন। আরএসএসের জন্ম উত্তরপ্রদেশের লখনউ শহরে ১৯২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। আরএসএসের সদর দফতর নাগপুর থেকে কলকাতায় এসে বিভিন্ন প্রচারক বা হোলটাইমার আরএসএস গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। প্রথম শাখা তৈরি হওয়ার পর এক মাসের মধ্যে সদাশিব গোলওয়ালকর কলকাতা থেকে নাগপুর চলে যান। তারপর তেলেগু ব্রাহ্মণ মধুকর দত্তাত্রেয় দেওরসকে কলকাতা পাঠানো হয় সঙ্ঘের কাজ দেখাশোনার জন্য। তিনি ১৯৬৫ সালে আরএসএসের সাধারণ সম্পাদক হন। কিন্তু আবার ১৯৪৫ সালে গোলওয়ালকরের মৃত্যুর পর কলকাতায় দত্তপন্থা বাপুরাওকে কলকাতায় পাঠানো হয়। তিনি কলকাতায় ১৯৫৫ সালের ২৩ জুলাই ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ বা বিএমএস নামে একটি শ্রমিক সংগঠন গঠন করেন।
দেওরস আরএসএসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১৯৫৬-৬২ সাল পর্যন্ত। দেওরস কলকাতায় এসে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। হিন্দু মহাসভা পরে আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা হয়। কিন্তু এই ফাঁকে বাংলা ভাগ ও দেশ ভাগ হয়ে যায়। কংগ্রেসের একশ্রেণীর নেতার সাথে হিন্দু মহাসভা বা আরএসএসের দারুণ সখ্য গড়ে ওঠে। হিন্দু মহাসভা ছিল একসময় কংগ্রেসের জোটসঙ্গী। আবার তা ভেঙেও যায়।
কিন্তু যাই হোক, ১৯৪৭ থেকে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস সেভাবে শক্তিশালী হতে পারেনি। যা কিছু শক্তি অর্জন করেছে ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ও ২০১৪ সালে দিল্লিতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ বা উত্তরবঙ্গে বিজেপি শক্তিশালী বলেই চিকেন নেককে সামাল দিতে উত্তরবঙ্গকে ভেঙে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করতে চায় বিজেপি সরকার। বারবার ঘুরে যাচ্ছেন আরএসএস সুপ্রিমো মোহন ভাগবত। তাদের লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গকে কাশ্মিরের মতো করা। তাই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে তাদের থাবা দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। আরএসএস শাখা চালায় তিনভাবে। ‘মণ্ডলী’, ‘মিলন’ ও ‘ দৈনিক শাখা’। পশ্চিমবঙ্গে এই তিন শাখার মোট সংখ্যা ১০ হাজারের কাছাকাছি। দৈনিক শাখা হলো শরীরচর্চাবিষয়ক। কলকাতার বিভিন্ন পার্কে এই শরীরচর্চা হয়। এ ছাড়া আরএসএস নিয়ন্ত্রিত স্কুলের সংখ্যা তিন হাজার। সরস্বতী বিদ্যালয়, দুর্গা বিদ্যালয়, সরস্বতী শিশু বিদ্যামন্দির, একল বিদ্যালয় ও বনবাসী কল্যাণ আশ্রম আরএসএস প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। মোট কথা দুই বংলাতে তাদের মজবুত থাবা। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘও ঠিক তাই।
বাংলাদেশে শুধু ইসকন নয়, আর এস নিয়ন্ত্রিত অনেক প্রতিষ্ঠান ও স্কুল কাজ করছে আরএসএসের হয়ে। অনেক ফাউন্ডেশন ও এনজিও কাজ করছে আরএসএসের সহযোগী হিসেবে। দুই বাংলায় এদের বিপজ্জনক থাবা।
লেখক : পশ্চিমবঙ্গের কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও কবি